X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

তত্ত্বাবধায়ক কি ফিরবে?

আমীন আল রশীদ
২৯ আগস্ট ২০১৭, ১৫:৫৪আপডেট : ২৯ আগস্ট ২০১৭, ১৬:০৫

আমীন আল রশীদ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে নানাবিধ আলোচনা আর তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই গোপনে গোপনে একটা আলোচনাও দানা বাঁধছে— তা হলো, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় রিভিউ হবে কিনা অর্থাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরবে কিনা? এই আলোচনাটি ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের আগেই নানা মহলে সাবধানে উচ্চারিত হচ্ছিলো। সেটি হালে পানি পায় এই রায় বাতিলের পরে সরকার ও বিচার বিভাগের মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হলে।
দেখা যাচ্ছে, ষোড়শ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়েও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়টি রয়েছে। ৭৯৯ পৃষ্ঠার বিশাল এই রায়ের ২০১ পৃষ্ঠায় আপিল বিভাগ বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ১৯৯৬ সালে সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হলেও এর পদ্ধতিগত দুর্বলতার কারণে এটি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি (it did not take long time to discover that this system had some  incurable inherent weaknesses)। ফলে আদালত বলছেন, alternatively the Election  Commission should be made more empowered and institutionalized so that the parliamentary elections can always be held fairly. অর্থাৎ নির্বাচন কমিশনকে আরও শক্তিশালী এবং এর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করা দরকার যাতে সব সময়ই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব হয়। সাথে সাথে সর্বোচ্চ আদালত এটিও মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, Unless the National Parliamentary Election is held impartially and independently free from any interference, the democracy cannot flourish. In the absence of credible election, a credible Parliament cannot be established. As a result, our election process and the Parliament remain in infancy. অর্থাৎ যতক্ষণ পর্যন্ত না জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত করা সম্ভব হচ্ছে, ততক্ষণ গণতন্ত্র বিকশিত হবে না। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া গ্রহণযোগ্য সংসদও প্রতিষ্ঠিত হবে না। বরং আমাদের নির্বাচনি ব্যবস্থা ও সংসদ অপরিপক্কই থেকে যাবে।

যারা মনে করেন যে, বর্তমান প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দায়িত্বে থাকা অবস্থাতেই ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউ হবে—তারা ষোড়শ সংশোধনী রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণটুকু খেয়াল করতে পারেন। এখানে বিচারপতি সিনহা সুস্পষ্টভাবেই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার ওপরেই বারবার দিয়েছেন।

ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে ২০১১ সালে যখন আপিল বিভাগ পূর্ণাঙ্গ রায় দেন, তখন বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি হিসেবে আলাদা রায় লেখেন এবং ৭৪৭ পৃষ্ঠার বিশাল ওই রায়ের মধ্যে ৩৪২ থেকে ৫৩২ পৃষ্ঠায় তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বাইরেও দেশের রাজনীতি, বিচারব্যবস্থা, সার্বভৌমত্ব ইত্যাদি বিষয়ে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

তিনিও সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন যে, পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। তবে তত্ত্বাবধয়াক সরকারের প্রধান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত সবশেষ প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কোনও বিচারপতিকে না রাখার পরামর্শ তার। ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের মতো ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়েও বিচারপতি এস কে সিনহা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার পক্ষে মত দিয়েছেন। তিনি লিখছেন, It is hoped that the Parliament shall promulgate necessary laws, during this period and if necessary, to amend the Constitution for institutionalizing and equipping the Election Commission to conduct free and fair Parliamentary.

একটা ভুল কথা অনেক দিন ধরেই রাজনৈতিক মহলে এমনকি গণমাধ্যমেও প্রচলিত হয়ে আছে যে, সংক্ষিপ্ত রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক, সংসদ চাইলে পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে করা যায় বলে পর্য‌বেক্ষণ দিলেও পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিষয়টি উল্লেখ করেননি। এটি ঠিক নয়। বরং পূর্ণাঙ্গ রায়েও বিচারপতি খায়রুল হক পরবর্তী দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনে হতে পারে বলে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছেন (দেখুন ত্রয়োদশ সংশোধনীর পূর্ণাঙ্গ রায়, পৃষ্ঠা ৩৩৭-৩৪২)।

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, আপিল বিভাগে ত্রয়োদশ সংশোধনী রায়ের আপিল শুনানিতে অধিকাংশ অ্যামিকাস কিউরি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রাখা ব্যাপারে মতামত দিয়েছিলেন। সিনিয়র আইনজীবী টি এইচ খান বলেন, ‘ভোট ছিনতাই রোধ করার জন্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল’। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কত বছর বলবৎ থাকা উচিৎ? আদালতের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পঞ্চাশ বছর (দেখুন ত্রয়োদশ সংশোধনী রায়, পৃষ্ঠা ২৯)।

শুনানিতে সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেন বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার মারফৎ নির্বাচনের ধারণা জন্মলাভ করেছিল কারণ নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচন করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ডা. কামাল হোসেন আদালতকে বলেন, রাজনৈতিক দলকে বাঁচানোর জন্য নয়, বরং সংবিধানকে রক্ষা করার জন্য ত্রয়োদশ সংশোধন প্রয়োজন।

সিনিয়র আইনজীবী রফিক উল হকও আদালতকে বলেছিলেন যদি ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা হয় তাহলে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। নির্দলীয় ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এখনও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ক্ষমতাশীল দল বা প্রধান বিরোধীদল সঠিক আচরণ করছে না। পরস্পরের প্রতি তারা সম্মানজনক আচরণ করছে না। রফিকুল হক আদালতকে বলেন, বিচারকদের প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টা হওয়া উচিত নয়। 

সিনিয়র আইনজীবী মাহমুদুল ইসলামের মতে, বাংলাদেশের জনগণের বর্তমান রাজনৈতিক পরিপক্কতা অনুযায়ী দেশের ও সংবিধানের গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের  বিকল্প নেই। তিনি মনে করেন, গণতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখার জন্য স্বল্প সময়ের জন্য গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা স্থগিত রাখা দোষের নয়।

তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণার সমালোচনা করে সিনিয়র আইনজীবী ড. এম. জহীর বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি এই ধারণাই দেয় যে, সকল রাজনৈতিক দলই অসাধু এবং তাদের ওপর একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনা করার ব্যাপারে আস্থা রাখা যায় না। স্বীকৃত মতেই যদি অসততার অজুহাতে একটি অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচন পরিচালনার জন্য তাদের ওপর আস্থা রাখা সম্ভব না হয় তাহলে দেশ পরিচালনার জন্য কিভাবে তাদের ওপর আস্থা রাখা যায়? তিনি মনে করেন, এই অবস্থা হতে উত্তরণের একমাত্র উপায় হলো স্বতন্ত্র তথা আলাদা বাজেটসম্বলিত একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন।

অনেকে মনে করেন (বিএনপি আশা করে), ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের ধারাবাহিকতায়ই ত্রয়োদশ সংশোধনীর রিভিউ হবে এবং তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল হবে। কিন্তু আদতে সেটির সম্ভাবনা কতটুকু এবং আদৌ সে পথে সর্বোচ্চ আদালত যাবেন কিনা—তা এখনই বলা মুশকিল। তবে বর্তমান নির্বাচন ব্যবস্থা, সংসদ ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিয়ে যে প্রধান বিচারপতি মোটেও সন্তুষ্ট নন, তা ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে পরিষ্কার। এবং তিনি রায়ে দেশের যেসব সংকট চিহ্নিত করেছেন, যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, সেখানে খুব নতুন কিছুও নেই। বরং দেশের মানুষের মনে এসব বিষয় নিয়ে প্রশ্ন ও সংশয় ছিলই। বরং এই রায়ে সাধারণ মানুষের সেই কথাগুলোই তিনি তার বিচারিক ভাষায়, পাণ্ডিত্যপূর্ণ কথামালায় গুছিয়ে লিখেছেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার সম্পর্কিত ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় প্রকাশ এবং সেই আলোকে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের এতদিন পরে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রিভিউ আবেদন করা যাবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যদিও এক্ষেত্রে বিএনপি নেতা মওদুদ আহমদের বাড়ির মামলার উদাহরণ আছে। তার রায়ের ৭ বছর পর আপিল ফাইল করা হয়। সুতরাং ‘কনডোলেশন অব ডিলে’ অর্থাৎ বিলম্বের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে রিভিউ আবেদন করা যাবে বলে আইনজ্ঞরা মনে করেন।

সংসদের বাইরে সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বিএনপি অনেকদিন ধরেই বলে আসছে যে, একাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে তারা নির্বাচনকালীন একটি সহায়ক সরকারের রূপরেখা তুলে ধরবে। শোনা যাচ্ছে কোরবানির ঈদের পরে লন্ডন থেকে ফিরে বেগম জিয়া এই উদ্যোগ নিতে পারেন। যদিও সংবিধানে সহায়ক সরকার বলে কোনও বিষয় নেই। ফলে বিএনপি যে রূপরেখাই দিক না কেন, সেটি মানতে গেলে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। যদিও ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায়ে আপিল বিভাগ অস্ট্রেলিয়ার উদাহরণ টেনে লিখেছেন, সে দেশে ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ বলতে গভর্নর কর্তৃক পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার পর হতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান পর্যন্ত সরকারকে বুঝিয়ে  থাকে। নির্বাচনের পরেও স্বল্প সময়ের জন্য, যতক্ষণ পর্যন্ত পরবর্তী মন্ত্রিসভা গঠিত না হবে, ততক্ষণ এই সরকার ক্ষমতায় থাকতে পারে। অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ায় কোনও আলাদা ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার’ নিযুক্তির প্রয়োজন হয় না।

আমাদের বর্তমান সংবিধান মতেও নির্বাচনের পূর্ববর্তী নব্বই দিন যেহেতু সংসদ বসবে না বলে বিধান রয়েছে, তাই এই সময়কালকে একধরনের অন্তর্বর্তী সরকার বলা হচ্ছে। কিন্তু বিপত্তি বেঁধেছে অন্তর্বর্তী হলেই সেটি নির্বাচনকালীন সহায়ক অর্থাৎ এমন সরকার হবে কিনা যারা নির্বাচনে কোনও ধরনের প্রভাব বিস্তার করবে না বা করতে পারবে না, অর্থাৎ নির্বাচন কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারবে। এই নিশ্চয়তাটুকু নেই বলেই তত্ত্বাবধায়ক, অন্তর্বর্তী, সহায়ক ইত্যাদি শব্দ নিয়ে এত এত কথা।

লেখক: সাংবাদিক

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
ট্রলারের ইঞ্জিন বিস্ফোরণে চার জন অগ্নিদগ্ধ
প্রিয় দশ
প্রিয় দশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ সম্পর্কিত প্রকল্প নির্ধারিত সময়ে শেষ করার নির্দেশ
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
বাংলাদেশে চীনের উদ্যোক্তাদের বস্ত্র ও পাট খাতে বিনিয়োগের আহ্বান নানকের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ