X
বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ!

বিভুরঞ্জন সরকার
২২ জুলাই ২০১৭, ১৭:২৬আপডেট : ২২ জুলাই ২০১৭, ১৮:০৫

বিভুরঞ্জন সরকার আজকের লেখার শিরোনামটি ধার করেছি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য থেকে। অফিসিয়ালি ওবায়দুল কাদের শাসক দল আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী। তার ওপরে দলীয় প্রধান, সভাপতি শেখ হাসিনা। আমার যদি প্রতিদিন লেখার সুযোগ থাকতো এবং সে লেখা প্রকাশের জায়গা থাকতো তাহলে প্রতিদিনের লেখারই হেডিং করতাম ওবায়দুল কাদেরের বক্তৃতা থেকে। তিনি কিছুদিন বাংলার বাণী পত্রিকায় কাজ করেছেন। তাই তিনি এটা জানেন যে সাংবাদিকরা খবরের আগে হেডিং খোঁজে। এখন তিনি তাই প্রতিদিন সাংবাদিকদের হেডিং সরবরাহ করে চলেছেন।  
তাকে বহুদিন থেকে চিনি। সেই ১৯৭৫ সালে বাকশাল হলে ছাত্রলীগ - ছাত্র ইউনিয়ন মিলে গঠিত হয়েছিল জাতীয় ছাত্রলীগ। জাতীয় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির  ২২ জনের একজন সদস্য ছিলেন। আমরা ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীরা নতুন সংগঠনে গিয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের দাপট দেখে বিস্মিত হতাম। তখন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী দুঃসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিতে ও কাকে দেখেছি। বরাবরই লক্ষ্য করেছি, তিনি বক্তৃতা দিতে পছন্দ করেন। আলঙ্কারিক ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে তিনি সাধারণ ছাত্রদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তবে বক্তৃতার সময় কষ্ট করে ভালো শব্দ খুঁজতে গিয়ে তিনি অনেক সময় আবশ্যক এবং অনাবশ্যক বলে যে শব্দ দুটি আছে তা ভুলে যান। আমার মনে হয়, অনাবশ্যক কথা বলা তার একটি প্রিয় শখ বা অভ্যাস।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে ওবায়দুল কাদেরের বক্তৃতার দুটি লাইন আমার এখনও কানে বাজে। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলতেন, জাতির পিতা শেখ মুজিব তার হৃদয়ের উত্তাপ দিযে বাঙালি জাতির জন্য একটি ভালোবাসার লাল গোলাপ ফুটিয়ে তুলেছেন – সেই গোলাপের নাম বাংলাদেশ। এই কাব্যিক উপস্থাপনা তখনকার পরিস্থিতিতে খারাপ লাগতো না। কিন্তু তিনি যখন বঙ্গবন্ধুর শিশু পুত্র শেখ রাসেলের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহ সময়ের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলতেন, শিশু রাসেল কেঁদে বললো, আমি ভিক্ষে করে খাবো, তোমরা আমাকে মেরো না - তখন এটা খুব ভালো লাগতো না। ভিক্ষে করে খাওয়ার কথা বলে রাসেল খুনিদের কাছে দয়া প্রার্থনা করেছিলেন – খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। যাহোক, ওবায়দুল কাদেরে'র বক্তৃতার ধরন বোঝানোর জন্য একটু পুাবো কাসুন্দি ঘাটলাম।
ওবায়দুল কাদের কথা বলতে ভালোবাসেন। তাকে বলা যায় কথাশিল্পী। কেন যে আমদের দেশে ভালো কথকদের কথাশিল্পী না বলে গদ্য লেখকদের কথাশিল্পী বলা হয়, সেটা আমার বোধোগম্য নয়। রাজনীনিবিদদের অনেকেই ভালো বক্তৃতা দিতে পারেন। আমাদের রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব ভালো ভাষণ দিতেন। তার বক্তৃতা মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে রাখতো। তার ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণকে এক অমর কাব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তার ভাষণের জাদুকরী প্রভাবের কারণে তাকে বিদেশি পত্রিকা ‘রাজনীতি’র কবি হিসেবে অভিহিত করেছিল।

এই গৌড়চন্দ্রিকার কারণ ওবায়দুল কাদের প্রতিদিনের কথামালা। তিনি যত কথা বলছেন তার সবই খুব প্রয়োজনীয় কথা বলে অনেকের কাছেই মনে হচ্ছে না। তিনি যদি কথা একটু কম বলে কাজ বেশি করতেন – সেটাই ভালো হতো। তিনি সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রী। প্রতিদিন তার দৌড়ঝাঁপের খবর গণমাধ্যমে আসে। একই সঙ্গে সারাদেশের বেহাল রাস্তাঘাটের খবরও আমাদের পড়তে হয়। তাহলে তার ছোটাছুটির ফল কী?  কর্মপ্রিয়তা আর প্রচারপ্রিয়তা এক জিনিস নয়। ওবায়দুল কাদের দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছেন গত বছর অক্টোবরে দলের কাউন্সিল অধিবেশনে। তিনি একজন উদ্যমী মানুষ হওয়ায় আশা করা হয়েছিল টানা ক্ষমতায় থাকায় দলের মধ্যে যেসব ক্লেদ জমা হয়েছে তা দূর করতে তিনি সক্রিয় হবেন। তিনি নিষ্ক্রয় তা নিশ্চয়ই কেউ বলবেন না। কিন্তু তার এই সক্রিয়তা দলে কোনও ইতিবাচক প্রভাবের ছাপ রাখতে পারছে কি? কোথাও কোন্দল বন্ধ হয়েছে? দলের সাংগঠনিক তৎপরতা বেড়েছে? এসব প্রশ্নের ইতিবাচক উত্তর পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না।

দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি যেসব বক্তৃতা দেন তার কিছু কিছু কখনও কখনও দলের জন্য বিব্রতকর হয়ে পড়ে। তিনি যখন বলেন, ক্ষমতা হারালে যারা টাকাপয়সা কামিয়েছেন তাদের পালিয়ে বেড়াতে হবে- তখন সেটা কার পক্ষে যায়? বিএনপি তো এটাই বলছে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থেকে শুধু টাকা কামাচ্ছে, ক্ষমতা গেলে এরা পালানোর পথ পাবে না। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজেই যখন ‘পালানো’র কথা বলেন, তখন কি বিরুদ্ধপক্ষের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় না?

কেউ হয়তো বলবেন, দলে যে ‘খাই’ পার্টি বেড়েছে সেটা বলায় দোষ কোথায়?  দোষ এখানেই যে তিনি তিনি আছেন প্রতিকারের অবস্থানে। তিনি যদি অভিযোগ করেন তাহলে প্রতিকার করবে কে?  নাকি তিনি পাবলিসিটি পাওয়ার জন্য পথে পথে ঘুরে নিজেকে পথের মানুষ ভাবতে শুরু করেছেন? তাকে খুশী করার জন্য যে যত তৈলাক্ত কথাই বলুননা কেন, সবাই নিশ্চিত জেনে রাখুন ওবায়দুল কাদের এই পালানোর বক্তব্য বিএনপি নির্বাচনি প্রচারণায় কাজে লাগাবে।

ছাত্রলীগ একটা অবাধ্য সংগঠনে পরিণত হয়েছে। সারদেশে ছাত্রলীগ নামধারীদের দৌরাত্ম্যে সাধারণ মানুষ শুধু নয়, আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকরাও অতিষ্ঠ। ছাত্রলীগকে দমন করার হোমিওপ্যাথিক ব্যবস্থা কোনও কাজে আসেনি। ছাত্রলীগের বাড়াবাড়ির জন্য বড় মাসুল গুনতে হবে আওয়ামী লীগকে। এহেন ছাত্রলীগের সভায় বক্তৃতা দিয়ে ওবায়দুল কাদের বললেন, তোমাদের টাকা লাগলে আমার কাছে এসো। আমি টাকা দেবো। তার এই বক্তব্য মানুষের কাছে কি ম্যাসেজ পৌঁছে দিল?

ছাত্রলীগ যে টাকা কামাইয়ের মেশিন হয়ে পড়েছে, চাঁদাবাজি-ধান্দাবাজি যে ছাত্রলীগের প্রধান কাজ হশে দাঁড়িয়েছে- সেটা কি তিনি প্রকারান্তে স্বীকার করে নিলেন না?  টাকা লাগলে তার কাছে যেতে হবে। তিনি কি দানছত্র খুলে বসেছেন? তার এই টাকার উৎস কী? এসব প্রশ্ন কেউ করলে তার মুখ বন্ধ করা হবে কোন ধারায়?

গত ৯ জুলাই ছিল আওয়ামী লীগের খুলনা বিভাগীয় প্রতিনিধি সভা। ক্ষমতাসীন দলের আয়োজন বলে কথা!  জাঁকজমকের কোনও কমতিই ছিল না। তো, ওই সভায় কি সুবচন আওড়ালেন ওবায়দুল কাদের? সংবাদপত্রে যতটুকু প্রকাশ হয়েছে তার পুরোটাই তুলে ধরছি: নেতাকর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, নিজেদের মধ্যে কোনও কলহ করবেন না, কোন্দল করবেন না। আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ বানাবেন না। আওয়ামী লীগ যদি আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ না হয়, তাহলে আগামী সংসদ নির্বাচনে দলের জয় কেউ ঠেকাতে পারবে না।

দলের দ্বিতীয় বড় শীর্ষ নেতা অন্য নেতাকর্মীদের কলহ-কোন্দল না করতে বলেছেন। দলের মধ্যে কি কলহ-কোন্দল নেই? আওয়ামী লীগ কি এর মধ্যেই সারাদেশে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়নি? দলের সাধারণ সম্পাদকের কাছে কি সারাদেশের দলীয় সাংগঠনিক খবরাখবর নেই? স্থানীয় সরকার নির্বাচনেই কি বোঝা যায়নি যে,আওয়ামী লীগের বিজয় ঠেকাতে দেশজুড়েই দাঁড়িয়ে গেছে বিদ্রোহী আওয়ামী লীগ? দলের হাই কমান্ডের কিছুই অজানা থাকার কথা নয়। আওয়ামী লীগ যে ব্যাধিতে আক্রান্ত তা এখনও নিরাময় অযোগ্য হয়নি। কিন্তু টোটকা চিকিৎসায় এর নিরাময় হবে না। অবিলম্বে শল্য চিকিৎসা লাগবে। কানে সুবচন ঢেলে কোনও কাজ হবে না।

ওবায়দুল কাদের আরো বলেছেন, আমি মন্ত্রী আমার এপিএস, ভাই, স্বজনেরা যদি অপকর্ম করে, তাহলে কি আমি ভালো মানুষ? হয় এদের সংশোধন করুন, না হয় তাদের বর্জন করুন। গুটি কতক মানুষের জন্য আওয়ামী লীগের রাজনীতি কলুষিত হতে পারে না।

কথা শুনে তো মনে হয় রোগ, রোগের ধরন সবই তার জানা। কিন্তু চিকিৎসার ব্যবস্থাটা ঠিকঠাক মতো হচ্ছে না। ‘গুটি কতক’ মানুষ আওয়ামী লীগের সব অর্জন করে দিচ্ছে। অথচ জেনে-বুঝেও দিনের পর দিন তাদের প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে। কেন? জেনেশুনে কেন এই বিষ পান?

ওবায়দুল কাদের আরো কথা আছে। তিনি বলেছেন, রাজনীতিতে ধৈর্য ধারণ করতে হয়। কিছুই পেলাম না- এই ভাব যেন না থাকে। খাই খাই ভাব আওয়ামী লীগের কর্মীদের মধ্যে নেই, আছে নেতাদের মধ্যে।

ওবায়দুল কাদের এই বক্তব্য আংশিক সত্য। নেতাদের খাই খাই ভাব দেখে কর্মীরা কি চুপচাপ বসে থাকতে পারে?  সব কর্মীর খাওয়ার সুযোগ তৈরি না হলেও কিছু কর্মী ঠিকই চিকন আলী থেকে মোটা আলীতে পরিণত হয়। আর নেতাদের মধ্যে খাই খাই ভাব থাকলে কর্মীদের মধ্যে তা সংক্রামিত না হয়ে পারে?  দলের সাধারণ সম্পাদক যখন বলেন আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে খাই খাই ভাব আছে তখন তা অবিশ্বাস করার উপায় আছে। এই খাই খাই স্বভাবের নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগ কিভাবে সামনে অগ্রসর হবে?

আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের আর একটি বক্তব্য উল্লেখ করেই আজকের মতো ইতি টানবো। গত ১৫ জুলাই নোয়াখালীর প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলছেন, মেধাবী ও চরিত্রবান লোকেরা রাজনীতিতে না এলে রাজনীতির মঞ্চ চরিত্রহীন ও খারাপ লোকের দখলে চলে যাবে আর সেই অযোগ্যরা দেশ চালাবে।

খুবই খাঁটি কথা বলছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক । বাহবা পাওয়ার মতো। প্রশ্ন হলো, মেধাবী ও চরিত্রবান লোকেরা রাজনীতিতে আসবে কিভাবে? রাজনৈতিক দলগুলোতে সে সুযোগ আছে? আওয়ামী লীগে আছে? যে মেধাহীন, চরিত্রহীনেরা আসর জমিয়ে বসে মজা লুটছে, তারা জায়গা ছাড়বে কেন? রাজনীতি এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনার উপযুক্ত মানুষ কোথায়?

এতদূরে না দেখে এখন বরং দেখা যাক, আওয়ামী লীগ যে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেটা কাটিয়ে ওঠার জন্য কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া এই দলটি।

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
অ্যাটলেটিকোকে বিদায় করে ১১ বছর পর সেমিফাইনালে ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগঅ্যাটলেটিকোকে বিদায় করে ১১ বছর পর সেমিফাইনালে ডর্টমুন্ড
অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে বার্সাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি
চ্যাম্পিয়নস লিগঅবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তনে বার্সাকে কাঁদিয়ে সেমিফাইনালে পিএসজি
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
গাজীপুরে ব্যাটারি কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে চীনা প্রকৌশলীর মৃত্যু, অগ্নিদগ্ধ ৬
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
নারিনকে ছাপিয়ে বাটলার ঝড়ে রাজস্থানের অবিশ্বাস্য জয়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ