X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

ভারতের রাষ্ট্রপতি নিয়ে কিছু কথা

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২৭ জুলাই ২০১৭, ১৪:৩৫আপডেট : ২৭ জুলাই ২০১৭, ১৬:৪৯

 

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী জাতিভ্রষ্ট লোকদের মহাত্মা গান্ধী নাম দিয়েছিলেন ‘হরিজন’। মানে ‘ভগবানের পুত্র’। তিনি একটা পত্রিকাও প্রকাশ করতেন তার নামও দিয়েছিলেন ‘হরিজন’। মহাত্মা গান্ধীর মতো একজন খ্যাতিসম্পন্ন মহান নেতা দিল্লির দাঙ্গর মহল্লায় এই জাতহীন লোকদের সঙ্গে রাত্রিযাপন করে খাওয়া-দাওয়া করা, তাদের মল পরিষ্কার করা, সহজ সরল কথা নয়। মেথর, চামার, মুচি, চণ্ডাল, কর্মকার, জেলে; এরাই জাতহীন সম্প্রদায়।
ভারতের বর্তমান লোক সংখ্যা ১২০কোটি। তার মাঝে জাতিভ্রষ্ট ও নিম্নজাতের হিন্দুর সংখ্যা ৩৪ কোটি। যে জাতির ৩৪ কোটি সন্তান অস্পৃশ্য থেকে যায় সমাজে যদি তাদের কোনও স্থান হয় না, তাহলে সে জাতির উন্নতি হয় কিভাবে, এই সত্যটা মহাত্মা গান্ধী হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি তার জীবনের মূল্যবান সময় কাটিয়েছেন হরিজনদের মনে সাহস সঞ্চার করে ওপরে টেনে তোলার কাজে। এমন এক সময় ছিল জাতহীনরা নগরে প্রবেশ করলে কাঠের ডফ বাজিয়ে প্রবেশ করতে হতো। ইউরোপে এমন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল কুষ্ঠরোগীর ব্যাপারে। কাঠের করতাল বাজিয়ে এক সময় ইউরোপে কুষ্ঠরোগীকে নগরে পথ চলতে হতো।
জাতিভেদ প্রথা এত নিকৃষ্টরূপ নিয়েছিল যে, জাতিভ্রষ্টদের মাঝেও উঁচু-নিচু প্রথা ছিল। পাঁচ কড়ি দাস আর তিন কড়ি দাস এক কথা নয়, যদিও বা তারা উভয়ে জাতিভ্রষ্ট তালিকার অন্তর্ভুক্ত। জাতিভ্রষ্টদের জাতিভেদ প্রথায় চণ্ডাল ছিল সবার চেয়ে নিকৃষ্ট। চণ্ডালের কাজ ছিল মৃতদেহ পোড়ানো। বাজার থেকে কিনে কোনও কাপড় পরার অধিকার ছিল না চণ্ডালদের। কোনও ব্যক্তি মরার সময় যে কাপড় পরে মরেছে, তার সেই পরিত্যক্ত কাপড়ই তাদের পরতে হতো।
আবার বিখ্যাত ব্রিটিশ পণ্ডিত আর্থার লিওয়েলিন বাশামের বই ‘দ্য ওয়ান্ডার দ্যাট ওয়াজ ইন্ডিয়া’য় পড়েছি মনুর ভাষ্য অনুসারে জাতিচ্যুতদের মাঝে সবচেয়ে নিকৃষ্ট সম্প্রদায় হচ্ছে ‘অন্ত্যাবসায়ী’ সম্প্রদায়। তারা কোনও নগরে প্রবেশ করতে পারতো না। আর পরিপূর্ণ কাপড় পরারও তাদের কোনও অধিকার ছিল না। লেংটি ছিল তাদের ভূষণ।
এবার ভারতের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন রামনাথ কোবিন্দ। ২৫ জুলাই তিনি শপথ নিয়েছেন। তিনি উত্তর প্রদেশের লোক, জাতে চণ্ডাল, পেশায় উকিল। তিনি ছিলেন ভারতীয় জনতা পার্টির প্রার্থী। তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কংগ্রেস প্রার্থী মীরা কুমারী। তিনিও জাতে মুচি, পেশায় উকিল। তারা উভয়ে জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের লোক। জাতিচ্যুতদের বর্ণ তালিকায় কে বড় কে ছোট জানি না। মীরা গত লোকসভায় স্পিকার ছিলেন। তিনি বিহারের সাসারাম থেকে পাঁচ বার লোকসভার সদস্য হয়েছেন। তার বাবা জগজীবন রামও ছিলেন বিখ্যাত নেতা। ১৯৪৬ সাল থেকে ইন্দিরা গান্ধীর সময় পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন। জাতিচ্যুতদের মাঝে গত শতকে অম্বেৎকর ও জগজীবনই ছিলেন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি।
অম্বেৎকর ছিলেন ভারতের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি অবশ্য কিছুদিন নেহরু মন্ত্রিসভার সদস্যও ছিলেন। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতীও জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের সন্তান। তিনি দুই-দুই বার উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তিনি জাতিচ্যুতদের মাঝে মেথর সম্প্রদায়ের কন্যা। দিল্লির দাঙ্গর পল্লীতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, যে পল্লীতে মহাত্মা গান্ধী বহু রজনী যাপন করেছিলেন। খুবই পরিতাপের বিষয় এই ভুঁইফোড় রাজনৈতিক নেতা মায়াবতী একবার মহাত্মাকে ‘শয়তানের সন্তান’বলতে দ্বিধা করেননি। আসলে চিরকাল মাঝারীরা মহৎ মানুষদের নিজেদের মাপে ছোট ছোট করতে চায়। অথচ রবীন্দ্রনাথ তাকে মহাত্মা বলেছেন, নেহরু তাকে সক্রেটিস বলে আখ্যায়িত করেছেন আর সুভাষ বসু তাকে জাতির পিতা বলেছিলেন।
আম্বেৎকরও মহাত্মার সঙ্গে কম গণ্ডগোল পাকাননি। অথচ মহাত্মার সযত্ন প্রয়াসের ফলেই জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের মাঝে লেখাপড়া শেখার উৎসাহ জেগে ছিল। যে কারণে জগজীবন রাম, অম্বেৎকর, মায়াবতী, মীরা কুমারী, রামনাথ কোবিন্দ, কে আর নারায়ণ প্রমুখের উত্থান হয়েছিল। গান্ধী সারাজীবন জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায়কে জাগিয়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করে কাজ করেছেন আর অম্বেৎকর তার সম্প্রদায়ের প্রতি নিজের কর্তব্যের কথা বিস্মৃত হয়ে হিন্দুদের প্রতি অভিমান করে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। অম্বেৎকরের জীবনে এটা চূড়ান্ত পরাজয়। মহাত্মা সারাজীবন ভেদাভেদ রহিত করার কাজে কাজ করেছেন কারণ তিনি মনে করতেন মুক্তির পথ মানুষে ঐক্য সাধনায় ভেদাভেদে নয়।
গান্ধী নেহরু ও পেটেলকে বলেছিলেন, একজন দলিত সম্প্রদায়ের কন্যাকে ‘তোমারা ভারতের রাষ্ট্রপতি করিও’। গান্ধী জীবিত থাকলে কী হতো জানি না, তবে ১৯৫০ সালে প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাজেন্দ্র প্রসাদই ভারতের প্রথম নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। দলিত সম্প্রদায়ের প্রতি যে মমত্মবোধ গান্ধী দেখিয়েছেন তা ভারতের ইতিহাসে চিরদিন স্মরণযোগ্য ঘটনা।
ভারতে প্রতিটি আশ্রমে ঠাকুরেরা পাচক হিসেবে কাজ করে। এমন কী হোটেলেও। কারণ এইসব স্থানে সব জাতের লোকের আনাগোনা হয়। যেন খেতে কারও অরুচি না হয়। কলকাতা থেকে মেটিয়াবুরুজ যাওয়ার রাস্তায় এক হোটেলে ভাত খেয়েছিলাম। হোটেলের সাইন বোর্ডে লেখাছিলো ‘ওকে পাইচ হোটেল-বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণের পাক’। কিন্তু গান্ধীর সমরমতি আশ্রমের রসাইখানার পাচক গোষ্ঠী ছিল দলিত সম্প্রদায়ের লোক। যে কারণে অনেক কংগ্রেস নেতাও তার আশ্রমে খেতে চাইতেন না। কথিত আছে মহাত্মা গান্ধীর বেয়াই রাজা গোপালাচারী নাকি সমরমতি আশ্রমে কখনও একগ্লাস জলও পান করেননি। কারণ তিনি ছিলেন দক্ষিণের উচ্চ জাতের ঠাকুর।
এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মীরা কুমারী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে মহাত্মা গান্ধীর স্বপ্ন পূর্ণ হতো কারণ পূর্বেই বলেছি মীরা কুমারী দলিত কন্যা। এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ভারতের পঞ্চদশ রাষ্ট্রপতির নির্বাচন। এর আগের রাষ্ট্রপতিরা হচ্ছেন, ১) রাজেন্দ্র প্রসাদ, ২) সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণ, ৩) ড. জাকির হোসেন, ৪) ভি ভি গিরি , ৫) ফখরুদ্দীন আলী আহমেদ, ৬) নিলাম সজ্জীব রেড্ডী, ৭) জ্ঞানী জৈল সিং, ৮) আর. ভেনকটারামন, ৯) শংকর দয়াল শর্মা, ১০) কে. আর. নারায়ণ, ১১) এপিজে আব্দুল কালাম, ১২) প্রতিভা পাতিল, এবং ১৩) প্রবণ মুখার্জী।
ভারতের রাষ্ট্রপতিদের মাঝে রামনাথ কোবিন্দ প্রথম দলিত সম্প্রদায় থেকে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি নন, একাদশ রাষ্ট্রপতি কেআর নারায়ণও দলিত সম্প্রদায়ের সন্তান। কেরেলা রাজ্যে তার বাড়ি। তার বাবা নারিকেল গাছের মাথা পরিষ্কার করার কাজ করতেন। সমুদ্র উপকূলবর্তী কেরেলা রাজ্যে নারিকেলের বাগান বেশি। প্রাচীনকাল থেকে নারিকেল গাছের মাথা পরিষ্কার করার কিছু পেশাদার লোক ছিল। এ ছোট সম্প্রদায়টাও জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
কে আর নারায়ণ লন্ডনে লেখাপড়া করেছিলেন। অধ্যাপক লাস্কি তার শিক্ষক ছিলেন। লেখাপড়া শেষে ভারতের ফিরে আসার সময় নেহরুকে নারায়ণ মারফত একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন লাস্কি। চিঠি পৌঁছাতে গিয়ে কেআর নারায়ণের সঙ্গে নেহরুর পরিচয়। নেহরু তাকে একটা মামুলি আইসিএস পরীক্ষা দিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র বিভাগে যোগদানের অনুরোধ করেছিলেন। কে আর নারায়ণ নেহরুর অনুরোধ রক্ষা করে পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। প্রতিভাবান লোক সচিব পর্যন্ত হয়েছিলেন। অবসরে আসার পর কংগ্রেস তাকে রাষ্ট্রপতি করেছিল।
নরেন্দ্র মোদিকে বর্তমান ভারতের নব্য-চাণক্য বলাই উত্তম। ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে তিনি খুবই কৌশলী লোক। উত্তর প্রদেশে জাতিভ্রষ্টদের নেতা হচ্ছেন মায়াবতী। আর নিম্নবর্ণের হিন্দু অর্থাৎ উত্তর প্রদেশের বিরাট গোয়ালা সম্প্রদায়ের নেতা হচ্ছেন অখিলেশ যাদব। যাদবেরা গোয়ালা। উত্তর প্রদেশে জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায় আর মুসলমানের মাঝে সমঝোতা হলে মায়াবতী মুখ্যমন্ত্রী হন। যাদব আর মুসলমানের মাঝে সম্মিলন হলে অখিলেশ যাদব মুখ্যমন্ত্রী হন। এবারে উত্তর প্রদেশ বিধানসভার নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি খুব সফলতার সঙ্গে জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায়ের ভোটারদের মাঝে ভাঙন ধরাতে পেরেছেন। রামনাথ কোবিন্দকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করে তিনি জাতিভ্রষ্ট সম্প্রদায়কে তুষ্ট করলেন সম্ভবত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের কথা চিন্তা করে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা প্যাকেজ পাস
মার্কিন কংগ্রেসে ইউক্রেনের বহুল প্রতীক্ষিত সহায়তা প্যাকেজ পাস
এক্সপ্রেসওয়েতে বাস উল্টে প্রাণ গেলো একজনের, আহত ১০
এক্সপ্রেসওয়েতে বাস উল্টে প্রাণ গেলো একজনের, আহত ১০
বেসিস নির্বাচনে ১১ পদে প্রার্থী ৩৩ জন
বেসিস নির্বাচনে ১১ পদে প্রার্থী ৩৩ জন
সিঙ্গাপুরে রডচাপায় বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যু
সিঙ্গাপুরে রডচাপায় বাংলাদেশি তরুণের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ