X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

অনুভূতি এত নড়বড়ে কেন?

আমীন আল রশীদ
২১ জুলাই ২০১৭, ১৪:৪৯আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৭, ১৪:৫০

আমীন আল রশীদ অনুভূতি, চেতনা,স্পর্শকাতর––এই শব্দগুলো শুনলেই আমার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রয়াত দুই পার্লামেন্টারিয়ানের একটি ঘটনা মনে পড়ে।
বর্তমান রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ তখন জাতীয় সংসদের স্পিকার। এটা নবম সংসদের ঘটনা যখন বিএনপি বিরোধী দলে ছিল। কোনও একটা ইস্যুতে বিএনপির এমপি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেছিলেন, ‘মাননীয় স্পিকার বিষয়টা খুবই স্পর্শকাতর’। তখন অন্যদিক থেকে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রসিকতা বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার, কে কখন কী স্পর্শ করলে কাতর হয়, বোঝা মুশকিল।’ এ সময় সংসদের অধিবেশনকক্ষে হাসির রোল পড়ে।
আমাদের অবস্থাও এখন এমন যে, কথায় কথায় আমাদের অনুভূতিতে আঘাত লাগে। আমাদের চেতনা ধ্বংস হয়, স্পর্শ করলেই আমরা কাতর হই।
এই যেমন বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার সাবেক নির্বাহী কর্মকর্তাকে নাজেহাল হতে হলো এরকম কথিত এক অনুভূতির কারণে। যার অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে তিনি স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা এবং আইনজীবী। এক শিশুর আঁকা বঙ্গবন্ধুর ছবিতে নাকি জাতির মানহানি হয়েছে আর ওই ছবিটি স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্রে ব্যবহার করে নাকি ইউএনও মহোদয় মারাত্মক অপরাধ করে ফেলেছেন।
এই সংবাদটি যখন ১৯ জুলাই সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে দেখি, তখন একবার মনে হয়েছিল ফ্রান্সপ্রবাসী শিল্পী, মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিনকে একটা ফোন করি। কারণ তিনি বঙ্গবন্ধুর এত বেশি মূর্ত ও বিমূর্ত ছবি এঁকেছেন যে, যারা শিল্প বোঝেন না––তাদের কাছে মনে হবে এখানে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করা হয়েছে এবং ভাগ্যিস যে, এত বছরেও সাহাবুদ্দিন সাহেব বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগে কোনও মামলা খাননি।

ঘটনা যতটুকু জানা গেছে তা হলো, গত ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও জাতীয় শিশু দিবসে ‘বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক একটি চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করে আগৈলঝাড়া উপজেলা প্রশাসন। ওই প্রতিযোগিতায় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকারী দুই শিশুর ছবি দুটি নিয়ে পরবর্তীতে ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আমন্ত্রণপত্র ছাপায় উপজেলা প্রশাসন। এই ঘটনার আড়াই মাস পরে গত ৭ জুন আগৈলঝাড়া উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা (বর্তমানে বরগুনায় কর্মরত) গাজী তারেক সালমানের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের ধর্মবিষয়ক সম্পাদক এবং জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ওবায়েদ উল্লাহ সাজু। এই মামলায় ১৯ জুলাই প্রথমে তারেক সালমানের জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলেও পরে তাকে জামিন দেন আদালত। দেখা যাচ্ছে, আইনজীবী মহোদয়ের অনুভূতির দাপট এতই যে, ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্রে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃতির অভিযোগে মামলা করতে তার সময় লেগেছে প্রায় আড়াই মাস।

আমরা অনেক সময় কিছু না বুঝলে বা খটকা লাগলে জিজ্ঞেস করি, ভাই আসলে কেসটা কী? আমারও অনেক সহপাঠী, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন উকিল ব্যারিস্টার আছেন। তাদের কয়েকজনকে বরিশালের এই উকিল সাহেবের ‘অনুভূতির’ আইনি ব্যাখ্যা জানতে চেয়েছিলাম। তারা আমাকে পরামর্শ দিলেন যে, এখানে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শিশুটির ছবিটি বোধ হয় মূখ্য ব্যাপার নয়। ওই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নাজেহাল করার পেছনে অন্য কোনও কারণ আছে। সেটা অনুসন্ধান করা জরুরি।

সেই অনুসন্ধান করতে গিয়ে যতটুকু জানলাম তা হলো,তারেক সালমান আগৈলঝাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা থাকাকালীন ডিগ্রি পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনের দায়ে এক পরীক্ষার্থীর খাতা কেড়ে নিয়েছিলেন। এ নিয়ে ওই ছাত্রের সঙ্গে তারেক সালমানের বাকবিতণ্ডা হয়। পরে তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ওই ছাত্রকে সাজা দেন। ঝামেলা হচ্ছে, ওই ছাত্র স্থানীয় এক প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতার ছেলে। এই ঘটনায় তারেক সালমানের ওপরে ওই পরিবারের ক্ষোভ ছিল। দ্বিতীয়ত, তিনি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে অনেককে সাজা দিয়েছেন, জরিমানা করেছেন। অনেক জমি দখলকারীর বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছেন। অর্থাৎ আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে তিনি অনেকেরই চক্ষুশূল হয়েছিলেন। স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, তারেক সালমান আগৈলঝাড়া উপজেলায় একজন সৎ অফিসার হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং বর্তমানে বরগুনায়ও তার সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এবং স্থানীয় সাংবাদিকদের ধারণা খুবই ইতিবাচক। ফলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে এই মামলার পেছনে বিভিন্ন সমেয় ক্ষতিগ্রস্ত এবং ক্ষুব্ধ লোকজনের প্রভাব থাকতে পারে।  

বাস্তবতা হলো, যে অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছে, সেটি খুবই হাস্যকর। কেননা, শিশুদের আঁকা ছবিতে কোনও বিকৃতি বা মানহানির অভিযোগ আনা যায় না। তাছাড়া শিশুরা বঙ্গবন্ধুর ছবি আঁকলে তা দিয়ে সরকারি অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র ছাপানো যাবে না, এমনও বিধান নেই। বরং খোদ প্রধানমন্ত্রীর অনুষ্ঠানেও শিশুদের এমনকি প্রতিবন্ধী শিশুদের আঁকা ছবি দিয়ে আমন্ত্রণপত্র ছাপানোর রেওয়াজ আছে। ফলে তারেক সালমান দুজন শিশুর আঁকা ছবি দিয়ে স্বাধীনতা দিবসের আমন্ত্রণপত্র ছাপিয়ে মূলত বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার শ্রদ্ধারই প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বিষয়টা এমন নয় যে, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করেছেন। তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নিই যে, তিনি আওয়ামীপন্থী নন বা তিনি অন্য কোনও রাজনৈতিক দল পছন্দ করেন––তারপরও এত বড় ঝুঁকি নেওয়ার কথা নয়। সুতরাং আমন্ত্রণপত্রে বঙ্গবন্ধুর ছবি ব্যবহারের পেছনে তার যে কোনও অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না, তা বুঝতে কোনও পণ্ডিত হওয়ার দরকার নেই। বরং যারা শিল্প বোঝেন না, যারা ব্যক্তিগত শত্রুতার প্রতিশোধ নিতে জাতির মানহানির অভিযোগে মামলা করেন, সেসব লোককে বরং আমাদের চিহ্নিত করা দরকার। তারেক সালমানের বিরুদ্ধে যিনি মামলাটি করেছেন, তিনি একজন আইনজীবীই শুধু নন, একটি বিভাগীয় শহরের আইনজীবী সমিতির সভাপতি। সুতরাং তার মতো লোকের কাছ থেকে দেশের মানুষ আরও দায়িত্বশীল এবং বস্তুনিষ্ঠ আচরণ আশা করে।

সমস্যা হলো, বঙ্গবন্ধু যখন জীবিত ছিলেন, তার চারপাশে অনেক চাটুকার ছিল। এখন শেখ হাসিনার চারপাশেও চাটুকারের অভাব নেই। এরা সব সুবিধাবাদী। একাত্তর টিভির বার্তা পরিচালক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যারা শিশুর আঁকা ছবিতে ত্রুটি খোঁজে...তারা ব্যবসায়ী... তারা রাজাকার... শিশুর মনের শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা বোঝে না... বোঝার নৈতিকতা নেই... তারা তস্য রাজাকারের বংশধর... তারা এখন যে দলই করুক…।’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার মহান স্থপতি, আমাদের জাতির পিতা, তার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতে আরও বহু সময় লাগতো––এসবই ধ্রুব সত্য এবং এ নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। কিন্তু অতিউৎসাহী এবং সুবিধাবাদী ও সুবিধাভোগী লোকজনের অতিবিপ্লবী কর্মকাণ্ডের পেছনে যে অনেক সময়ই ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকে বা থাকতে পারে––তার সবশেষ উদাহরণ এই মামলা। 

ব্যক্তিগতভাবে আমি এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, মহানবীর চেয়ে বড় মুসলমান হওয়া যেমন কারও পক্ষে সম্ভব নয়, তেমনি এই মুহূর্তে শেখ হাসিনার চেয়ে বড় আওয়ামী লীগার হওয়াও অসম্ভব। কিন্তু টিভি টকশো, পত্রিকার কলাম আর মাঝেমধ্যে এরকম দু চারটা মানহানির মামলাকারীদের আচার আচরণ আর কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, এরা শেখ হাসিনার চেয়েও বড় আওয়ামী লীগ। ফলে এসব লোকের ব্যাপারে খুব সতর্ক থাকা দরকার। এরা দলের জন্য তো বটেই, বরং দেশের জন্যও ক্ষতিকর।

লেখক: সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
সাদি মহম্মদ: ভাইয়ের কান্না, বন্ধুর স্মৃতি, সতীর্থদের গানে স্মরণ…
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
খালি বাসায় ফ্যানে ঝুলছিল কিশোরী গৃহকর্মীর লাশ
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় ধীরে চলছে ট্রেন
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ