X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধর্ষকের লিঙ্গ এবং রাজনৈতিক ত্যাজ্যপুত্র

হারুন উর রশীদ
০১ আগস্ট ২০১৭, ১২:১১আপডেট : ০১ আগস্ট ২০১৭, ১৭:০৫

হারুন উর রশীদ লিঙ্গ বিষয়টি নিয়ে কোনও সংকীর্ণ ধারণা থেকে আমার এই কলাম নয়। তাই বলে রাখি, আমরা প্রচলিত অর্থে সাধারণভাবে লিঙ্গ বলতে যা বুঝি, তা যারা এই লেখায় খুঁজতে যাবেন তারা হতাশ হতে পারেন। পড়তে গিয়ে আকাঙ্ক্ষার জায়গাটি পূরণ নাও হতে পারে। আমার ওপর নাখোশও হতে পারেন। তাই আমি শুরুতেই আপনাদের একটু জানিয়ে রাখলাম। যাতে কেউ চাইলে প্রথমেই আমার লেখা বাতিল করে দিয়ে অন্য কোনও কাজে মনোযোগ দিতে পারেন।
১. লিঙ্গ বিষয়টি ক্ষমতার সঙ্গে জড়িত। এই ক্ষমতা যে রাজনৈতিক বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হতে হবে তা কিন্তু নয়। এই ক্ষমতা অর্থের হতে পারে, পদের হতে পারে। হতে পারে অস্ত্র অথবা প্রচলিত অন্ধ আস্থার। তবে ক্ষমতা থাকতে হবে। আর তা না থাকলে লিঙ্গের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে না। যদি ঘটেও যায় সেই লিঙ্গ কার্যকর লিঙ্গ হিসেবে প্রতিভাত হয় না।
২. ক্ষমতা থাকলে তার একটা বহিঃপ্রকাশও থাকে। এই বহিঃপ্রকাশ নানা ভাবে হতে পারে। কেউ দামি গাড়িতে চড়ে তার বিত্ত-বৈভবের প্রকাশ ঘটান। আবার কেউ প্রতিপক্ষকে দমন করে দেখাতে চান আমি কতটা ক্ষমতাবান। কেউ আবার ক্ষমতার জোরে যা খুশী তাই করেন। ক্ষমতার আরেকটি প্রকাশ ঘটে লিঙ্গের মাধ্যমে। লিঙ্গের প্রকাশ্য একটা দিক আছে। কিন্তু ফ্রয়েডের তত্ত্ব মানলে এর উৎপত্তি কিন্তু মাথায়। মাথায় যখন ক্ষমতার চাপ ভর করে তখন তার নানা প্রকাশ ঘটতে পারে। লিঙ্গেও তার একটা প্রকাশের সুযোগ আছে বা প্রকাশ হয়।
৩.ক্ষমতাবানদের গাড়ি-বাড়ি-বিদেশ ভ্রমণ বিলাসিতা এসব সব সময় যথেষ্ট নাও হতে পারে। তারা চান ক্ষমতার সব দিক বিকশিত হোক। সেই বিকাশ কেউ ঘটান পরিমিত ভাবে। আমরা তখন তাকে বলি সভ্য। আর কেউ সভ্য না হয়ে ক্ষমতাবান হলে তার প্রকাশ ঘটে উগ্র এবং অশ্লিলভাবে। তারা তখন লিঙ্গ গোপন না রেখে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। স্থান-কাল-পাত্র ভুলে যায়। শুরু হয় ক্ষমতাবানের লিঙ্গ সন্ত্রাস। আর যখন তারা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অধিক ক্ষমতাবানদের রোষানলে পড়ে যায় তখন আমরা তাদের চিনতে পারি। জানতে পারি ধর্ষকের লিঙ্গ সম্পর্কে।
৪. সন্ত্রাস দুর্নীতিও ক্ষমতার আরেক প্রকাশ। যার হাতে ক্ষমতা নেই তার পক্ষে দুর্নীতি করা প্রায় অসম্ভব। আর সন্ত্রাসের নেপথ্যেও থাকে ক্ষমতা। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, লিঙ্গ সন্ত্রাস এসব কিছুই ক্ষমতার অপর পিঠ।

৫. আমরা ক্ষমতার নানা ভরকেন্দ্র বা উৎসের কথা জানি। কারোর মনে হতে পারে বেশি ক্ষমতা পুলিশের। কেউ মনে করতে পারেন প্রশাসনের বড় কর্তার। পুঁজিপতির ক্ষমতাকেও কেউ বড় করে দেখতে পারেন। কিন্তু  আসল ক্ষমতা রাজনীতির। রাজনীতিই শেষ পর্যন্ত সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। চূড়ান্ত বিচারে ক্ষমতাসীন রাজনীতি চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী।  

কিছু তাত্ত্বিক আলোচনা হলো। আমার এই তত্ত্ব যে সর্ব স্বীকৃত তাও নয়। এটা আমার এক ধরনের নিজস্ব বিশ্লেষণ। বিশ্লেষণ একজন সাংবাদিক, একজন নাগরিক হিসেবে। এর মধ্যে আপত্তি থাকতে পারে। কারণ সমাজতত্ত্বের আদর্শ থিওরি মেনেও আমি এই বিশ্লেষণ করছি না। আর ক্ষমতাবান বলছি বটে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে এটা সব ক্ষমতাবানের জন্য প্রযোজ্য। যারা প্রকাশিত হয়েছেন। যাদের ত্যাজ্য করা হয়েছে। এটা তাদের জন্য।
এক. বগুড়ার তুফান এখন দেশজুড়েই তুফান তুলেছে। তুফান ২০১৫ সালে দুই বস্তা ফেনসিডিলসহ র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছিল। ছাড়া পেয়ে তুফান শ্রমিক লীগে যোগ দেয়। এপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সে নাকি দুই বছরেই কোটিপতি হয়ে যায়। রাজনীতির ক্ষমতায় সে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। আর ক্ষমতার চর্চার একটি দিক হলো লিঙ্গ চর্চা, যা আগেই বলেছি। সে শুধু সেটা করেই ক্ষান্ত হয়নি, ধর্ষণের পর তরুণী ও তার মায়ের মাথা ন্যাড়া করে দিয়ে ২০ মিনিটের মধ্যে বগুড়া শহর ছেড়ে চলে যেতে নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু রাজনীতিতে তারচেয়েও ক্ষমতাবান আছে। তারা বিব্রত হয়েছেন। তুফানের লিঙ্গ সন্ত্রাস তাদের অস্বস্তিতে ফেলেছে। কারণ সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ হওয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতার স্বার্থেই তাকে দল থেকে ছুড়ে ফেলা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। তাই তুফান ও তার সহযোগিরা আটক হয়েছে। শ্রমিক লীগের কমিটি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। রাজনৈতিকভাবে তাকে ত্যাজ্য করা হয়েছে। 

দুই. সিলেটে ছাত্রলীগ নেতা বদরুল প্রেম প্রত্যাখ্যাত হয়ে খাদিজা আক্তার নারগিসকে কুপিয়ে হত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু নারগিস প্রাণে বেঁচে গেছেন। বদরুল কারাগারে। যাবজ্জীবন জেল হয়েছে। মনে হতে পারে অপরাধীতো ধরা পড়েছে। সাজা পেয়েছে। কিন্তু বদরুল যে বছরের পর বছর নারগিসকে যৌন হয়রানি করে আসছিল তখন কিন্তু বদরুল ধরা পড়েনি। ছাত্রলীগ থেকে তাকে বহিষ্কারও করা হয়নি। যখন প্রকাশ্যে কোপানোর দৃশ্য ভাইরাল হলো তখন তাকে আর নিতে পারলো না দল। দলের স্বার্থেই ত্যাজ্য করা হলো। শুধু তাই নয় ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসার সময় নারগিসের সঙ্গে সেলফি তুলে প্রমাণ করতে হলো আমরা নারগিসরই লোক বদরুল আমাদের কেউ নয়। কিন্তু ত্যাজ্য করলেই কি অতীত সম্পর্ক নাই হয়ে যায়?

৩. বনানীর ধর্ষণের ঘটনায় সাফাত নাঈমরা কিন্তু প্রথমে ছাড়াই পেয়ে গিয়েছিল। তারা টাকার প্রভাবে লিঙ্গ সন্ত্রাস করতো আগে থেকেই। আর এই টাকায় তারা নিয়ন্ত্রণ করতো পুলিশসহ আরও অনেককে। সে কারণে সংবাদ মাধ্যমে খবর আসার আগে পুলিশ কর্মকর্তার কাছে দুই তরুণী ছিল ‘নষ্ট চরিত্রের’। কিন্তু যখন খবর প্রকাশ হয়ে পড়ে সংবাদ মাধ্যমে তখন ক্ষমতার উপরিকাঠামো ক্ষমতাকে নিষ্কলুষ রাখতেই তাদের আটক করে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এখানে ক্ষমতার জন্য কোনটা প্রয়োজন তা নির্ধারণ করা হয়েছে। ক্ষমতা প্রকাশের  লিঙ্গ সন্ত্রাসকে তাই ত্যাজ্য করা হয়েছে।  

৪. কুমিল্লার তনু ধর্ষণ এবং হত্যার ঘটনাও ক্ষমতার লৈঙ্গিক প্রকাশ। কিন্তু এখানে ওই লিঙ্গধর ক্ষমতাবানরা এখনও অপ্রকাশিত। ঘটনাটি ঘটেছিল ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মধ্যে। এলাকা জানা গেলেও লিঙ্গ পরিচয় অজানা। ধারণা করি এখানে লিঙ্গ এবং রাজনীতি সমান ক্ষমতাধর। ওই লিঙ্গকে ঘায়েল করা রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য হয়তো লাভ-লোকসানের হিসাবে পড়ে গেছে। তাই এখানে আমরা কাউকে গ্রেফতার বা ত্যাজ্য হতে এখনও দেখছি না।

চারটি ঘটনার চার ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে। কিন্তু কোনও ঘটনাই ক্ষমতা প্রকাশের লিঙ্গ সন্ত্রাসের বাইরে না। তাহলে কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন যাদের ক্ষমতা নাই তারা কি লিঙ্গ সন্ত্রাস বা ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত হয় না? আমার জবাব জড়িত হয়। কিন্তু এখানে ক্ষমতার আপেক্ষিক তত্ত্ব ব্যবহার করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। আমরা তুলনা করলে দেখবো আপেক্ষিকভাবে একজন নিম্নবিত্ত মানুষও ক্ষমতাবান তার শ্রেণিতে অন্যের তুলনায়। এখানেও তুলনামূলভাবে যার সম্পদ কম, রাজনৈতিক যোগাযোগ কম সেই লিঙ্গ সন্ত্রাসের শিকার হয়। এই ক্ষমতার বিষয়টি শারীরিক শক্তির বিবেচনায়ও দেখা যেতে পারে। যার শিকার হয় শিশুরা।

ত্যাজ্য করার আগে কোনও ক্ষমতাধরের লিঙ্গের ক্ষমতাতো রাজনীতি বা সামাজিক কারণেই বাড়তে থাকে। বিকশিত হয় ক্ষমতা প্রকাশের লৈঙ্গিক দিক। তাহলে দল থেকে বহিষ্কার করলে বা ত্যাজ্য করলেই কি সব দায় এড়ানো যাবে? রাজনীতি বা সামাজিক শক্তি প্রকাশে লিঙ্গ চর্চার যে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা কি দূর হবে?

আমাদের রাষ্ট্র, রাজনীতি এবং সমাজে ক্ষমতার অনৈতিক চর্চা যতদিন থাকবে ততদিন ক্ষমতাধরদের একাংশ ক্ষমতার প্রকাশ ঘটাতে লিঙ্গ ব্যবহার করবেই। এর মধ্যে ক্ষমতা কাঠামোর বিবেচনায় যেটা দুর্বল লিঙ্গ সেটা ধরা পড়বে। কিন্তু অনেক লিঙ্গই থেকে যাবে অধরা। অনেক লিঙ্গই আছে যাদের ত্যাজ্য করা যাবে না।

লেখক: সাংবাদিক

ইমেইল: [email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
বাসের পেছনের অংশ খোয়া যাচ্ছে কেন?
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ