X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

রাজনীতির বিদেশমুখিতা

বিভুরঞ্জন সরকার
২৮ জুলাই ২০১৭, ১২:০০আপডেট : ২৯ জুলাই ২০১৭, ১৩:৪৮

বিভুরঞ্জন সরকার আমাদের রাজনীতিতে ‘বিদেশি কানেকশন’ নতুন কিছু নয়। ক্ষমতায় যেতে, থাকতে বিদেশি সমর্থন-সহযোগিতার কথা বিভিন্ন সময়েই শোনা গেছে। সাম্প্রতিক দু'টি ঘটনায় আবার রাজনীতিতে বিদেশ প্রসঙ্গ সানে এসেছে।

ঘটনা – এক  

প্রায় দুই মাসের জন্য চিকিৎসা ও সন্তান দর্শনের জন্য লন্ডন গিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এই দুই মাস দল কিভাবে চলবে তার একটি দিকনির্দেশনা তিনি দিয়ে গেছেন স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। লন্ডন থেকেই তিনি দল চালাবেন – এজন্য তাকে নিয়মিত খবরাখবর দেওয়ার জন্য কয়েক জনকে দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। কিন্তু এই সৌভাগ্যবান ব্যক্তিরা কারা যাদের খবরাখবর দেওয়ার দায়িত্ব দিয়ে গেছেন? কোনও গণমাধ্যমে কি তাদের নাম ছাপা হয়েছে? আমার নজরে পড়েনি। বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডা. জাফরউল্লাহ চৌধুরী বলছেন, বেগম খালেদা জিয়া দলের কাউকে বিশ্বাস করেন না বলেই কাউকে নির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব দিয়ে যাননি। ডা. জাফরউল্লাহর বক্তব্য সত্য হতে পারে, আবার অনুমান-নির্ভরও হতে পারে। তবে তিনি যেহেতু বেগম জিয়ার ঘনিষ্ট, কাজেই তিনি হয়তো তার মনের কথা জানলেও জানতে পারেন। দলের সিনিয়র নেতাদের যে বেগম জিয়া খুব একটা বিশ্বাস করেন তা না, সেটা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ কম। তাদের যদি তিনি বিশ্বাস করতেন বা আস্থায় নিতেন তাহলে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেন। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে লন্ডনে অবস্থানরত পুত্রের কাছে যেতে হতো না। 

বিএনপির ভবিষ্যৎ নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের আলোচনা আছে। যারা সরাসরি বিএনপি করেন, বিএনপির কোনও কমিটিতে আছেন, তারা দল নিয়ে খুব আশাবাদী। তারা মনে করেন, আগামী নির্বাচন ‘সহায়ক' সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলে বিএনপির ক্ষমতায় যাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না। অর্থাৎ বিএনপির অফিসিয়াল নেতাদের কাছে তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার প্রধান অন্তরায় সহায়ক সরকার। তাদের এই সহায়ক সরকারের দাবি বর্তমান সরকার, শেখ হাসিনার সরকার মানবে কি? সরকারি তরফ থেকে খুব জোরের সঙ্গেই শুরু থেকে বলা হচ্ছে যে নির্বাচন শেখ হাসিনার সরকারের অধীনেই হবে। সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আবার বেগম জিয়াও বারবার বলছেন, শেখ হাসিনার অধীনে নয়, আগামী নির্বাচন সহায়ক সরকারের অধীনেই হবে। তিনি কিসের ভিত্তিতে এমন কথা বলেন, তা রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছেও স্পষ্ট নয়। সহায়ক সরকারের দাবি দুই উপায়ে অর্জন করা যেতে পারে। এক.  আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে উভয় পক্ষ সমঝোতায় পৌ্ঁছলে। দুই. ব্যাপক গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করতে পারলে। দুইটির কোনোটাই খুব সহজে আদায়যোগ্য বলে মনে হয় না। 

আলোচনার ব্যাপারে বিএনপির প্রবল আগ্রহ আছে বলে মনে হয় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিক বার বলছেন, আলোচনায় বসলেই একটি সমাধানসূত্র বেরিয়ে আসবে। বিএনপির আইনজীবী নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেছেন, রাজনৈতিক ভাবে একমত হলে সংবিধান কোনও সমস্যা হবে না। বিএনপির দিক থেকে দেখলে এসব যুক্তি ঠিক আছে। কিন্তু সরকার বা আওয়ামী লীগ কেন বিএনপিকে সহায়তা করবে? বিএনপি কি কখনও কোনও বিষয়ে সরকারকে, আওয়ামী লীগকে সহযোগিতা করেছে? বিএনপিকে ক্ষমতায় বসানোর দায়িত্ব আওয়ামী লীগ কেন নেবে? দুই দলের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক এতটা মধুর নয় যে, কোনও রাজনৈতিক ইস্যুতে তারা গলাগলি করে পথ হাঁটবে।

হয়তো বলা হবে, দেশে একটি গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন করতে হলে বিএনপির অংশ গ্রহণ জরুরি। বিএনপি যদি নির্বাচন থেকে দূরে থাকে এবং অন্য সব দলই নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলেই সে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কারণ দেশের একটি বড় জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করে বিএনপি। কাজেই বিএনপিকে নির্বাচনে আনার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু  সরকার সে রকম মনে করে বলে কোনও কিছু থেকেই মনে হয় না। সরকার যদি তার অবস্থান দুর্বল বা নাজুক মনে করে কেবল তখনই আসবে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা বা সমঝোতার প্রশ্ন। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বা বিশ্লেষকরা কি মনে করেন যে সরকার দেশে কিংবা বিদেশে বেকায়দায় আছে?

এরপর আসে আন্দোলনের প্রশ্ন। বিএনপির বর্তমান যে সাংগঠনিক অবস্থা তাতে সরকারকে চাপে ফেলার মতো কোনও আন্দোলন গড়ে তোলা এই দলের পক্ষে সম্ভব বলে বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষীরাও মনে করেন না। বিএনপির আন্দোলন রেকর্ড খুব খারাপ। আন্দোলন করে তারা শেখ হাসিনার সরকারের কাছ থেকে কোনও দাবি আদায় করতে পারেনি। এবার পারবে ‘সেরকম বিশ্বাসের কারণ কি? সব থেকে বড় বিষয়, বিএনপির সামনে একটি খাঁড়া ঝুলছে’ বেগম জিয়ার মামলা। বেগম জিয়া যদি কারাগারে যান, তাহলে দল কি সবদিক সামাল দিয়ে চলতে পারবে? সে অবস্থায় দলের নেতৃত্ব দেবেন কে? লন্ডন যাওয়ার সময় বিশ্বাস করে কাউকে দায়িত্ব দিতে পারেন না। জেলে গেলে কী হবে?

বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমান লন্ডনে বসে দল চালাচ্ছেন। মা জেলে থাকলে তার পক্ষে হুকুমনামা জারি করা কি সহজ হবে? বিএনপি নেতাদের বাস্তবের মাটিতে পা রেখে চলতে হব। স্বপ্নঘোরে থাকলে হবে না। কোনও রাজনৈতিক ইস্যুই সমাধান না করে ঝুলিয়ে রাখা বিএনপির একটি কৌশল। জামায়ত ইস্যু নিষ্পত্তি হয়নি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান ঝুলন্ত। বঙ্গবন্ধুর স্বীকৃতি নিয়েও তারা কেবল সিদ্ধান্তহীন নয়, বরং জিয়াকে বঙ্গবন্ধুর জায়গায় প্রতিস্থাপনের এক ছেলেমানুষী খেলায় বিএনপি মেতে আছে। ১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনের প্রতিহিংসাপরায়ণতা থেকেও বিএনপি সরে আসছে না। বিএনপিকে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার জন্য কেবল আওয়ামী লীগ ও ভারতবিরোধিতার রাজনীতি আর যথেষ্ট নয়।  

ঘটনা -- দুই.

‘পতিত স্বৈরাচার’ হিসেবে রাজনৈতিক মহলে যিনি পরিচিত, প্রবল গণআন্দোলনের মাধ্যমে যাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়ছিল সেই হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন পর্যন্ত প্রাসঙ্গিক আছেন - এটা বিস্ময়ের ও লজ্জার। এরশাদ তার ক্যারিশমার কারণে যতটুকু না তারচেয়ে বেশি নীতিহীনতার রাজনীতি চর্চার কারণে এখন পর্যন্ত রাজনীতিতে টিকে আছেন। আমাদের রাজনীতির বিস্ময় এটাই যে যারা এরশাদকে ক্ষমতা থেকে টেনে নামানোর জন্য একতাবদ্ধ হয়েছিলেন, তারাই তার ক্ষমতা হারানোর পর তাকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার মিশন সফল করেছেন। এখন এরশাদ আওয়ামী লীগ সরকারের পার্টনার হয়েছেন বলে আমরা আওয়ামী লীগকে গালমন্দ করতেই পারি। কিন্তু  না, এরশাদ পুনর্বাসনের কাজটি প্রথম শুরু করেছিল বিএনপি। ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার জন্য নীতিহীনতার পথ বিএনপি কেবল আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপিও করে থাকে। এরশাদকে নিয়ে রাজনীতি করে বিএনপির যদি না যায় তাহলে আওয়ামী লীগের কেন যাবে’ এই সহজ যুক্তিতে এরশাদ রাজনীতিতে পেন্ডুলামের মতো দোল খাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, কুঁজোর চিৎ হয়ে শোয়ার শখের মতো এরশাদ আবার ক্ষমতায় যাওয়ার শখও পোষণ করেন।

মাঝে মাঝেই তিনি দেশবাসীকে জানান দেন যে, তার দল জাতীয় পার্টি আবার ক্ষমতায় আসবে। নিজের দলের শক্তি-সামর্থ সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা থাকলে এরশাদ এভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার খোয়াব দেখতেন না। এরশাদের নিজের জেলা রংপুরে জাতীয় পার্টির একটা শক্ত ভিত্তি ছিল। কিন্তু তার ক্রমাগত ডিগবাজির রাজনীতি সেই ভিত্তি তছনছ করে দিয়েছে। এরশাদের অবস্থা এখন না-ঘরকা না-ঘাটকা। তার রাজনীতি আসলে এককভাবে ক্ষমতায় যাওয়ার নয়। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো এরশাদকে এখন ক্ষমতার সিঁড়ি হয়েই তৃপ্ত থাকতে হবে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। তার দলের তিনজন মন্ত্রী। তার স্ত্রী সংসদে অনুগত বিরোধীদলীয় নেত্রী। পরের নির্বাচনে এই অবস্থাটুকু ধরে রাখতে পারলেইতো যথেষ্ট। বার্গেনিং কৌশল হিসেবেই হয়তো তিনি তার দলকে মানুষ ক্ষমতায় দেখতে চায় বলে হুংকার ছাড়েন। 

রাজনীতির বাজারে নিজের দাম বাড়ানোর জন্য এরশাদ বিভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকেন। তিনি যেহেতু ক্ষমতা-জবর দখলকারী রাষ্ট্রপতি ছিলেন, সেহেতু ক্ষমতার অন্ধিসন্ধি তার অজানা নয়। আমাদের দেশের রাজনীতি বিদেশি প্রভাবের কথাও তার অজানা নয়। তিনি তাই তার পুরনো বিদেশি কানেকশন ধরে রাখারও চেষ্টা করেন। সম্প্রতি এরশাদ পাঁচ দিনের সফরে ভারত গিয়েছিলেন। গত ২৩ জুলাই তিনি দেশে ফিরেছেন। তার দলের পক্ষ থেকে তাকে বিমান বন্দরে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। ঢাকা এবং ঢাকার আশেপাশের জেলাসমূহ থেকে জাপা নেতা-কর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সংবর্ধনা সভায় যোগ দেন। এটা বোঝা যায় যে, পরিকল্পিতভাবেই ওই সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। একটা শোডাউন করাই ছিল উদ্দেশ্য। সাবেক সামরিক শাসক এরশাদ বার বার প্রমাণ করতে চান যে তিনি একজন জনপ্রিয় মানুষ। দেশবাসী এখনও তাকে ভালোবাসে। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে এরশাদ বলছেন, দেশের মানুষের পাশাপাশি বিদেশি বন্ধুরাও জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতায় দেখতে চায়। জাতীয় পার্টি ক্ষমতার জন্য প্রস্তুত।

ভারতে গিয়ে এরশাদ কী করেছেন আমরা জানি না। তার সঙ্গে ভারতের ভলো সম্পর্ক নিয়ে কিছু জনশ্রুতি আছে। ভারতে কেউ কি তাকে এমন কোনও আশ্বাস দিয়েছেন যে, বাংলাদেশে তার এরশাদকেই ক্ষমতায় দেখতে চান। এ ধরনের সম্ভাবনা এখন পর্যন্ত কষ্টকল্পনা বলেই মনে হয়। এরশাদের স্বপ্নদোষের সমস্যা আছে। ক্ষমতা দখলের পর তিনি স্বপ্ন দেখতেন, তাকে এই মসজিদে গিয়ে জুমার নামাজ পড়তে হবে, ওই মাজার জিয়ারত করতে হবে। এখন ক্ষমতায় নেই। এখন তিনি স্বপ্ন দেখছেন আবার ক্ষমতায় যাওয়ার। বিদেশি বন্ধুদের বরাত দিয়ে এরশাদ যা বলছেন, তা কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হচ্ছে না। বিদেশি বন্ধুরা  জাতীয় পার্টিকে কিভাবে ক্ষমতায় দেখতে চায় এরশাদ সেটা খোলাসা করে বলেননি। তবে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে সংবর্ধনার আয়োজন করে তিনি যে নগরবাসীর অভিসম্পাৎ কুড়িয়েছেন  তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক ভাবেই প্রকাশ পেয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকেও জানা যায়, বিমান বন্দর সড়কের দুই পাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে জাপা নেতা-কর্মীরা অবস্থান নেওয়ায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। এ জন্য ওই পথে চলাচলকারী সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে। 

ক্ষতায় থাকতেও যেমন ক্ষমতার বাইরে থেকেও তেমনি- জনদুর্ভোগ আর এরশাদ যেন হাত ধরাধরি করে চলে।

 

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ