X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

৩২ কোটি হাত হোক বন্যা মোকাবিলার হাতিয়ার

চিররঞ্জন সরকার
১৬ আগস্ট ২০১৭, ১৩:৩৩আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০১৭, ১৩:৩৭

চিররঞ্জন সরকার মধ্য আগস্টে বড় বন্যা আসছে বলে আগেই সতর্ক করেছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ। মন্ত্রীর সতর্কবাণী সত্যি হতে চলেছে। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্তত ২০টি জেলা গত পাঁচদিন ধরে বন্যা কবলিত। প্রতিদিনই নদ-নদীগুলোতে পানি বাড়ছে, প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। সবচেয়ে বেশি পানির ধারক যমুনা নদীর বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে গত ৭০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে পানি বেড়েছে।
এদিকে, বাংলাদেশের উজানের দেশ চীন, নেপাল ও ভারতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এসব দেশের বন্যার সিংহভাগ পানি বাংলাদেশের নদ-নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়বে। এর মধ্যে আগামী ২০ ও ২১ আগস্ট অমাবস্যার প্রভাবে সাগরের পানির উচ্চতা এমনিতেই বাড়বে। ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের বন্যার পর এবারই প্রথম বড় তিন নদীর পানি একসঙ্গে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সবমিলিয়ে চলতি বর্ষা মৌসুমে দীর্ঘ এলাকাব্যাপী ভয়াবহ বন্যার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
আবহাওয়ার পূর্বাভাষ মতে, ব্রহ্মপুত্র এবং যমুনায় আগামী তিন দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে। এ সময়ে পানির উচ্চতা প্রায় দেড় ফুট বাড়বে। ফলে এ নদীগুলোর অববাহিকায় দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটবে। গঙ্গা-পদ্মার এবং সুরমা-কুশিয়ারায় পানি বাড়তে থাকায় এবং নেপালে ও ভারতের বিহারে-আসামে বন্যা পরিস্থিতি থাকায়, দেশের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতেও বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেবে। রাজধানী ঢাকার নিম্নাঞ্চলও প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতোমধ্যে সেই আলামত শুরু হয়েও গেছে।
এ বছর নীলফামারী, কুড়িগ্রাম ও দিনাজপুরসহ দেশের উত্তরাঞ্চলে যে বন্যা দেখা দিয়েছে তা নজিরবিহীন। ওই এলাকায় বন্যার কারণ তিস্তা-পুনর্ভবা ও ধরলা নদীর পানিবৃদ্ধি। গত ৫০ বছরে ওই নদীগুলোতে এত পানিবৃদ্ধি হয়নি। ফলে ওই এলাকার মানুষও চলমান বন্যার মতো পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়নি। ভারত গজলডোবা ব্যারাজের সব ক’টি গেট খুলে দেওয়ায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে উত্তরাঞ্চলে। খুলে দেওয়া হয়েছে কাপ্তাই জলবিদ্যুত কেন্দ্রের সব  ক’টি গেট। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় বন্যা পরিস্থিতি নিয়েছে ভয়াবহ রূপ। তার অনিবার্য প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কয়েক লাখ মানুষ। খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাবে সৃষ্টি হয়েছে মানবেতর পরিস্থিতি। অতিবর্ষণে জনজীবন হয়ে পড়েছে বিপর্যস্ত। প্লাবিত হওয়ায় কয়েকটি স্থানে সড়ক ও রেলপথ হয়ে পড়েছে জলমগ্ন, ঝুঁকিপূর্ণ, এমনকি বিচ্ছিন্ন।
বন্যাকবলিত এলাকায় দেখা দিয়েছে চরম খাদ্যাভাব ও সুপেয় পানির সংকট। পয়ঃনিষ্কাশন এবং হাঁস-মুরগি-গবাদিপশু সংরক্ষণসহ পশুখাদ্যের অভাব প্রকট। সর্বাধিক যেটা দুঃখজনক তা হলো, কয়েকদিন অতিবাহিত হলেও বন্যাদুর্গত এলাকায় তেমন ত্রাণ তৎপরতার খবর নেই। ফলে মানুষ প্রায় অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন। স্থানীয়ভাবে কোথাও কোথাও কিছু ত্রাণের ব্যবস্থা নেওয়া হলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল। অনেক দুর্গম-দুর্গত এলাকায় বিশেষ করে প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে ত্রাণ তৎপরতার আদৌ কোনও খবর নেই। অনেক জায়গায় কিছু মানুষ পরিবার-পরিজন নিয়ে অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে খোলা আকাশের নিচে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছেন। রোগ, শোক, আমাশয়, পেটের পীড়া, সর্দি-কাশি, জ্বরের প্রকোপও লক্ষণীয়। বীজতলাসহ ফসলহানির খবরও আছে।
বাংলাদেশের যেসব অংশে বর্তমানে বন্যা দেখা দিয়েছে, সেসব মূলত সীমান্তের ওপার থেকে নেমে আসা পানির ঢল ও অতিবৃষ্টি, যা অনেক সময় বাঁধ উপচে পড়ার কারণে ছেড়ে দেওয়া হয়। একদিকে তিস্তা-ধরলা-তোরসা, অন্যদিকে আসামের ব্রহ্মপুত্রের বন্যার অনিবার্য প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে। প্রতিবেশী দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত অভিন্ন নদ-নদীর বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিত বাঁধ ও ব্যারাজ নির্মাণের কারণেই প্রতিবছর এমন ঘটনা ঘটে থাকে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। আর এর অনিবার্য অসহায় শিকার হচ্ছে দু’দেশের সীমান্তবর্তী লাখ লাখ গরিব মানুষ। প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তির কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিন থেকে বিরাজমান অভিন্ন নদ-নদীর পানি সমস্যার নিরসনসহ তিস্তা-ফেনীর পানি সমস্যাটিও ঝুলে আছে। অথচ বন্যাদুর্গত ও নদীভাঙন কবলিত অসহায় মানুষের সাংবাৎসরিক দুর্দশা লাঘবে দু’দেশের মধ্যে পানি সমস্যার মীমাংসা ছাড়া গত্যন্তর নেই। এ ব্যাপারে কূটনৈতিক উদ্যোগ জোরদার করা দরকার।

আমরা যখন সমস্যায় পড়ি তখন তাৎক্ষণিকভাবে বিচলিত ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। সমস্যা চলে গেলেই আবার সব ভুলে যাই। বন্যাকবলিত হলে এক আশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায়। নেতা-মন্ত্রীরা অনেক সময় সক্রিয় হন। ত্রাণ বিতরণ করেন, হাঁটুজলে নেমে দুর্গত মানুষের দুঃখ-দুর্দশা পরিদর্শন করেন। অনেকে হেলিকপ্টারে চড়ে প্লাবিত এলাকা দেখতে যান। অথচ বন্যা প্রতিরোধের কাজে সারা বছর তাদের কোনও ব্যস্ততা নাই। ড্রেন পরিষ্কার, খাল সংস্কার, তাতে স্লুইস গেট নির্মাণ, নদী ভরাট রোধ, বাঁধ নির্মাণ, পাম্প হাউস নির্মাণ, জলাধারগুলো উন্মুক্ত করা ইত্যাদি পরিকল্পনা যদি বাস্তবায়িত করা যায়, তাহলে বন্যা নিবারণ ছাড়াও এলাকার উন্নয়নে গতি আসত।

জীবনের অধিকারের অর্থ হলো মর্যাদার সঙ্গে বাঁচবার অধিকার। বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন, পানীয় জলহীন, শুধু নৌকা সম্বল করে বেঁচে থাকা যেমন বিপজ্জনক, তেমনই অসম্মানজনক। অথচ প্রতি বছর সেই পরিস্থিতির দিকেই সরকার ঠেলছে দেশবাসীকে। বহু দিন ধরে, বহু অর্থ ব্যয়ে দুর্যোগ প্রতিরোধের পরিকল্পনা প্রস্তুত করে অনেক সময় তা হাতে নিয়ে বসে থাকেন কর্তৃপক্ষ। শহরের রাস্তায় নৌকা চলে। তখন আমরা ঠাট্টা-মস্করায় লিপ্ত হই। কিন্তু কার কী করার কথা ছিল, কী করা দরকার ছিল, কী হলো, কী হলো না, এসব নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যথা নেই।

যা হয়েছে বা হচ্ছে, যতই দুঃখজনক হোক, তা অবশ্যম্ভাবী ছিল। যদি দু-এক বছর পর পর লাখ লাখ মানুষের কল্পনাতীত দুর্গতি এড়িয়ে যাওয়া প্রকৃতই আকাঙ্ক্ষিত হয়, তা হলে গোড়া থেকে ভাববার দায়িত্ব নিতে হবে। তা কঠিন হলেও অসম্ভব নয় হয়তো, কিন্তু আমাদের ঠিক করতে হবে, কী আমাদের কাছে অগ্রাধিকার পাবে। এসব বিষয়ে দীর্ঘমেয়াদী রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা প্রয়োজন।

এ মুহূর্তে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ের উচিত সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার করার পাশাপাশি প্রয়োজন বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনা খাবার, জরুরি ওষুধপত্র, তাঁবু ইত্যাদি। গরিব ও অসহায় মানুষের কাছে এখনই সেসব পৌঁছে দেওয়া প্রশাসনের প্রধান অগ্রাধিকার হওয়া দরকার। তবে বরাবরের মতো কেবল বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার করা, প্রয়োজনমতো আশ্রয়কেন্দ্র খোলা, বিশেষ সাহায্যের পাশাপাশি সারাদেশের জেলা প্রশাসকদের কাছে তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটানোর জন্য চাল ও টাকা দেওয়া এবং মেডিক্যাল টিম প্রস্তুত রাখাই যথেষ্ট বলে আমরা মনে করি না। বরং লক্ষ্য রাখতে হবে, মানবিক বোধহীন সুযোগসন্ধানী মুনাফাবাজরা যেন এই দুর্যোগের সুযোগ নিতে না পারে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম যেন লাফিয়ে লাফিয়ে না বাড়ে। আর ত্রাণ নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতি যেন না হয়। দুর্গত প্রতিটি মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো, প্রতিটি মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাই এ মুহূর্তে সবচেয়ে বড় কর্তব্য।

আমাদের দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে সাধারণ মানুষের আসার ঘটনা অতীতে আমরা বহুবার দেখেছি। দেখেছি, ‘সিডর’ ‘আইলা’ প্রভৃতি বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগে। মানবিক আবেগের এই প্রাচুর্য সভ্য-জাতির গর্ব এনেছিল আমাদের মনে। এবারও যেন তার অন্যথা না হয়। আমরা ছাত্রজীবনে শিখেছি-‘চ্যারিটি বিগিনস অ্যাট হোম।’ আমরা আত্মস্থ করেছি একটি কবিতা, যার সারমর্ম বলছে-বিন্দু বিন্দু জলকণা দিয়েই সৃষ্টি হয়েছে সাগর-মহাসাগর, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণার সমষ্টিতেই গড়ে উঠেছে দেশ, মহাদেশ। ক্ষুদ্রের সমন্বয়ের এই উদাহরণটিতে মহত্ত্বের প্রেরণাটি প্রচ্ছন্ন রয়েছে। দুর্যোগকবলিত বা দুস্থ মানবতার সহায়তার জন্য প্রসারিত একটি একটি করে এগিয়ে আসা হাতও হয়ে উঠতে পারে অসংখ্য মানুষের সম্মিলিত শক্তি। যে শক্তি দিয়ে জয় করা যায় দুর্যোগের তাণ্ডবকে। রক্ষা করা যায় বিপন্ন মানবতাকে। আমরা তুলনামূলক সম্পন্ন মানুষেরা যদি আমাদের আয় থেকে বাঁচিয়ে, একটু সংযম করে সামান্য কিছু টাকা দুর্গত মানুষের জন্য ব্যয় করি, তাহলে একটি শিশু পেতে পারে এক বেলার আহার। এক দিনের খরচের সামান্য একটু অংশ একটি শিশুর জীবন বাঁচাতে পারে।

আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে দীনতার মাঝে কষ্ট করে হলেও মানবতার মোমবাতিটি জ্বালিয়ে রাখতে হবে। মানবধর্মকে পরাজিত হতে দেওয়া যাবে না। মানুষের দুঃখে মানুষের মন যদি না কাঁদে যদি কোনেও সমবেদনা না জাগে, তাহলে আর আমরা কিসের মানুষ? স্বামী বিবেকানন্দ মানব সেবার মহিমা সম্পর্কে বলেছেন, ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।’ মনে রাখতে হবে, মানুষ-মানুষের জন্য জীবন-জীবনের জন্য। আমাদের সবারই সুযোগ রয়েছে মানবসেবায় নিয়োজিত করে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার। আমি, আপনি, সে-এভাবেই এগিয়ে আসতে পারি সবাই। দাঁড়াতে পারি দুর্গত মানুষের পাশে। মানুষের মতো মানুষ হতে আসুন, আমরা বন্যাদুর্গতদের পাশে এসে একটু সাহায্যের হাত প্রসারিত করি। যে যার অবস্থান থেকে মানবীয় কর্তব্যটুকু পালন করি।

লেখক: কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ