X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

নায়করাজ, তোমাকে সালাম

চিররঞ্জন সরকার
২৪ আগস্ট ২০১৭, ১৪:০৩আপডেট : ২৪ আগস্ট ২০১৭, ১৪:১৯

চিররঞ্জন সরকার তিনি একজন অভিনয় শিল্পী। সিনেমায় অভিনয় করেছেন। সিনেমা বানিয়েছেন। যদিও তার পরিচয় নায়করাজ রাজ্জাক হিসেবে। রাজধানীর ইউনাইটেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৭৫ বছর বয়সে মারা গেলেন তিনি। অথচ তাকে নিয়ে কত শোক। কত আলোচনা। কতজনের কত হাহাকার। আঁতেলরা অভিনয় শিল্পীদের নিয়ে অনেক সময় তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। অনেকে তাদের ‘ভঙ্গিজীবী’ বলেও টিটকারি দেন। তবে মানুষকে আনন্দ দেওয়া, একটি চরিত্রের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া, মানুষের দুঃখ-যন্ত্রণা-আবেগকে ধারণ করতে পারা, অসংখ্য মানুষের স্বপ্নের নায়ক হতে পারা চাট্টিখানি কথা নয়। সবাই তা পারেন না। কিন্তু নায়করাজ রাজ্জাক পেরেছিলেন। আর পেরেছিলেন বলেই তার মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ হয়েছে পুরো দেশ!
খুব সম্ভবত অবুঝ মন সিনেমা দিয়ে রাজ্জাকের সিনেমা দেখা শুরু। গ্রাম-বাংলায় খুবই জনপ্রিয় ছিল সিনেমাটি। ‘শুধু গান গেয়েই পরিচয়’ জনপ্রিয় এই গানটি ছিল কাজী জহির পরিচালিত ‘অবুঝ মন’ সিনেমায়। সৈয়দ শামসুল হকের কাহিনিটিও ছিল খুব হৃদয়গ্রাহী। ওই সময়ের সমাজ বাস্তবতায় খুবই কমন একটা চিত্র। যাত্রাপথে দুই অচেনা তরুণ-তরুণীর পরিচয়, অতঃপর প্রেম। কিন্তু দুইজনের মাঝে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় ধর্ম। এমনই এক মর্মস্পর্শী ভালোবাসার গল্পে নির্মিত এই ছবিতে অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক ও শাবানা। যদ্দূর মনে পড়ে, ঠাকুরগাঁও জেলার কোনও একটি হলে এই ছবি দেখতে যাওয়া বেশিরভাগ দর্শককে হলের মধ্যে সবাইকে হুহু করে কাঁদতে দেখেছি! এমনই কাহিনি শুনেছি যে, নতুন কেউ সিনেমাটি দেখতে যাচ্ছে, তাকে বলে দেওয়া হতো, এক বা একাধিক রুমাল যেন সঙ্গে নিয়ে যায়। কারণ ওই সিনেমা দেখলে কান্না আসবেই। তখন তো টিসুর যুগ ছিল না। অগত্য চোখের জল মুছতে রুমাল লাগত। অনেক নারী আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে শাড়ির প্রায় অর্ধেকটা ভিজিয়ে হল থেকে বের হয়েছেন, এমনটাও শুনেছি!

তবে আমার ভালো লেগেছিল রংবাজ! প্রায় ৩৫ বছর আগে দেখা সিনেমা, কিন্তু এখনও রাজ্জাকের অভিনয় চোখে ভাসছে। ‘রংবাজ’ ছবিতে রাগী তরুণের ভূমিকায় রাজ্জাকের অভিনয় তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল। যুবসমাজের মডেল হয়ে উঠেছিলেন তখন ‘রংবাজ’ রাজ্জাক।

যখন দেশে বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল সিনেমা, তখন এদেশের মানুষ রাজ্জাকের সিনেমা দেখননি, আর রাজ্জাকের ফ্যান হননি-এমনটা খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আমাদের কৈশোর-যৌবনের আদর্শ নায়ক ছিলেন রাজ্জাক। রাজ্জাকের সিনেমা মানেই হিট সিনেমা। ভালো সিনেমা। রূপালি পর্দায় তার ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। কখনও রোমান্টিক নায়ক, কখনও দুঃখী মায়ের আদরের  দুলাল, কখনও প্রতিবাদী কণ্ঠ, কখনও ভাবীর আদরের দেবর। একই মানুষের কত শত রূপ ছিল পর্দায়। যে কোনও চরিত্র অবলীলায় ফুটিয়ে তুলেছেন। ষাটের দশকে বাংলাদেশের সিনেমায় একচেটিয়া দখল ছিল নায়ক রাজ রাজ্জাকের। রাজ্জাক-কবরী জুটির কথা এখনও বহু দর্শকের কাছে সফল রোমান্টিক জুটির উদাহরণ হয়ে আছে। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি জুটি গড়েছেন শাবানার সঙ্গে।

বাংলাদেশের সিনেমার ইতিহাসে তিনি যতটা দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছেন সেটি একেবারেই বিরল। এর কারণ সম্ভবত রাজ্জাকের অভিনয়ে অতিমাত্রায় নাটকীয়তা যেমন ছিল না আবার যাকে বলে একেবারে বাস্তব-সেটাও হয়তো ছিল না। এই দুয়ের মিশেলে ছিল বলেই সবাই তাঁর অভিনয় পছন্দ করত।

১৯৬৪ সালে কলকাতার ছেলে রাজ্জাক কলকাতা থেকে স্ত্রী লক্ষ্মী ও ছয় মাসের ছেলে বাপ্পারাজকে নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। চোখে তখন অনেক স্বপ্ন। অভিনয় দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চান। কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে প্রথমে তিনি থিয়েটারে কাজ শুরু করেন। অনেক বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত ঢাকার অভিনয় জগতে নাম লেখানোর সুযোগ পান। প্রথমে মঞ্চে, এরপর টেলিভিশনে তিনি অভিনয় শুরু করেন। অবশেষে রাজ্জাকের স্বপ্ন পূরণ হয় ১৯৬৮ সালে। জহির রায়হানের চলচ্চিত্র ‘বেহুলা’য় প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের মাধ্যমে। এরপর তাকে আর ফিরে তাকে হয়নি। দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘আনোয়ারা’ আর তৃতীয় ‘আগুন নিয়ে খেলা’। এই ছবি মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সুপারস্টার খেতাবে ভূষিত হন। এরপর একটানা প্রায় ৫০ বছর ধরে তিনি চলচ্চিত্র শিল্পে কাজ করছেন রাজ্জাক।

খুবই সাধারণ অবস্থা থেকে অসাধারণ অবস্থানে পৌঁছেন নায়করাজ রাজ্জাক। কিন্তু কখনও অহঙ্কারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হননি। অতীতকেও ভুলে যাননি। এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি আমার জীবনের অতীত ভুলি না। আমি এই শহরে রিফিউজি হয়ে এসেছি। স্ট্রাগল করেছি, না খেয়ে থেকেছি। যার জন্য পয়সার প্রতি আমার লোভ কোনোদিন আসেনি।’

সত্যি তাই। কপর্দকশূন্য রাজ্জাক নিঃস্ব রিক্ত অবস্থায় শরণার্থী হিসেবে পা রেখেছিলেন ঢাকায়। তখন ঢাকার চলচ্চিত্র নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে। এই ঢাকাই চলচ্চিত্র অঙ্গন থেকেই তার রাজ্জাক হয়ে ওঠা। জীবনে পাড়ি দিয়েছেন বন্ধুর পথ। কঠিন জীবনসংগ্রামের পর সফল হয়ে তিনি। নিজের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সততা ও নিষ্ঠা, অসীম মনোবল, প্রচণ্ড পরিশ্রম আর কঠোর সাধনার মাধ্যমে তিনি নিজের লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। তার দীর্ঘ কর্মজীবনে কত কিছু অদল বদল হয়েছে। তথাকথিত আধুনিকতার হাওয়া লেগেছে পালে, অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী, চিত্রপরিচালক পথ থেকে বিপথে হেঁটেছেন। আপোষ করেছেন নোংরামীর সঙ্গে। অপসংস্কৃতি আর অশ্লীলতার সঙ্গে। কিন্তু রাজ্জাক থেকেছেন আপোষহীন। নীতির ক্ষেত্রে কখনও আপোষ করেননি। তাইতো তিনি চলচ্চিত্রের কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছেন।

রাজ্জাক বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে ৩০০-এর বেশি বাংলা ও উর্দু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। এ ছাড়া ১৬টি চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন। রাজ্জাক পাঁচবার বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০১৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা পান এই গুণী অভিনেতা।

নিতান্তই ভালো মানুষ ছিলেন তিনি। কখনও কোনও বিতর্কে জড়াননি। যাপন করেছেন সাদামাটা জীবন। তাই তো সফল হয়েছেন। এত মানুষের শ্রদ্ধা পেয়েছেন। এখানে প্রশ্ন এসে যায়- সফলতা বলতে ঠিক কী বোঝায়? জীবনের সিঁড়িতে কে কতগুলো ধাপ উঠল? অনেক উপার্জন? পার্থিব সুখের পরাকাষ্ঠা? আমাদের মধ্যবিত্ত গড়পড়তা বুদ্ধিতে অবশ্য আমরা তাই বুঝি।

সারাজীবন ভালোমানুষ থেকে খুব সাধারণভাবে জীবন কাটানো, এটা কি বড় সাফল্য নয়? তিনি অনেক টাকা বানানোর সুযোগ পেয়েছেন। কিন্তু সেই সুযোগ গ্রহণ করেননি। নিতান্তই নিজের প্রয়োজনটুকু নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছেন।

সাধারণ মানুষের মতো জীবন কাটিয়েছেন, কখনও বা দরিদ্রদের জন্য নিজের উপার্জন ব্যয় করেছেন। এসব কি সফলতার মাপকাঠি নয়?

ইংরেজিতে দুটো শব্দ আছে, অ্যাচিভমেন্ট আর কনট্রিবিউশন। অ্যাচিভমেন্ট হলো প্রাপ্তি, একজন মানুষ সারাটা জীবন ধরে কী পেলো। কনট্রিবিউশনের অর্থ অবদান, সে সমাজকে কী দিলো। একজন মানুষের সাফল্যের মাপকাঠি তার অ্যাচিভমেন্ট নয়, তার কনট্রিবিউশন। সমাজকে, সভ্যতাকে, জ্ঞানকে তার নিজস্ব পেশার পরিধিতে সে কতখানি দিয়ে যেতে পারল শেষ বিচারে তাই দিয়েই তার সাফল্য নির্ধারিত হয়। সেই বিচারে নায়করাজ রাজ্জাক যা দিয়েছেন, তা অসামান্য।

একটি মৃতদেহ যখন শেষযাত্রায় গমন করে তখন এমনটা তো বলতে শোনা যায়, আহারে, মানুষটা বড় ভালো ছিল। ওই শেষের দিনটিতে যতগুলি দীর্ঘশ্বাস, যত কটি অশ্রুবিন্দু তাই দিয়েই মানুষের সাফল্যের বিচার।

এই বিচারে নায়করাজ রাজ্জাকের চেয়ে সফল মানুষ বর্তমান সময়ে খুব কমই আছেন।
আন্তরিক অভিবাদন ও সালাম জানাই নায়করাজ রাজ্জাককে! তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের মনের মনিকোঠায়!

লেখক: কলামিস্ট

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
ইতিহাস বিকৃত করে বিএনপি সফল হয়নি, এখন আবোল-তাবোল বলছে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
শাহীনকে সরিয়ে বাবরকে নেতৃত্বে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে পিসিবি!
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
মেঘলা আকাশ থেকে ঝরতে পারে বৃষ্টি, বাড়বে গরম
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত সাংবাদিকের সংখ্যা বেড়ে ১৩৭
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ