X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার রায়: ‘এটা বিচার না খেলা’

চিররঞ্জন সরকার
০৭ আগস্ট ২০১৭, ১২:৫৫আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০১৭, ১২:৫৭

চিররঞ্জন সরকার মামলার রায়ে ক্ষুব্ধ-বিস্মিত বিশ্বজিতের ভাই উত্তম দাস। চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলায় রায় ঘোষণার পরপরই এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, ‘এটা কেমন রায় হলো! এমনটা তো আমরা চাইনি। এটা বিচার না খেলা? আগের আদালত আট জনকে ফাঁসি দিলো। আর এখন দিলো মাত্র দুই জনকে। তাহলে আগের বিচারক কী দেখে রায় দিলেন?’ এটা শুধু উত্তম দাসেরই প্রতিক্রিয়া নয়, দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন সব মানুষেরই প্রতিক্রিয়া!
নিম্ন আদালতের সঙ্গে উচ্চ আদালতের রায়ের পার্থক্য তুলে ধরে দেশের অধিকাংশ মানুষের মতো বিস্ময় প্রকাশ করে উত্তম দাস যথার্থই বলেছেন, ‘দুই রায়ে এত পার্থক্য হয় কিভাবে! এখন দেখি চারজনকে খালাসও দেওয়া হয়েছে। তার মানে এই চারজন জড়িত ছিল না।’ সেদিনের সেই মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেছেন, ‘এখানে তো লুকোচুরি করার কিছু নাই। সাক্ষী-প্রমাণ বানানো বা সাজানোও নয়। সব চোখের দেখা, বাস্তবের মতো। ভিডিও ফুটেজ আছে, ছবি আছে। তারপরও দুই রায়ে এত বেশ কম!’
বিষয়টি সত্যি আমাদের ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও হতাশ করেছে। এ কেমন রায়? ন্যায়বিচার পাওয়া দেশের প্রতিটি নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু বিশ্বজিতের পরিবার কি ন্যায় বিচার পেয়েছেন? যদি না পেয়ে থাকেন, তবে এর জন্য দায়ী কে? দায়ীরা কি কোনও দিন চিহ্নিত হবে? শাস্তি ভোগ করবে? নাকি সুষ্ঠু বিচার না-পাওয়ায় হতাশায় নিমজ্জিত বিশ্বজিতের বাবা-মার চোখের জলই কেবল সার হবে?
এমনিতেই বিশ্বজিৎ হত্যার ঘটনায় আট ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর ফাঁসির রায়ের ওপর আপিলের শুনানি চার বছর ধরে ঝুলে ছিল। ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪-এর বিচারক এ বি এম নিজামুল হক বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ২১ আসামির মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পান বাকি ১৩ জন। আশা করা হয়েছিল, এই পৈশাচিক খুনের জন্য নিম্ন আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত এই ২১ জনকে যারা ডেকে এনেছিল, যারা নির্দেশ দিয়েছিল, যেসব পুলিশ সদস্য কর্তব্য পালন না করে দাঁড়িয়ে এই নির্মম হত্যা-উৎসব উপভোগ করেছিল, আদালত তাদেরকেও দোষী সাব্যস্ত করবে। তাদেরও শাস্তির আওতায় আনবে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা তো গ্রহণ করা হলোই না, উল্টো বিচারিক আদালতে দণ্ডপ্রাপ্ত অনেকের সাজা কমিয়ে দেওয়া হলো। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া দুজনকে খালাস দেওয়া হলো। মাত্র দুজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে, চারজনের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন। এই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজন ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ১১ জন পলাতক। তার মানে এত নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরও কারোরই ফাঁসি হচ্ছে না? আর যারা ভেতরে আছে, কিছুদিন পরে তারাও যদি রাষ্ট্রপতির করুণা-ভিক্ষা জুটিয়ে বের হয়ে আসে, তাতেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!
অভিযুক্তরা সবাই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট থাকায় এ সংশয় প্রবল ছিল যে, আইনের ফাঁকফোকরে তারা ছাড় পেয়ে যেতে পারে। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কাই সত্য প্রমাণিত হতে চলেছে। সত্যিই কী আসামিরা সবাই ছাত্রলীগের সদস্য বলে এমনটা হলো? তাহলে ‘ন্যায়বিচার’ কোথায় থাকলো? কোথায় থাকলো সাংবিধানিক ঘোষণা: আইনের চোখে সকলে সমান? সরকারের কর্তাব্যক্তিরা বিচারের নামে এই প্রহসনের জবাব কি দেবেন?

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর পুরনো ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে বিশ্বজিৎ দাসকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যার পরদিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিও ফুটেজ দেখে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ওই ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেন। কিন্তু শুরু থেকেই পুলিশি তৎপরতায় গাফিলতি লক্ষ করা যায়। তারা মাত্র সাত অভিযুক্ত আসামিকে গ্রেফতার করে। এরপর তদন্ত প্রতিবিদেন নিয়ে শুরু হয় টালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ। স্বাভাবিক নিয়মে এই হত্যাকাণ্ডের যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা, সেটা দিতে পুলিশ ব্যর্থ হয়েছে, ঘটনার সঙ্গে ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনেও মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত দেশের উচ্চ আদালতকে এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে, পুলিশকে দ্রুত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। অবশেষে আদালতের নির্দেশে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ২১ জন কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় ডিবি পুলিশ। কিন্তু ফাঁক-ফোঁকরগুলো রয়েই যায়। এই মামলাটির ক্ষেত্রে সরকারি চিকিৎসক, আইন কর্মকর্তা, পুলিশসহ সংশ্লিষ্ট সকলে এক ধরনের দায়িত্বহীন খামখেয়ালী আচরণ করেছেন। আলামত সংগ্রহ, সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির এবং অভিযোগনামা তৈরিতে চরম গাফিলতি লক্ষ করা গেছে।

একথা ঠিক বিজ্ঞ আদালতের বিচারকগণ সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দেন। মামলায় পর্যাপ্ত পরিমাণে দালিলিক তথ্য-প্রমাণ না থাকলে এবং ফাঁক-ফোঁকর থাকলে বিচারকগণের তেমন কিছু করার থাকে না। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অত্যন্ত দক্ষতা ও সতর্কতার সঙ্গে মামলাটি পরিচালনা করা উচিত ছিল। এর দায় কি সরকার ও সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এড়াতে পারবেন?

আদালতও রায়ে বলেছে, “এটা পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড না হলেও আসামিদের সম্মিলিত হামলার ফলেই বিশ্বজিতের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে ‘গাফিলতির’ কারণে নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজা হাই কোর্টে এসে কমে গেছে। সুরতহাল ও ময়নাতদন্তে আঘাতের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আসামিদের জবানবন্দি ও সাক্ষীদের বর্ণনার মিল পায়নি আদালত।

বিশ্বজিতের লাশের সুরতহাল করার ক্ষেত্রে সূত্রাপুর থানার এসআই জাহিদুল হকের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কি না- তা তদন্ত করে আইজিপিকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আর ময়নাতদন্ত করার ক্ষেত্রে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. মাহফুজুর রহমানের কোনও গাফিলতি ছিল কি না- তা তদন্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ডেন্টাল কাউন্সিলকে প্রতিবেদন দিতে বলেছে হাই কোর্ট।’’

তার মানে আদালতও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তাই সংশ্লিষ্টদের ভূমিকা তদন্ত করে দেখার কথা বলেছেন। এখন সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, আসামিদের জবানবন্দি ও সাক্ষীদের বর্ণনার যে গড়মিল, যার কারণে উচ্চ আদালতে রায় পাল্টে গেল, তার দায় কে নেবে? এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেই কি ব্যবস্থা নেয়া হবে? কে নেবে ব্যবস্থা? নাকি ক্ষমতার ভেল্কিতে পার পেয়ে যাবে সবাই?

মনে রাখা দরকার যে, বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড আমাদের দেশের রাজনীতিতে প্রচলিত চরম বর্বরতার এক দৃষ্টান্ত। কুপিয়ে কুপিয়ে বিশ্বজিৎকে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকাণ্ড দেখে স্তব্ধ হয়েছে গোটা জাতি। তাকে হত্যা করা হয়েছে প্রকাশ্য দিবালোকে। হত্যা শুধু বিশ্বজিৎকে করা হয়নি। হত্যা করা হয়েছে এদেশের শুভ বুদ্ধি বিবেক ও সুস্থ রাজনীতির ধারাকে। এমন মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করে সুস্থ-স্বাভাবিক প্রতিটি মানুষের মনে। ওই হতভাগ্য তরুণের অপরাধ ছিল, কয়েকটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের ডাকা অবরোধের দিনে শাঁখারীবাজারের কর্মস্থলে রওনা হওয়া। সে সময় বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একদল নেতাকর্মী তাকেই এ জন্য দায়ী করে প্রবল রোষ ও ক্ষোভে পৈশাচিক উপায়ে আঘাত করতে থাকে। জীবন বাঁচাতে বিশ্বজিৎ দাসের কাকুতি-মিনতি সন্ত্রাসীদের মন গলাতে পারেনি। সে সময়ের বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ, সন্ত্রাসীদের নিবৃত্ত করা দূরের কথা, মৃতপ্রায় অবস্থায় তাকে হাসপাতালে প্রেরণের মতো মানবিকতাও উপস্থিত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দেখাননি। এ নিয়ে পুলিশ সদর দফতর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করলেও হদিস মেলেনি সেই প্রতিবেদনের। বিশ্বজিৎ দাসকে এক রিকসাচালক মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে যান এবং সেখানে তার মৃত্যু হয়।

বিশ্বজিতের দুর্ভাগ্য, সে খুন হয়েছে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগ নামধারী কিছু সন্ত্রাসীর হাতে। সংবাদমাধ্যমে এই খুনের ভিডিও ও স্থিরচিত্র প্রকাশিত হয়েছে। কারা বিশ্বজিৎকে ধাওয়া করে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে, সবাই চিহ্নিত। এরপরও নানাভাবে অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা হয়েছে। বিচারিক আদালতের রায় যেটুকু আশার সঞ্চার করেছিল, উচ্চ আদালতের রায় চরম হতাশা সৃষ্টি করেছে।

একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব প্রাথমিকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আর সার্বিকভাবে সরকারের। কিন্তু বিশ্বজিৎকে সরকার সমর্থক ছাত্রলীগের গুন্ডারা প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যা করেছে। ঘটনার খুব কাছাকাছি থাকা পুলিশ বিশ্বজিৎকে বাঁচাতে পারেনি, সেই ব্যর্থতা ঢাকার বড় উপায় ছিল এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সর্বোচ্চ উদ্যোগ গ্রহণ। কিন্তু সরকারি চিকিৎসক, তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সকলে তা করতে ক্ষমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।

এখনও সব কিছু শেষ হয়ে যায়নি। হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। যে ফাঁক-ফোঁকরের কারণে অভিযুক্ত খুনিরা সুযোগ নিয়েছেন, সেসব ফাঁক-ফোঁকর বন্ধ করার দায় রাষ্ট্রপক্ষকেই নিতে হবে।

বিশ্বজিতের পরিবার কোনও দিনই আর ছেলেকে ফিরে পাবে না, সেই শোক ও কষ্ট তাদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। কিন্তু খুনিদের শাস্তি নিশ্চিত করে এই পরিবারকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেওয়ার দায় সরকার ও রাষ্ট্রের। আর সরকার ও রাষ্ট্র যদি খুনিদেরই বেশি আপন মনে করে তাদের রেহাই দেওয়ার পণ করে তাহলে অবশ্য বলার কিছুই নেই। কেবল কান্না, হতাশা আর বিস্ময়! ‘বিচারের নামে খেলা’ই দেখে যেতে হবে। অন্তত এই মামলায়!

লেখক: কলামিস্ট

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ