X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা ইস্যু, বন্ধুহীন বাংলাদেশ!

গোলাম মোর্তোজা
৩০ আগস্ট ২০১৭, ১৭:২৮আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০১৭, ১৭:৩১

গোলাম মোর্তোজা মানুষ ছিল মানুষ আছে, সংখ্যা আরও বাড়ছে। ভূমি ছিল, ভূমি আছে; কিন্তু অধিকার নেই। অথচ এক সময় তারা স্বাধীন সার্বভৌম রাজ্যের বাসিন্দা ছিল। এখন তারা পৃথিবীর অন্যতম ‘ভূমির অধিকারহীন’ জাতি। বলছি রোহিঙ্গাদের কথা। আগের বার্মা, বর্তমান মিয়ানমারের পশ্চিমের রাজ্য রাখাইনের বাসিন্দা তারা।
মধ্যযুগের বার্মার রাজসভার লেখকেরা আজকের রাখাইন রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য নামে লিখে গেছেন। রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতন-হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসটা হাজার খানেক বছর আগের। এত পেছনে ফিরছি না।
মিয়ানমার স্বাধীন হয় ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি। তখন রোহিঙ্গাদের ভোটাধিকার ছিল, সংসদে প্রতিনিধি ছিল। ১৯৬২ সালে সামরিকজান্তা নে উইন ক্ষমতা দখল করেন। এরপর থেকে রোহিঙ্গারা ভিন্নমাত্রার নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়। সেই থেকে দীর্ঘ সামরিক শাসন চলছে, চলছে হত্যা-নিপীড়ন-বিতাড়ন। যদিও এখন এক ধরনের গণতান্ত্রিক আবরণ দেওয়া হয়েছে। নিপীড়ন হত্যা বিতাড়ন বন্ধ হয়নি। সামরিকজান্তা ক্ষমতা দখলের পর রোহিঙ্গাদের সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করা হয়। ভোটাধিকার শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার সব সুযোগ কেড়ে নেওয়া হয়।
সামরিক বাহিনীর হত্যা-নিপীড়নের মুখে ১৯৭৭-৭৮ সালে দুই লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। ১৯৯১ সালে আশ্রয় নেয় আড়াই লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। ২০১২, ২০১৪, ২০১৬ সালেও সামরিকজান্তা রোহিঙ্গা নিধন চালায়। এই সময়েও প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নির্বিচারে রোহিঙ্গা হত্যার কারণে সুচির তথাকথিত বেসামরিক সরকার আন্তর্জাতিক চাপে পড়ে। ফলে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হয়। সুচির অনুরোধেই এই কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করে রিপোর্ট দেয় চলতি বছরের ২৪ আগস্ট। সেদিনই আবার রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আক্রমণের অজুহাতে অভিযান শুরু করে সামরিক বাহিনী। এবার হাজার খানেক রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। বর্তমান সংকট পর্যন্ত ইতিহাসটা মোটামুটি এ রকম। বাংলাদেশে প্রায় ৬ থেকে ৭ লাখ রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গা নিধন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখলেও, এত বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ কী করছে? আজকের বিশ্লেষণটা সেই আলোকে। গণমাধ্যমে যে সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে, তার বাইরে বান্দরবান-মিয়ানমার সীমান্ত অঞ্চলের একাধিক সূত্র, মিয়ানমারের অবস্থানরত একাধিক সূত্র এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বিস্তীর্ণ জনপদে ঘুরে কাজ করার অভিজ্ঞতা, দেখা-জানার ভিত্তিতে আজকের এই লেখা।
১. হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাফ নদী তীরবর্তী সীমান্তে অবস্থান করছে। নৌকায় এসে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছে। বিজিবি প্রতিরোধ করছে। কিছু ঢুকে পড়ছে। গণমাধ্যম এসব সংবাদ সচিত্র প্রচার করছে। বান্দরবান অঞ্চলে মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্ত প্রায় ১৭৮ কিলোমিটার। সীমান্তের এই অঞ্চলটা গহীন পাহাড় জঙ্গল। মিয়ানমার সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে, টইলের জন্য রাস্তা তৈরি করেছে। রোহিঙ্গাদের নির্যাতন-হত্যা করছে। কাঁটাতারের বেড়া খুলে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসার সুযোগ করে দিচ্ছে। গত তিন দিন ধরে নাইক্ষ্যংছড়ির চাকডালা বিতয়ছড়ির ৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় বাংলাদেশ সীমান্তের তিনশ গজের মধ্যে প্রায়  ৫ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এমন আরও দু’টি স্থানে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। বিজিপি পাহারা দিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। এর বাইরেও এই এলাকা দিয়ে আরও রোহিঙ্গা বাংলাদেশ ঢুকছে।
এই সংবাদ আমাদের গণমাধ্যমে নেই বললেই চলে।

২. গত ২৪ আগস্ট থেকে আবার শুরু হওয়া এই সংকটের সময়ে একটি কথা বার বার আলোচনা করা হচ্ছে যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দিয়ে মিয়ানমারকে চাপ দিতে হবে। বাংলাদেশের উচিত সমস্যাটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু গত চার পাঁচ দিনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীকে এ বিষয়ে কোনও কথা বলতে দেখা যায়নি।
মিয়ানমার সরকারের সবচেয়ে বড় শক্তির উৎস চীনের অব্যাহত সমর্থন। চীনের সমর্থনের কারণ বাণিজ্য। মিয়ানমারের বিপুল প্রাকৃতিক সম্পদ, বিশেষ করে গ্যাসসম্পদ রয়েছে। মিয়ানমারের স্থল-সমুদ্র থেকে চীন গ্যাস উত্তোলন করছে এবং নিয়ে যাচ্ছে অনেক বছর ধরে।

ভারতের রিলায়েন্স কোম্পানি মিয়ানমারে গেছে। সমুদ্রে বাংলাদেশ ব্লক সংলগ্ন মিয়ানমারের ব্লকে গ্যাস সন্ধান করছে এবং বিপুল গ্যাসের মজুদের সন্ধান পেয়েছে। এই গ্যাস রিলায়েন্স নিজের দেশ ভারতে নিয়ে যেতে চায়।
সনি, প্যানাসনিকসহ জাপানের বড় বড় ২৪টি কোম্পানি মিয়ানমারের বিশাল শিল্প পার্কের কাজ শুরু করেছে ৩ বছর আগে থেকে। ১ হাজার ৩০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ শিল্পপার্কের কাজ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।

চীন, ভারতের আরও অনেক কোম্পানি মিয়ানমারে ব্যবসা করছে, ব্যবসার পরিকল্পনা করছে। বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশেরও কেউ কেউ গেছেন মিয়ানমারে।
সুচি সরকারের আগে পর্যন্ত মিয়ানমার বিষয়ে আমেরিকার কিছুটা কঠোর অবস্থান ছিল। এখন আমেরিকার অবস্থানও নমনীয়।
চীন নীরব থেকে মিয়ানমার সরকারকে সমর্থন করে যাচ্ছে। ভারত বর্তমান সংকটের শুরুতেই মিয়ানমার সরকারের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের পাশে কে বা কারা আছে? পাশে রাখার জন্যে বাংলাদেশ কী করছে?
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের হৃদ্য  সম্পর্ক বিরাজমান। ভারত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সরকারের পক্ষে অবস্থানের কথা বলতেই পারে। কিন্তু বাংলাদেশ যে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে ভয়ঙ্কর বিপদে পড়েছে, সে ক্ষেত্রে ভারতের কাছে কোনও সহায়তা বাংলাদেশ চেয়েছে? কোনও সূত্রই বলছে না যে, বাংলাদেশ এ বিষয়ক কোনও আলোচনা ভারতের সঙ্গে করেছে।
চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। মিয়ানমার সামরিক বাহিনী সন্ত্রাসের অজুহাতে রোহিঙ্গাদের নিপীড়ন-হত্যা বন্ধে চাপ দেওয়ার ক্ষেত্রে চীনের সহায়তা কতটা নেওয়া যায়, সেই চেষ্টাও বাংলাদেশকে করতে দেখা যায়নি।
ঢাকায় মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিস ওয়েলস মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশের বাইরে আর কিছু বলেননি। পোপ মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশে আসবেন। তিনিও মিয়ানমারের ওপর কোনও চাপ দেবেন, যেন গণহত্যা বন্ধ হবে, তার সম্ভাবনা নেই।
তাহলে যে আন্তর্জাতিক চাপের কথা বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ কাজটি কিভাবে করবে, কার বা কাদের মাধ্যমে করবে?
মিয়ানমার ইস্যুতে চীন, ভারত এমনকী আমেরিকা তো মিয়ানমারের বন্ধু, বাংলাদেশের নয়। দেখা যাচ্ছে, এই ইস্যুতে বাংলাদেশ বন্ধুহীন। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, চীন-ভারত বা আমেরিকার কাছে পরিস্থিতির ভয়াবহতার  বিষয়টি বাংলাদেশ তুলেই ধরতে পারছে না।
জাতিসংঘে যাওয়ার কথা বলা হতে পারে। কিন্তু আমেরিকা-চীন-ভারতের সমর্থন ছাড়া সেখানে গিয়ে কোনও ফল যে হবে না, তা বোঝার জন্য কূটনৈতিক জ্ঞান না থাকলেও চলে।
৩. এবার দেখা যাক অভ্যন্তরীণভাবে বাংলাদেশ কী করছে?
বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৬ থেকে ৭ লাখ। ইউএনএইচসিআর-এর নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা মাত্র ৩৫ হাজারের মতো। বাকি রোহিঙ্গাদের ইউএনএইচসিআর'কে দিয়ে বাংলাদেশ তালিকাভুক্তও করতে পারেনি। টেকনাফ-বান্দরবান-কক্সবাজারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের এখন মিয়ানমার বলছে. ‘বাঙালি সন্ত্রাসী’। বাঙালি হিসেবে তাদের পরিচিত করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও কাজ করছে। এক্ষেত্রে  বাংলাদেশ সরকারের কোনও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের আসার সুযোগ দেওয়ার জন্যে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে। বাংলাদেশের নীতি রোহিঙ্গাদের ঢুকতে দেওয়া হবে না। বাস্তবে রোহিঙ্গারা ঢুকছে। ঠেকানো যাচ্ছে না, সম্ভবও না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় জানছে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিচ্ছে না, বাস্তবে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশেই আশ্রয় পাচ্ছে। সংস্থাগুলো ঢুকতে দেওয়ার চাপ বাংলাদেশকে দিলেও নিবন্ধন করছে না। ফেরত নেওয়ার জন্যে মিয়ানমারকে চাপও দিচ্ছে না।

আশির দশক থেকে রোহিঙ্গাদের দলে ভিড়িয়ে রাজনীতি করেছে বিএনপি-জামায়াত। এরপর এই রাজনীতির মধ্যে ঢুকেছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা রোহিঙ্গাদের ভোটার বানিয়ে ‘ভোট ব্যাংক’ তৈরি করেছেন। টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি তোলার সুযোগ করে দিয়েছে। পাসপোর্ট করে বিদেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। ইয়াবা ব্যবসায় ব্যবহার করছে রোহিঙ্গাদের।
৪. মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু না করলেও অদ্ভূতভাবে ‘যৌথ অভিযান’-এর প্রস্তাব দিয়েছে। মিয়ানমার রাজি হলে এখন মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী যে অভিযান পরিচালনা করছে, তার সঙ্গে যুক্ত হবে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী! মিয়ানমার রাজনৈতিক-জাতিগত সমস্যাকে সামরিক উপায়ে মোকাবিলা করছে, নিপীড়ন হত্যা-বিতাড়ন করছে, বাংলাদেশও সেই প্রক্রিয়া যুক্ত হবে?
এরই  পরিপ্রেক্ষিতে কী ঘটতে পারে? মিয়ানমারের ভেতরের প্রতিরোধ বা পরিস্থিতিটা একটু বোঝা দরকার।
ক. ‘রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন’ (আরএসও) এক সময় মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধের চেষ্টা করেছিল। বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে এখন আরএসও-এর অবস্থান থাকলেও তারা দুর্বল হয়ে পড়েছে। ‘আরাকান আর্মি’ (এএ) নামে আরেকটি সংগঠন বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড সীমান্ত অঞ্চলে রয়েছে। ‘আরাকান লিবারেশন পার্টি’ (এএলপি) নামক আরেক গ্রুপ তৈরি হয়েছে ‘আরাকান আর্মি’ থেকে বেরিয়ে গিয়ে। তাদের অবস্থানও বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ড সীমান্তে। যদিও মিয়ানমার দাবি করে ‘আরাকান আর্মি’ এবং ‘আরাকান লিবারেশন পার্টি’র অবস্থান বাংলাদেশের ভেতরে। বাংলাদেশ থেকে গিয়ে তারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। জানা যায়, আরএসও, এএ, এএলপি এখন আক্রমণে সক্রিয় নয়।
আক্রমণে সক্রিয় ‘আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি’ (এআরএসএ)। যারা ‘আরসা’ নামে পরিচিত। গত ২৪ আগস্ট ‘আরসা’ এক যোগে ৩৪টি মিয়ানমার সামরিক চৌকিতে আক্রমণ করে। এতে ‘আরসা’র কয়েকশ সদস্য অংশ নেয়। আক্রমণে ১২ জন সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং ৮৭ জন আরসা সদস্য নিহত হয়। তারপর থেকেই মিয়ানমার সামরিক বাহিনী শুরু করেছে রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ।
‘আল ইয়াকিন’ নামে পরিচিত সংগঠনটি ‘আরসা’ নামে আত্মপ্রকাশ করে ২০১২ সালে। এদের অবস্থান মিয়ানমারের ভেতরে। আরাকান রাজ্যে বছরের পর বছর ধরে সামরিক বাহিনী নিপীড়ন করছে। রোহিঙ্গারা স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে না। ফসল উৎপাদন করতে পারে না। ঘরে ৪ ইঞ্চির চেয়ে বড় কোনও চাকুও রাখতে পারে না। সামরিক বাহিনীর নির্যাতন, ক্ষুধা-কষ্ট তাদের নিত্যাসঙ্গী। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে কাজ করেছে ‘আরসা’। অনেকটা ‘হামাস’-এর মতো। অর্থ-খাদ্য সহায়তা দিয়ে রোহিঙ্গাদের আস্থা অর্জন করেছে ‘আরসা’। একসময় সশস্ত্র সংগ্রাম করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগোষ্ঠীর কারও কারও যাতায়াত আছে এই অঞ্চলে। এসব তথ্যের উৎস তারাই। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘আরসা’র হাতে প্রচুর নগদ অর্থ আছে। ‘আরসা’র সদস্যদের হাতে আগে পুরনো রাইফেল জাতীয় অস্ত্র দেখা যেত। গত বছরখানেক ধরে তাদের হাতে নতুন একে-৪৭ রাইফেল দেখা যাচ্ছে। সংখ্যায়ও অনেক। এছাড়া তারা স্থানীয়ভাবে কিছু বন্দুক জাতীয় অস্ত্র ও গ্রেনেডের মতো হাত বোমা বানাতে শিখেছে। তারা নিশ্চিত নয়, তবে শুনেছে যে, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর মাধ্যমে ‘আরসা’ অস্ত্র-অর্থ পেয়ে থাকে। আরব আমিরাত, সৌদি আরব তাদের অর্থের উৎস। লন্ডনে এবং দুবাইতে ‘আরসা’র নেতারা অবস্থান নিয়ে কাজ করছে। তাদেরই একজন সম্প্রতি হংকংয়ের গণমাধ্যম এবং আল জাজিরার সঙ্গে কথা বলেছে। ‘আরসা’র কোনও আলাদা পোশাক নেই। পাহাড়-জঙ্গলে সাধারণ মানুষের সঙ্গেই তাদের অবস্থান। ‘আরসা’র সক্রিয় অস্ত্রধারী সদস্য দুই হাজারের বেশি হবে বলে তাদের ধারণা। সম্প্রতি ৩৪টি ক্যাম্পে আক্রমণে অংশ নিয়েছিল ‘আরসা’র প্রায় ৭০০ সদস্য। এখন সামরিক বাহিনী অভিযান চালাচ্ছে। আর ‘আরসা’ সুযোগ বুঝে চোরাগোপ্তা আক্রমণ করছে। পাহাড়-জঙ্গল এবং ‘আরসা’র নিজস্ব পোশাক না থাকায়, সামরিক বাহিনী নিরীহ মানুষ হত্যা করতে পারলেও ‘আরসা’কে দুর্বল করতে পারছে না।
এমন অবস্থায় মিয়ানমারের সঙ্গে যৌথ অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশ কী অর্জন করবে? বাংলাদেশ অভিযান চালাতে মিয়ানমার ঢুকবে, মিয়ানমার ‘এএ’ ‘এএলবি’র সন্ধানে বাংলাদেশের ভেতরে ঢুকবে? ‘আরএসও’র সন্ধানে নাইক্ষ্যংছড়িতে অভিযান চালাবে মিয়ানমার-বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী?
বাংলাদেশের দেওয়া যৌথ অভিযানের প্রস্তাবটি সুবিবেচনা প্রসূত— তা বলা যাচ্ছে না।

৫. রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবান, কক্সবাজার, টেকনাফ অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক চিত্র বদলে দিয়েছে। একটি উদাহরণ:
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মোট লোকসংখ্যা ৫৭ হাজার। এর মধ্যে মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সময়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার! যারা এখন বাংলাদেশের নাগরিক। ১৭ হাজার সেটেলার বাঙালি এবং ১০ হাজার মারমা ও অন্যান্য পাহাড়ি জাতি গোষ্ঠী। নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের চেয়ারম্যান তমলিম ইকবাল চৌধুরী সাবেক আরএসও নেতার ছেলে।
এই বাস্তবতায় আমরা তর্ক-বিতর্ক করছি মানবতার কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়া উচিত কি উচিত না, তা নিয়ে। বিএনপি আশ্রয় দিতে বলছে, আন্তর্জাতিক সংস্থা সীমান্ত খুলে দিতে বলছে। সরকারের অবস্থান আশ্রয় দেওয়া হবে না, আবার প্রধানমন্ত্রী মানবিক আচরণ করতে বলছেন। বাস্তবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় না দিয়ে বাংলাদেশের সামনে আর কোনও পথ খোলা নেই। ঠেকানোও সম্ভব নয়। বাস্তবতা মেনে নিয়ে তাদের আশ্রয় দেওয়া উচিত একটা প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। যত লাখ হোক না কেন, রোহিঙ্গাদের রাখতে হবে একটি নির্দিষ্ট এলাকায়, কঠোর নজরদারিতে। যারা সীমান্ত খুলে দিতে বলছে, তাদের থেকে সহায়তা নিতে হবে। তালিকাভুক্ত করতে হবে সব আশ্রিত রোহিঙ্গার। চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে দেওয়া যাবে না।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে আমন্ত্রণ জানিয়ে বাংলাদেশে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিতে পারে বাংলাদেশ। তাতে মিয়ানমারের ওপর একটা চাপ তৈরি হবে। অবরোধের মতো চাপ মিয়ানমারের ওপর প্রয়োগ না করলে, কাজের কাজ কিছু হবে না। মুসলিম দেশ ও সংগঠন, ‘ওআইসি’ নীরব। সেখানেও বাংলাদেশের কোনও তৎপরতা নেই। কিন্তু সামগ্রিকভাবে কাজগুলো করার জন্যে রাষ্ট্রীয়ভাবে বাংলাদেশের যে সক্ষমতা থাকা দরকার, তা নেই। ফলে একটা জটিল ও বিপজ্জনক দীর্ঘমেয়াদি সংতটে পড়ে গেছে বাংলাদেশ। উত্তরণের পথ দৃশ্যমান নয়, আরও বড় সংকটের আশঙ্কা দৃশ্যমান।

লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক

এসএএস/এমএনএইচ

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
ইরান-সমর্থিত ইরাকি সেনা ঘাঁটিতে বিস্ফোরণ, নিহত ১
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অ্যাসেম্বলি বন্ধ
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
দ্বিতীয় বিয়ের চার দিন পর বৃদ্ধকে হত্যা, দুই ছেলে পলাতক
লখনউ ও চেন্নাইয়ের অধিনায়ককে ১২ লাখ রুপি জরিমানা 
লখনউ ও চেন্নাইয়ের অধিনায়ককে ১২ লাখ রুপি জরিমানা 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ