X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

জার্মান রাজনীতি: হেলমুট কোলকে নিয়ে

দাউদ হায়দার
০৭ আগস্ট ২০১৭, ১৭:৩১আপডেট : ০৭ আগস্ট ২০১৭, ১৭:৩৩

দাউদ হায়দার মনে বড় দুঃখ ছিল, দুঃখ নিয়েই চলে গেলেন হেলমুট কোল। বয়স হয়েছিল ৮৭, বার্ধক্যে নানা রোগ, পারকিনসনেও আক্রান্ত, কথাবার্তায় এলোমেলো, শোকাহত প্রিয়জনের আঘাতে। সইতে পারেননি, ভুল করেছিলেন নিজের চালেই। ভুল শোধরাতে গিয়ে আরও ভুল, একা হয়ে যান দ্রুত, দল থেকে বিচ্ছিন্ন, বিতাড়িত। নিঃসঙ্গতায় এতটাই কাবু, সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতেও অনীহা। স্ত্রী হানালোরের মৃত্যুর পরেও নিঃসঙ্গ, একাকী নন। দেখভালের জন্য যে সেবিকা ছিলেন হিকে রিখটার, তাকেই বিয়ে করেন, বয়সের তফাৎ তিরিশ। বিয়েও করেন গোপনে। বিয়ের পরেই হানিমুনে গিয়েছিলেন শ্রীলঙ্কায়। সুনামিতে বেঁচে যান অল্পের জন্য, হানিমুনের খবর ফাঁস হয় কলম্বোর এক সাংবাদিকের রিপোর্টে।
হেলমুট আদর করে অ্যাঙ্গেলা মেরকেলকে ডাকতেন ‘অ্যাঙ্গি’। বলতেন ‘মাইন লিবে অ্যাঙ্গি’ (আমার প্রিয় অ্যাঙ্গি)। সাধারণেও চালু হয় ‘অ্যাঙ্গি’। অ্যাঙ্গেলা মেরকেল পূর্ব জার্মানির ব্রান্ডেনবুর্গ রাজ্যের। অ্যাঙ্গির পিতা ধর্মযাজক। তৎকালীন পূর্ব জার্মানির হাতে-গোনা কয়েকটি চার্চ, নামে মাত্র সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত। কমিউনিস্ট নেতারা বলতেন ‘আর পাঁচটি লোকরঞ্জন শাখার মতো (পাবলিক কালচারাল সেন্টার) চার্চও।’
ধর্মযাজকের কোনও ছেলেমেয়ে, তাও আবার কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানিতে, পশ্চিম জার্মানির ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ)- এর মহব্বতে মশগুল হবে, পানচুনখয়েরের একাত্মতা, এতটা বোধ হয় পূর্ব জার্মানির ‘ঘুঘু’ স্ট্যাসি (গোপন পুলিশ বাহিনী) তলিয়ে দেখেনি। বিশেষত ধর্ম যাজকের তরুণী কন্যা অ্যাঙ্গেলার ক্ষেত্রে (অ্যাঙ্গেলার প্রথম স্বামী মেরকেল। পূর্ব জার্মানির। দ্বিতীয় স্বামীও পূর্ব জার্মানির। দ্বিতীয় স্বামীর পদবি নেননি)। যদিও কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানিতে সিডিইউ, এসপিডি (সামাজিক গণতন্ত্রী দল) ছিল, রাজনীতি করতো, ভোটও তালিকাভুক্ত হতো, কপালে শিকে ছিঁড়তো না, ছেড়ার কথাও নয়। অ্যাঙ্গেলা মেরকেল সিডিইউ-এর রাজনীতি করলেও, পূর্ব জার্মানিতে আদৌ কোনও নেত্রী নন। একেবারেই অপরিচিত মুখ।
দুই জার্মানির একত্রীকরণের পরে চ্যান্সেলর হেলমুট কোলের খায়েশ হয়, পূর্ব জার্মানির একজনকে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দেবেন। খায়েশের অন্য কারণও আছে। একত্রিত জার্মানির সব মন্ত্রীই পশ্চিমের (জার্মানি), পূর্বের কেউ নেই। শুরু হয় গুচ্ছরন। কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানির রক্তপাতহীন বিপ্লব ঘটিয়ে পূর্ব ইউরোপের কমিউনিজমের ভূমিধসে ট্যারা করে দিয়েছে বিশ্বের চোখ, যা, মিখায়েল ঘরভাচেভ পেরেস্ত্রৈকা, গ্লাসনস্ত তৈরি করেও ভাবতে পারেননি ‘খোলা হাওয়ার’ দমকায় রাশিয়া নয়, পূর্ব জার্মানিই ভাসিয়ে নেবে, সুনামির চেয়েও প্রবল আঘাতে।

সুনামি বলে কয়ে আসে না, পূর্বাভাসও দেয় না, অতল-গহ্বর থেকে আঘাত হানে, তছনছ করে।

একত্রিত জার্মানির মন্ত্রিসভায় পূর্বের (পূর্ব জার্মানি) একজনকে ঠাঁই দেওয়া ‘মানবিক’ এই চক্ষুলজ্জা ত্রিশত্তর অ্যাঙ্গেলার মেরকেলকে বেছে নেয় হেলমুট কোল। তিনিই তখন সর্বেসর্বা। প্রতাপশালী চ্যান্সেলর। বার্লিন দেয়াল ধসে বা কমিউনিজম- পতনে হেলমুটের বিন্দুমাত্র কৃতিত্ব নেই, পশ্চিম জার্মানি থেকেও মদদ দেওয়া হয়নি, সবটাই পূর্ব জার্মানির জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব তাও আবার ধরাবাঁধা ছকে নয়, হঠাৎই, তবে দুই জার্মানির একত্রকরণে হেলমুট কোলের তৎপরতা এবং আপোষহীন জেদে আমেরিকা, সোভিয়েত রাশিয়া রীতিমত হতবাক। বাধ্য হয়েছে জেদ মেনে নিতে। অবশ্য, জার্মানিকে খেসারতও দিতে হয়েছে বিস্তর। বিশেষত আর্থিক। সোভিয়েত রাশিয়া ও আমেরিকা বিনা অর্থে জার্মানি ছেড়ে যায়নি। কেবল নগদ অর্থই দেওয়া নয়, বহু শর্তও মানতে হয়েছে। মনে রাখা দরকার পশ্চিম জার্মানি ছিল অ্যালায়েড ফোর্সের দখলে (তিন ভাগে বিভক্ত। আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেনের অধীনে)। পূর্ব জার্মানি ছিল সোভিয়েত রাশিয়ার সামগ্রিক দেখভালে। জানা আছে অনেকের, সেই সময় পূর্ব জার্মানির ড্রেসডেন-এ, পূর্ব ইউরোপের সোভিয়েত ইউনিয়নের কেজিবি’র হেড অফিস ছিল, প্রধান ছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন, আজকের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট। চমৎকার জার্মান বলেন।

প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে।

--কারণ  হয়তো এই, ১৯৮৭ সাল থেকে পশ্চিম বার্লিনে বাস ( বিভক্ত বার্লিন, বিভক্ত জার্মানি)। চোখের সামনে সবকিছু ঘটমান। দুই বার্লিন দুই জার্মানির রাজনীতি। বার্লিন দেওয়াল ধস। দুই বার্লিন সহ দুই জার্মানির পুনর্মিলন। উত্থান-পতন-উত্থান। প্রত্যক্ষদর্শীর মূলে অবশ্যই ‘ডয়েচে ভেলের বার্লিন সংবাদদাতা’ ( স্পেশাল রিপোর্টার)। তো, রাজনৈতিক মহলে ঢুঁ-মারা, খবর সংগ্রহ। রিগান, থ্যাচার, বুশ (সিনিয়র), বুশ (জুনিয়র), গর্ভাচভ, ইয়েলৎসিন, ক্লিল্টন, ওবামা প্রমুখের প্রেস কনফারেন্সে হাজির, আলপটকা প্রশ্ন করে কখনও বিপদে,কখনও বাহবাও।

থাক এসব। স্মৃতিকাহিনি লিখলে উল্লেখিত হবে হয়তো। বলছিলাম প্রাক্তন চ্যান্সেলর হেলমুট কোল এবং বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মেরকেলের কথা।

হেলমুট বললেন (সাংবাদিক সম্মেলনে), ‘আমার মন্ত্রিসভায় এমন একজনকে বেছে নিয়েছি, আপনারা নামই শোনেননি’।

--কোন মন্ত্রণালয়ে?

ফ্যামিলি প্ল্যানিং-এ।

--মন্ত্রীর কী নাম?

অ্যাঙ্গেলা মেরকেল।

-তিনি কোন রাজ্যের?

পূর্ব জার্মানির, বালির্নের পাশের রাজ্য ব্রান্ডেনবুর্গের।

এক সাংবাদিকের আর্তনাদ, ‘অ্যাঙ্গেলাকে?ওকে আমি চিনি। অ্যাঙ্গেলা বিবাহবিচ্ছেদী। ওর সন্তান নেই। দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছেন, সন্তান হয়নি। প্রথম স্বামীর পদবী ছাড়েন নি’।  হেলমুট কোল হেসে বলেন, ‘এই কারণেই ওকে পছন্দ করেছি, পরিবার পরিকল্পনার মন্ত্রীপদে। ঠিকমতো গড়েপিটে ‘মানুষ’ করবো। চৌকাস মন্ত্রী হবেন’।

অ্যাঙ্গেলাকে নিয়ে মজা করলাম আমরা। সাংবাদিকরা।

সাংবাদিক সম্মেলন শেষে অ্যাঙ্গেলা যোগ দেন সাংবাদিক পার্টিতে।

লক্ষ করি, পার্টিতে তাকে নিয়ে উচ্ছ্বাস নেই। ইতিউতি তাকান, তবে চোখ নিচু। ওর কথাবার্তাও গ্রাম্য। ইন্টারভিউ নিলাম। ইন্টারভিউয়ে খুবই সহৃদয়, খোলামেলা। একটি প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘মন্ত্রীর দায়িত্ব এবং রাজনীতির অনেক কিছুই ‍শিখেছি’।

--- কী শিখেছেন, এ নিয়ে প্রশ্ন করিনি। ধরে নিই, ‘শেখা-টেখা’ মামুলি কথা।

হেলমুট কোল সাংবাদিক সম্মেলনে অ্যাঙ্গেলা মেরকেলকে কাছে নিয়ে, ঘাড়ে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমার প্রিয় (মাইন লিবে)। প্রিয়কে আরও পোক্ত করার বাসনায়, কয়েকমাস পরেই ফ্যামিলি প্ল্যানিং থেকে সরিয়ে ‘উমভেল্ট’ (প্রকৃতি পরিবেশ)মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ করেন।

এই নিয়োগের কয়েকমাস পরেই অ্যাঙ্গির ঘুঁটি চালাচালি। গভীর গোপনে। চালাচালি খেলায় এতটাই বিজ্ঞ হন, হেলমুট কোলকেই সরিয়ে দেন রাজনীতি থেকে, পার্টি কংগ্রেসে হেলমুট কোনঠাসা, অতঃপর পদত্যাগ। এক অর্থে বিতারন। শেষ হয়ে যায় রাজনীতি। দলত্যাগী। ত্যাগের আগে সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, ‘প্রিয়জনকেও বিশ্বাস করা আহাম্মকি’।

হেলমুট কোলের দুঃখ, মনোকষ্টের তালিকায় আরও তিনটি উল্লেখিত, সংযোজিত। দুই জার্মানির পুনর্মিলনের ‘অধিনায়ক’। বাংলায় প্রবাদ: ‘নেপোয় মারে দই’। বিশ্বজুড়ে উন্মাদনা তাকে নিয়ে। ‘নিশ্চয় নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন শান্তির জন্য’ স্থির বিশ্বাস অনেকের। স্বয়ং কোলেরও। ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। না পেয়ে বলেন, ‘পুরস্কার বড় কথা নয়’।

আশা করেছিলেন হেলমুট, ১৯৯৮ নির্বাচনে জয়ী হবেন, সিডিইউ ( ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন)-এর ভূমিধস জয়। আশায় গুঁড়ে বালি।

নির্বাচনের আগে চ্যান্সেলরের নতুন বাসভবনও ঠিক করেন, তারই অনুমোদনে রাইখস্টাগের (সংসদভবন) সামনে নির্মিত হচ্ছে ‘চ্যান্সেলর দফতর, ভবন’। ধরেই নেন নির্বাচিত হবেন। একটানা ১২ বছর চ্যান্সেলর, উপরন্তু পুনর্মিলনের ‘অধিনায়ক’ জনগণ ভোট দেবে। ভাবেননি, পায়ের তলার মাটি নেই আর। সিডিইউ’র প্রতি মানুষ বিমুখ। নিজের এলাকায় (কনস্টিটিয়েন্সি) গো-হারা।

ধারণা করি, পরিবার থেকেই বড়ো দুঃখ, দুঃখিত। ছেলের সঙ্গে বিচ্ছেদ।
ছেলে বিয়ে করেন তুর্কি যুবতী। ছেলের বিয়েতে যোগ দেন, তুরস্কে যান, লোক দেখানো।
ছেলে-বৌ ব্যাঙ্কার। লন্ডনে বাস।
ছেলের বৌ তুর্কি হওয়া সত্ত্বেও, হেলমুট সর্বদাই তুরস্কবিরোধী, ইইউ-তে তুরস্কের প্রবেশ, অন্তর্ভুক্তি চাননি।

হেলমুট কোলের জন্ম ৩ এপ্রিল, মৃত্যু ১৬ জুন ২০১৭। বহুবার সাংবাদিক সম্মেলনে কাছ থেকে দেখেছি। প্রশ্নও করেছি অনেক। ওকে নিয়ে বিস্তর লেখা যায়। পছন্দ করি বা না করি।

হেলমুট কোল জার্মান-পুনর্মিলনের ইতিহাসের ঐতিহাসিক, মানতেই হবে।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
জনগণ এনডিএ জোটকে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে: মোদি
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
সোনার দাম কমেছে, আজ থেকেই কার্যকর
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
অতিরিক্ত মদপানে লেগুনাচালকের মৃত্যু
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
পূজা শেষে বাড়ি ফেরার পথে বাসচাপায় বাবা-ছেলে নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ