X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

বৈশ্বিক উষ্ণতা কি বাংলাদেশকে ধ্বংস করছে?

জিশান হাসান
১৯ জুলাই ২০১৭, ২১:৫০আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২০:৫৪

জিশান হাসান জেমস হানসেনের বই ‘স্টর্মস অব মাই গ্র্যান্ডচিলড্রেন; দ্য ট্রুথ অ্যাবাউট দ্য কামিং ক্লাইমেট ক্যাটাস্ট্রোপ অ্যান্ড আওয়ার লাস্ট চান্স টু সেভ হিউম্যানিটি’ পড়াটা এক দারুণ অভিজ্ঞতা।  ২০০৯ সালে ব্লুমসবারি বইটি প্রকাশ করেছে।  ড. হানসেন অপ্রয়োজনীয় গুজব ছড়ানোর মানুষ নন।  তিনি বিশ্বের অন্যতম একজন জলবায়ু বিজ্ঞানী।  নিউ ইয়র্কে অবস্থিত নাসার গোদার্দ ইনস্টিটিউট অব স্পেস স্টাডিজ-এর সাবেক পরিচালক।  তার বইতে আশঙ্কা করা হয়েছে, বৈশ্বিক উষ্ণতায় বাংলাদেশের ধ্বংস হয়ে যেতে পারে।
বৈশ্বিক উষ্ণতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে না করা গড়পড়তা শিক্ষিত নাগরিকদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। যেখানে সংবাদমাধ্যম ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার বিষয়টি অগ্রাহ্য করে চলেছে, তখন ব্যক্তি মানুষ এটাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করবে কিভাবে? ড. হানসেন ব্যাখ্যা করে বলেছেন, এর কারণ হলো বর্তমান গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সরকার সাধারণভাবে অর্থের বিনিময়ে যে সরকার গঠন করা যায় তাতে পরিণত হয়েছে।  এটা দেখা গেছে যে, তেল, গ্যাস ও কয়লা শিল্পের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ রয়েছে যা দিয়ে তারা যে কোনও সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারে, বিশেষ করে যেসব সরকার কম মূল্যে জ্বালানি, শিল্পের প্রবৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দেয় সেই সব সরকারকে।  যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে নির্দিষ্টভাবে এটা সত্য।  দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করেছেন।  চুক্তিটিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫-২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে।  যার ফলে আমাদের সবার ভবিষ্যৎ হুমকির মুখে পড়েছে।  সত্য হলো, প্রতিদিন যখন আমরা জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়াই তাতে করে জলবায়ু পরিবর্তনে সর্বনাশের আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়।
জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক আন্তর্জাতিক প্যানেল (ইন্টারন্যাশনাল প্যানেল ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ, আইপিসিসি)-এর গবেষণায় আগামী শতাব্দিতে সাগরের উচ্চতা (সি লেভেল) মাত্র ১-২ মিটার বৃদ্ধি পেতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।  এই তথ্য হয়তো অনেক মানুষই শুনেছেন এবং উড়িয়ে দিয়েছেন।  কিন্তু ড. হানসেন উল্লেখ করেছেন, আইপিসিসি সাগরের উচ্চতার যে পূর্বাভাস দিয়েছে তাতে কম করে বলা হয়েছে।  ভৌগলিক পরিসংখ্যান অনুসারে সাগরের উচ্চতা বৃদ্ধির পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে।  বইটির ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় তিনি লিখেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি বা এরচেয়ে বেশি বৃদ্ধি হলে পৃথিবী ৩০ লাখ বছর আগের প্লায়োসিন পর্বের মতো উষ্ণ হবে।  ওই সময় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এখনকার চেয়ে প্রায় ২৫ মিটার (৮০ ফুট) বেশি ছিল।  এমনকি ২০ মিটার উচ্চতা বৃদ্ধিই উত্তরবঙ্গ ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকাবাদে পুরো বাংলাদেশকে নিমজ্জিত করার জন্য যথেষ্ট।

এটা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সমঝোতা ও আলোচনা বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রিতে আটকে রাখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ।  কারণ হলো, ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলেই বাংলাদেশের মতো নিম্নাঞ্চল শুধু নয়, আরও বিশ্বের জন্য ভয়ঙ্কর বিপর্যয় ডেকে আনবে।  প্রকৃতপক্ষে, বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি ২ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার যে লক্ষ্য গত বছর প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে তা থেকে অনেক দেশই কার্বন নিঃসরণ কমানো খরচ ও রাজনৈতিকভাবে প্রয়োজনীয় মনে করে না।  এই ক্ষেত্রে, যুক্তরাষ্ট্রের প্যারিস চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে বাংলাদেশ বিশ্ব সম্প্রদায় দ্বারা অনিবার্য ধ্বংসের মুখে পড়েছে।  ডোনাল্ড ট্রাম্প মনে করেন বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির পরিমাণ ২ ডিগ্রির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য অর্জন কঠিন।

এখন তাহলে বাংলাদেশের ১৫ কোটি মানুষের সামনে কোনও পথ খোলা থাকছে? বিত্তশালী ও শিক্ষিত অভিজাতরা সব সময় অন্যদেশে পাড়ি জমাতে পারেন।  নিম্ন আয়ের ৯০শতাংশ মানুষ পড়বেন নির্মম ভবিষ্যতের মুখে।  যদিও বৈশ্বিক উষ্ণতার পুরোপুরি প্রভাব পড়তে এক শতাব্দি বা তারচেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে।  জলবায়ু পরিবর্তন যদি সত্যিকার অর্থের হানসেনের আশঙ্কা মতোই বিপর্যয়কর হয় তাহলে বাংলাদেশের সামনে একটি পথই খোলা রয়েছে।  আর তা হচ্ছে ঢাকাকে ঘিরে উত্তরাঞ্চলে একাধিক মেগাসিটি গুড়ে তোলা।  সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে আবশ্যিকভাবে দেশের অর্ধেক এলাকা দক্ষিণাঞ্চল স্থায়ীভাবে বন্যায় নিমজ্জিত হবে।  যার অর্থ বিপুল পরিমাণে ভূমি হারানো এবং উত্তরমুখী মানুষের ঢাকায় চলে আসা।  ঢাকাকে ঘিরে থাকা নরসিংদি, গাজিপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলেও আগামী কয়েক দশকে মানুষের ভীড় বাড়তে থাকবে।  আমাদের এখনই এজন্য পরিকল্পনা করা দরকার।  প্রতিটি ছোট শহরকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল মেগাসিটিতে রূপান্তর করতে হবে।  যেগুলোতে থাকবে স্কল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ও হাসপাতাল।  বিশেষ করে থাকবে শিল্পাঞ্চল যা জলবায়ুর কারণে শরণার্থীতে পরিণত হওয়া দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের জন্য বিপুল সংখ্যায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করবে।  শিক্ষাখাতে আমাদের বিপুল পরিমাণে বিনিয়োগ করতে হবে। জমি ও বাড়ি হারিয়ে গ্রামীণ অভিবাসীরা যখন নিঃস্ব হয়ে যাবেন তখন একমাত্র সম্পদ জ্ঞান ও দক্ষতা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে।

এটা আশ্চর্য যে, হানসেনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানীরা যখন পরিস্থিতি নিয়ে গুরুতর আলোচনা করে বই লিখছেন তখন আমাদের নীতি-নির্ধারকরা বিষয়টি তেমন গুরুত্বই দিচ্ছেন না, তাদের লক্ষ্য জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন (অ্যাডাপশন) তহবিলের ন্যায্য অংশ আদায়।  অথচ এই তহবিলের অনেক দাতাই নিজেদের প্রত্যাহার করছেন।  এরপরও বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ অঞ্চলের সাড়ে ষোল কোটি মানুষ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ধারণাটি অবাস্তব বলে মনে হয়।

পুরো বিশ্ব যদি সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশের ঠিকে থাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয় তাহলে তাদের স্বীকার করা উচিত এতো বড় ধরনের অভিযোজনমুখী পরিবর্তন একেবারে অসম্ভব।  তাদের উচিত আমাদের বেঁচে থাকা নিশ্চিত করতে বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা।  যার জন্য প্রয়োজন খুব দ্রুতই জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়ানো সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা।  এটাই একমাত্র আনন্দময় সমাধান।  সব জীবাশ্ম জ্বালানি বিশেষ করে কয়লা আগামী দশকের মধ্যে বাদ দেওয়া উচিত। কয়লার পরিবর্তে সৌর বা বায়ু বিদ্যুৎ এবং পারমাণবিক বিদ্যুতের মতো নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করা প্রয়োজন।  বড় ধরনের শিল্পাঞ্চলের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের সরবরাহ নিশ্চিত করতে একমাত্র অ-জীবাশ্ম ফুয়েলভিত্তিক জ্বালানির উৎস পারমাণবিক বিদ্যুৎ।

ড. হানসেনের বইটি একান্তই ব্যক্তিগত।  এতে তার নাতির জন্মগ্রহণ কিভাবে তাকে দায়িত্বশীল হতে বাধ্য করেছে সে কথা বলা হয়েছে।  এই দায়িত্বশীলতার অংশ হিসেবে নাতির ভবিষ্যৎ জীবনের সুরক্ষার জন্য তাকে বৈশ্বিক উষ্ণতাবিরোধী অ্যাকটিভিস্টে পরিণত করেছে।  বাংলাদেশিদের উচিত বিশ্বকে নিয়ে একই ধরনের দুর্ভাবনায় থাকা।  যে পৃথিবীতে তাদের শিশু ও নাতিরা জন্ম নেবে তা নিয়ে উদ্বেগজনক অবস্থায় থাকা।

লেখক: পরিচালক, টুএ মিডিয়া লিমিটেড

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
ইউক্রেনের শান্তি পরিকল্পনা অর্থহীন: ল্যাভরভ
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
বিএনপির নিগৃহীত নেতাকর্মীদের তালিকা চাইলেন ওবায়দুল কাদের
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
৭ বছর পর নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নতুন কমিটি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ