X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ষোড়শ সংশোধনী মামলার রায়: প্রভাব সুদূরপ্রসারী

বিভুরঞ্জন সরকার
১২ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৪৮আপডেট : ১২ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৫৪

বিভুরঞ্জন সরকার গত ১ আগস্ট বহুল আলোচিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে। এই রায়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার পর্যবেক্ষণে এমন কিছু স্পর্শকাতর বিষয়ে মন্তব্য করেছেন যা দেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। যেগুলো এখন বিচার ও আইন অঙ্গনের বাইরেও আলোচনা-বিতর্ক-সমালোচনার ঝড় তুলছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের মতানৈক্যের বা টানাপড়েনের পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে সচেতন সবার মধ্যেই এক ধরনের উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। এই রায় নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ‘আহত, ক্ষুব্ধ ও ক্ষতিগ্রস্ত’। অন্যদিকে বিএনপি উল্লসিত। আলোচনা ও বিতর্কের ধরন দেখে মনে হচ্ছে এর প্রভাব দেশের রাজনীতির জন্য সুদরপ্রসারী হবে।
প্রধান বিচারপতি যদিও ১০ আগস্ট আদালতে বলেছেন, রায় নিয়ে কেউ পলিটিক্স করবেন না। কিন্তু তার বারণ শোনার অপেক্ষায় কেউ আর নেই। সরকার পক্ষ তথা আওয়ামী লীগ প্রথম ক’দিন চুপচাপ থাকলেও, এখন মনে হচ্ছে প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে তারা মাঠে নেমে পড়েছে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও রয়েছে। বিএনপি শুরু থেকেই রায় নিয়ে সরকারকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। রায় প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে সরকারের পদত্যাগ দাবি করেছেন। রায় সরকারের পক্ষে যায়নি বলেই পদত্যাগ করতে হবে কেন? তেমন নির্দেশনা কি আদালত দিয়েছে? বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে কি তা করতো? বিএনপির প্রতিক্রিয়া দেখেই মনে হয়, এবার সরকারকে কাবু করার একটা মওকা তারা পেয়ে গেছে। সরকার আপাতত একটু চাপে আছে ঠিকই কিন্তু বিএনপি এ থেকে ফায়দা লুটবে সেটা হয়তো হতে দেবে না।
সাবেক প্রধান বিচারপতি এবং আইন কমিশনের চেয়ারম্যান খায়রুল হক গত ৯ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে রায় নিয়ে কিছু মন্তব্য করেন। তিনি আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে এটা করতে পারেন কিনা, তার একটি পক্ষাবলম্বন সরকারের জন্য লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি করলো কিনা, সেসব প্রশ্ন উঠছে। খায়রুল হক প্রধান বিচারপতি থাকতে তত্ত্বাবধারক সরকার বাতিলের রায় দিয়ে আলোচিত হয়েছিলেন। তখন আওয়ামী লীগ খুশি হলেও ক্ষুব্ধ হয়েছিল বিএনপি। এখন ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর প্রশ্ন সামনে আসছে, ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় আওয়ামী লীগ সরকার অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেও এবার গড়িমসি করলে সেটা কি ভালো দেখাবে? খায়রুল হক ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়কে ‘অপরিপক্ক, পূর্বপরিকল্পিত ও অগণতান্ত্রিক’ বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ এখন আর জনগণের প্রজাতন্ত্র নয়, বরং এটা বিচারকদের প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে।
বিচারপতি এস কে সিনহা তার পর্যবেক্ষণে যদি অপ্রাসঙ্গিক ও বাহুল্য বিষয় বেশি এনে থাকেন, তাহলে বিচারপতি খায়রুল হক কি তার প্রতিক্রিয়ায় অতিশয়োক্তি করেননি? সংযমের পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের সবারই ঘাটতি আছে। দোষ দেওয়া হয় কেবল রাজনীতিবিদদের। বিএনপি যে এই রায় নিয়ে উস্কানিমূলক অবস্থায় আছে সেটা বোঝা যায় ১০ আগস্ট কোর্ট বসার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা খায়রুল হকের বক্তব্যসম্বলিত পেপার কাটিং প্রধান বিচারপতির নজরে এনে তার বিরুদ্ধে আদালত অবমানার অভিযোগ গঠনের আর্জি জানানোর ঘটনা থেকে। প্রধান বিচারপতি অবশ্য বিষয়টি আমলে না নিয়ে বলেছেন, রায় হয়ে যাওয়ার পর এর গঠনমূলক সমালোচনা আমরা গ্রহণ করি। রায় নিয়ে যেকোনও গঠনমূলক সমালোচনাকে আমরা স্বাগত জানাবো। এনিয়ে বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের ক্রমাগত আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনারা সংযত আচরণ করবেন, যা সবার জন্য মঙ্গল। প্রধান বিচারপতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা যেটা বলেছেন, সেটা হলো, ‘সরকার বা বিরোধী দল কারও ট্র্যাপে পড়বো না, আমরা সচেতন’।

প্রধান বিচারপতির একটি মন্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে এবং সেটাই স্বাভাবিক। প্রধান বিচারপতি তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘কোনও একক ব্যক্তিকে নিয়ে অথবা তার দ্বারা কোনও জাতি-দেশ গঠিত হয়নি’।  এধরনের বক্তব্য বাংলদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় একেবারেই অপ্রত্যাশিত। কার কথা মাথায় রেখে প্রধান বিচারপতি এমন মন্তব্য করলেন সেটা বোঝার জন্য কি ব্যাপক গবেষণার প্রয়োজন আছে? বিএনপি নেতারাও এমন কঠিন কথা বলতে পারেননি। প্রধান বিচারপতি বুঝতে পারছেন কি কত শক্ত হাতিয়ার তিনি বিএনপির হাতে তুলে দিলেন? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত সঙ্গতভাবেই বলেছেন, কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে বলেন, কোনও ব্যক্তির একক প্রচেষ্টায় দেশ স্বাধীন হয়নি। কিন্তু সবকিছুর পেছনে কারও উদ্যোগ থাকে, প্রেরণা থাকে, সাংগঠনিক ক্ষমতা থাকে এবং মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার শক্তি থাকে। সেই শক্তি ছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। অবশ্যই সম্মিলিত প্রচেষ্টায়, তবে একজন না একজন নেতৃত্বে থাকে।

প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণের কথা সরাসরি উল্লেখ না করে প্রধানমন্ত্রী সংযত ভাষায় যে জবাব দিয়েছেন, তা প্রশংসার যোগ্য। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় দিতে গিয়ে মাননীয় প্রধান বিচারপতি এতসব বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন যা খুব প্রয়োজন ছিল না বলেই অনেকে মনে করছেন। আবার আওয়ামী বিরোধীরা বেজায় খুশি। তারা বগল বাজাতে শুরু করেছেন।

দেশের রাজনীতি, নির্বাচন কমিশনসহ নানা বিষয়ে মতামত দেওয়ায় এই রায় যতটা না আইনি বিষয় হয়েছে, তারচেয়ে বেশি হয়েছে রাজনীতির বিষয়। কিছু বিষয়ে তার বক্তব্য একপেশে এবং অতিসরলীকরণ দোষেদুষ্ট। এরমধ্যে যতটা না গভীরতা আছে, তারচেয়ে বেশি আছে একধরনের সস্তা জনপ্রিয়তার ব্যাপার। কেউ যদি এটাকে আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ না জেনে পাঠ করেন তাহলে এর অনেক কিছুই সরকারবিরোধী কোনও রাজনৈতিক নেতার বক্তৃতা বলে ভ্রম হতে পারে। রাজনৈতিক নেতারা হাততালি বা বাহবা পাওয়ার জন্য পপুলিস্ট ঢঙ্গে কথা বলতে পারেন, কারণ তাকে ভোটের জন্য জনপ্রিয় হতে হয় বা থাকতে হয়। কিন্তু বিচারপতিদের তো সেটা নয়।

ষোড়শ সংশোধনী যেহেতু সংসদে পাস হয়েছে তাই সংসদ নিয়ে মতামত রায়ে থাকাটা অনেকের কাছে যৌক্তিক মনে হতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে মন্তব্য করার প্রয়োজন পড়লো কেন? আওয়ামী লীগ নিয়ে, বর্তমান সরকারের শাসন নিয়ে অনেকেই অসন্তুষ্ট হতে পারেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নিয়েতো মানুষের মনে আবেগের কমতি নেই। মানুষের সেই আবেগকে আঘাত দিয়ে আদালত কাদের খুশি করলেন? কোনও রাজনৈতিক দলের মোরাল বুস্টআপের দায়িত্ব কি আদালতের?  

আদালত বলেই কি তার এখতিয়ারের বাইরে যাওয়ার অধিকার আছে? সংসদ, না আদালত, কার ক্ষমতা বেশি?  সংবিধান তৈরি করেছে সংসদ, না সুপ্রিম কোর্ট? সংসদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করে। রাষ্ট্রপতি বিচারপতিদের নিয়োগ দেন। তাহলে বিষয়টি কী দাঁড়ায়?

সরকারের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ১০ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য ও প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে রায় নিয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেছেন। আইনমন্ত্রী বলেছেন, দ্বিমত থাকলেও রায়ের প্রতি সরকারের শ্রদ্ধা রয়েছে। পর্যবেক্ষণের ‘আপত্তিকর’ ও ‘অপ্রাসঙ্গিক’ বক্তব্যগুলো বাদ দেওয়ার (এক্সপাঞ্জ) করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। একই সঙ্গে এই রায় রিভিউ করার বিষয়েও চিন্তাভাবনা চলছে। রায় রাজনৈতিকভাবে নয়, আইনগতভাবেই মোকাবিলা করা হবে বলেও আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদহ সংবিধান পরিপন্থী আখ্যায়িত করার বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, তার মনে হয়েছে, প্রধান বিচারপতির যে রায় তা যুক্তিতাড়িত নয়, বরং আবেগতাড়িত।

আইনমন্ত্রী বলেন, আপিল বিভাগের রায়ে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রসঙ্গে দেওয়া বক্তব্য তথ্যনির্ভর নয়। আর তড়িঘড়ি করে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা দুঃখজনক অভিহিত করে তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অপসারণে এই কাউন্সিল অস্বচ্ছ এবং নাজুক।

আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণ বিষয়ে আইনমন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতি তার রায়ে অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা বলেছেন, যা এই মামলার ‘ফ্যাক্ট ইন ইস্যু’র সঙ্গে একদমই সম্পর্কিত  নয়। তিনি জাতীয় সংসদ সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন এবং এই প্রতিষ্ঠানকে হেয় প্রতিপন্ন করেছেন। এসব রাজনৈতিক প্রশ্ন আদালতের বিচার্য বিষয় হতে পারে না। মন্ত্রী আরও বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা কোনও একক ব্যক্তির কারণে হয়নি বলে যে কথা বলা হয়েছে তাতে আমি মর্মাহত।

আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীরা রায় নিয়ে কথা বলতে শুরু করায় একধরনের উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে। তবে আওয়ামী লীগের নতুন প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু বলেছেন, সুপ্রিমকোর্ট আমাদের প্রতিপক্ষ নয়। কিন্তু বিএনপি প্রতিপক্ষ বানানোর চেষ্টা করছে। আদালত রাজনীতির ঊর্ধ্বে, শেষ আশ্রয়স্থল। তাই রায় নিয়ে রাজনীতি নয়।

কিন্তু রায় নিয়ে এরমধ্যেই রাজনীতি শুরু হয়েছে। বিএনপি মহাসচিব সরকারের পদত্যাগ দাবি করার পর প্রধান বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলছেন, স্বেচ্ছায় না গেলে তার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন  গড়ে তোলা হবে। আবার প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে বিএনপি শিবিরে ঠেলে দেওয়ার একটি চেষ্টাও চলছে। এমন গুজবও ছড়ানো হচ্ছে যে তিনি হবেন বিএনপির ‘সহায়ক’ সরকারের প্রধান অথবা বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তাকে বানানো হবে রাষ্ট্রপতি। যারা এসব ছড়াচ্ছেন তাদের মুখ বন্ধ করার উপায় কী? এসব নিছক গুজব হলেও লক্ষণ মোটেও ভালো নয়। বঙ্গপোসাগরে কোনও রাজনৈতিক নিম্নচাপ ঘনীভূত হচ্ছে নাতো?  

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
এমপি দোলনের গাড়ি লক্ষ্য করে ইট নিক্ষেপ, সাংবাদিক আহত
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
চরের জমি নিয়ে সংঘর্ষে যুবলীগ কর্মী নিহত, একজনের কব্জি বিচ্ছিন্ন
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ