X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ‘চেতনার ব্যবসা’ বন্ধ করুন

লীনা পারভীন
২০ জুলাই ২০১৭, ১৪:৫৪আপডেট : ২০ জুলাই ২০১৭, ১৫:১৩

লীনা পারভীন আমি ৭৫ পরবর্তী প্রজন্মের একজন। আমি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দেখিনি কিন্তু তাঁর হাত ধরে জন্ম নেওয়া একটি দেশকে দেখছি। আমার বাবা-মা’র মুখে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর গল্প শুনেছি। বড় হয়ে জেনেছি কেন তিনি একজন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি এবং কেন তিনি বাঙালি জাতির পিতা? আমার সবসময়ই মনে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ওপর অধিকারবোধ কোনও নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নয়, গোটা জাতির। তিনি আওয়ামী লীগের নেতা ছিলেন কিন্তু ১৯৭১ তাঁকে গোটা বাঙালি জাতির নেতা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ইতিহাস বলে গোটা বিশ্বে বাংলাদেশ মানে একজন শেখ মুজিবের নাম।
বঙ্গবন্ধু নিজেও কোনোদিন তাকে আওয়ামী লীগের নেতা হিসাবেই আবদ্ধ রাখেননি বা রাখতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন সারা বাংলার নেতা হতে এবং হয়েও ছিলেন নিজের যোগ্যতায়। আমরা যারা তার সময়কাল দেখিনি তাদের জন্য তাঁরই নিজের রচিত গ্রন্থ দুটি হচ্ছে দালিলিক প্রমাণ।
১৯৭১ পরবর্তী ইতিহাস আমাদের সবার জানা আছে। ধীরে ধীরে তাঁকে বিতর্কিত করার চেষ্টা, তাঁকে ব্যর্থ রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে প্রমাণ করার ষড়যন্ত্র এবং বাংলার সাধারণ মানুষকে তাদের পিতার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার মতো জঘন্য কাজের প্রমাণও আমরা পাই। আর সে কাজটিতে সাহায্য করেছিলো তাঁরই নিজের হাতে গড়ে তোলা কিছু আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মী যারা উনার সান্নিধ্য নিয়ে বেড়ে উঠেছিলো, নেতা হয়েছিলো। বাস্তবে কি তারা বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসেছিলেন? অন্তত তাদের কর্মকাণ্ড এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের জড়িত থাকার ইতিহাস এ কথাকে সমর্থন করে না। বঙ্গবন্ধুকে বাংলার মাটি থেকে মিশিয়ে দেওয়ার নানারকম ষড়যন্ত্রের নমুনা আমরা দেখেছি। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিলো সে বিছিন্নকরণ প্রক্রিয়া। পরবর্তীতে যে সরকারই ক্ষমতায় এসেছে তাদেরই অন্যতম চেষ্টা ছিল ইতিহাসের পাতা থেকে জাতির পিতাকে দূরে সরিয়ে রাখা। সে চেষ্টায় তারা একেবারে ব্যর্থ হয়নি।

ক্ষমতার রদবদলের প্রক্রিয়ায় আমরা স্বাধীনতা বিরোধীদেরকেও ক্ষমতার আসনে দেখেছি। আমাদেরকে জানতে দেওয়া হয়নি সঠিক ইতিহাস। আমাদের জানতে দেওয়া হয়নি- কে শেখ মুজিব, কেমন করে টুঙ্গিপাড়ার এক সাধারণ ঘরে জন্ম নেওয়া একজন মানুষ ‘বঙ্গবন্ধু’ হয়ে উঠলেন, জানতে দেওয়া হয়নি কী করে তিনি ‘জাতির পিতা’র আসনে চলে এলেন।

শেখ মুজিবের দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার বাইরে রাখা হয়েছিলো প্রায় ২১টি বছর। এই লম্বা সময়ে বাংলাদেশের মাটিতে ঘটে গেছে অনেক পরিবর্তন। একটি বিশাল প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে বিকৃত ইতিহাসের পাঠ করে।

রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের একটি শিকড় রয়েছে এ মাটির সাথে কারণ  দলটি গড়ে উঠেছিলো এদেশেরই মাটির বুক চিরে। তাদের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাসের সঙ্গে মিশে আছে। আর ঠিক এই ঐতিহাসিক কারণেই দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্রের পরও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে যার নেতৃত্বে আছেন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা। একদিকে শেখ হাসিনা যখন দেশ গড়ার কাজে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিক তার উল্টোদিকে দলের নেতা কর্মীরা আছেন অন্য বিষয়ে ব্যস্ত।

আমাদের দেশের একটি খুব কমন ট্রেন্ড হচ্ছে ক্ষমতার পালাবদলের সাথে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের দলবদলের খেলা। এই সুযোগে আজকে বাংলাদেশে বিরোধীদলের কর্মীদেরকে খুঁজেই পাওয়া মুশকিল। সবাই এখন আওয়ামী লীগ হয়ে গেছেন। খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক যখন বলেন দলে এখন ‘হাইব্রিড’ আর ‘কাউয়া’ দিয়ে ভরে গেছে তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না এরা কারা? এত আওয়ামী লীগ কোথা থেকে এলো? দলের দুঃসময়ে এরা কোথায় ছিল?

আওয়ামী লীগের কি কর্মীদের এতই অভাব পড়েছে যে অন্য দল থেকে ভাড়া করে এনে কর্মী বানাতে হবে?  তাছাড়া নীতির প্রশ্নেতো এমন অনেকেই আজকে এই দলটিতে ভীড়েছেন যাদের স্বাধীনতা বিরোধী দলের সাথে যুক্ত থাকার প্রমাণও আছে। তাহলে এদের নিয়ে আপনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে কেমন করে বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখতে পারেন?

আর এরাই আজকে কথায় কথায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বুলি দিচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর চেতনার ভয় দেখাচ্ছে। প্রকৃত আওয়ামী লীগের লোকদের আজকে খুঁজেই পাওয়া যায় না। তারা অযত্ন, অবহেলায়, অভিমানে দলের থেকে দূরে সরে গেছে আর দলের মাঝে লুকিয়ে থাকা 'নব্য আওয়ামী চেতনাবাজদের' প্রভাব দেখে হতাশায় দিন গুনে। এসব 'হাইব্রিড'রা হচ্ছে তারাই যারা আওয়ামী লীগ ক্ষমতার বাইরে থাকলে ইতিহাস বিকৃতিকে উস্কে দেয় আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দলের ভেতরে ঢুকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে পুঁজি করে নিজের স্বার্থকে পরিপূর্ণ করে এবং প্রকৃত আওয়ামী সমর্থকদের দূরে ঠেলে দিয়ে ‘চেতনার ব্যবসায়ী’ হয়ে আওয়ামী লীগকে জনবিচ্ছিন্ন করার পুরনো ষড়যন্ত্রকে চাঙ্গা করে তুলে। তারা খুব ভালো করেই বুঝে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে সরানোর একটাই রাস্তা আর সেটা হচ্ছে জনবিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। এই খেলা তারা ৭৫'র এর আগেও খেলেছে। একই খেলা তারা শুরু করেছে শেখ হাসিনার আমলেও। আমি জানি না তিনি এদের বিষয়ে কিছু ভাবছেন কিনা। ভাবছেন যে সেটা অবশ্য তার বক্তব্যে বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন সদস্য নির্বাচনের সময় ব্যক্তির পারিবারিক, রাজনৈতিক এবং মতাদর্শিক ইতিহাসকে বিবেচনায় নিতে। কিন্তু এর কোনও বাস্তবায়ন আমরা অন্তত মাঠের নেতা কর্মীদের মাঝে দেখছি না। কেন্দ্রীয় নেতারাও উদাসীন।

সরকার যখন বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা, মুক্তিযুদ্ধ এই বিষয়গুলোর সাথে আমাদের নতুন প্রজন্মের পরিচয় ঘটানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন। তখন তারই দলীয় পরিচয়ে আরেকটি গোষ্ঠী মেতে রয়েছে ঠিক তার বিপরীত পরিচয়ে। সর্বশেষ উদাহরণ বরিশালের আগৈলঝরা ইউনিয়নের ঘটনাটি। ১৭ মার্চ আমাদের জাতির পিতার জন্মদিন। এ দিনটিকে সরকার জাতীয় শিশু দিবস হিসাবে ঘোষণা দিয়েছ। আর এই দিনটিকে কেন্দ্র করে শিশুদের জন্য সারা দেশেই আয়োজন করা হয় নানারকম অনুষ্ঠান। চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতাও এমন একটি আয়োজন। ঘটনা থেকে জানা যায় যে সেই ইউনিয়নের কর্তৃপক্ষের আয়োজনে দিবসটিকে কেন্দ্র করে আয়োজিত চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার শীর্ষে থাকা একটি শিশুর অঙ্কনের বিষয় ছিল জাতির পিতা। এটি কোনও প্রশিক্ষিত বা ডিগ্রিপ্রাপ্ত চিত্রশিল্পীর প্রতিযোগিতা ছিল না। ছবিটি দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো এটি একটি অপরিপক্ক হাতের আঁকা ছবি কিন্তু এ ছবিটি দেখেই কেউ বুঝতে পারবে এটি বঙ্গবন্ধুর ছবি। কারণ শিশুটি তার মগজে ধারণ করা শেখ মুজিবকেই এঁকেছে। এর মধ্য দিয়ে সেই শিশুটির যে ভালোবাসা ফুটে উঠেছে এটি দেখার মতো দৃষ্টি অন্তত মামলাবাজ উকিলটির নেই। আমি সেই উকিলের রাজনৈতিক ইতিহাস জানি না। তিনি কত বছর ধরে আওয়ামী লীগ করেন তাও জানি না তবে এটুকু বুঝেছি যে তিনি একজন প্রকৃত মুজিব প্রেমিক নন।

এই একটি দিবসকে কেন্দ্র করে কত শিশু জানতে পারছে আমাদের জাতির পিতা, বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ এই বিষয়গুলো সম্পর্কে? আমার সন্দেহ হয়- হয়তো তিনি জানেন বলেই এই অপকর্মটি করেছেন। তিনি হয়তো সেই দলের লোক যারা কখনই চায় না আমাদের ইতিহাসে শেখ মুজিব নামটি থাকুক, যারা চায় না প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসাবে চিনুক, তার উদারতার কাহিনি জানুক। শিশুদের প্রতি তার মমতার কথা, ভালোবাসার কথা জানুক। তাইতো তিনি যে ইউএনও জাতির পিতার ইতিহাস জানানোর প্রয়াসে সেই শিশুটিকে উৎসাহিত করেছেন, একটি শিশুর মাধ্যমে হাজারো লক্ষ শিশুকে বঙ্গবন্ধুর সাথে পরিচিত করাতে চেয়েছেন তার কণ্ঠরুদ্ধ করতে চেয়েছেন।

আমি আওয়ামী লীগ করি না কিন্তু শেখ মুজিবকে আমি জাতির পিতা হিসাবে মানি। আমি আওয়ামী লীগ করি না কিন্তু দেশবিরোধীদের ক্ষমতায় আসা ঠেকাতে আমার শেখ হাসিনাকে চাই। আমি আওয়ামী লীগের ব্যানারে মিছিল করি না কিন্তু চাই দেশের একমাত্র বৃহৎ জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হয়ে এই দলটি সঠিক পথে থাকুক। আমি আওয়ামী লীগ বুঝি না কিন্তু আমি শেখ মুজিব বুঝি, শেখ হাসিনা বুঝি। আমি ৭১ বুঝি, মুক্তিযুদ্ধ বুঝি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুঝি। আমি সংবিধানকে বুঝতে চাই, স্বাধীন স্বার্বভৌম এবং অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আর আমার এইসব চাওয়াকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে শেখ মুজিবকে লাগবে, জাতির পিতাকে লাগবে কারণ তিনি কেবল আওয়ামী লীগের নয়, তিনি গোটা জাতির সম্পদ, সব রাজনৈতিক দলের জন্য তিনি একটি আদর্শ। তার আদর্শকে টেনে নিয়ে যেতে হলে সেই আদর্শকে চেনাতে হবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। সেজন্যই লড়াই করতে হবে আদর্শকে পুঁজি করে 'ব্যবসাবাজদের', মামলা করতে হবে এইসব ভণ্ড চেতনাবাজদের বিরুদ্ধে।

বঙ্গবন্ধুর সঠিক আদর্শ কখনোই দলবাজ, তেলবাজ, চেতনাব্যবসায়ীদেরকে ঠাঁই দেয় না। আমি আমার পিতার সম্মান রক্ষার্থে বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাই যারা ওনার আদর্শের কথা বলে আদর্শবিরোধী কাজে লিপ্ত আছে তাদের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিয়ে এইসব দালাল এবং ভণ্ডদের ক্ষমতা দেখানোর রাস্তা বন্ধ করে দিন।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
বাংলাদেশের উন্নয়ন দেখলে আমাদের লজ্জা হয়: শাহবাজ
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
৬ ম্যাচ পর জয় দেখলো বেঙ্গালুরু 
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সাদি মহম্মদ স্মরণে ‘রবিরাগ’র বিশেষ আয়োজন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ