X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারতের ভণ্ড ‘গুরুজি’ বনাম বিশ্বাসের ভাইরাস

চিররঞ্জন সরকার
৩১ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৩০আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৩৩

চিররঞ্জন সরকার তিনি একই সঙ্গে গায়ক, নায়ক আবার স্বঘোষিত ধর্মগুরু। টুইটারে তার পরিচয় আরও দীর্ঘ— দার্শনিক, খেলোয়াড়, নায়ক, চিত্রপরিচালক, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক, লেখক, সুরকার, জীবনীকার... আরও কত কী! নিজস্ব ওয়েবসাইটে তিনি, ‘সাধু চিকিৎসক গুরমিত রাম রহিম সিংহ জি ইনসান’। আর ফিল্মে তিনি ভগবানের দূত, ‘মেসেঞ্জার অব গড’। আর আদালতের রায় মতে, তিনি একজন ধর্ষক!
আমাদের এই ভারতবর্ষে আধ্যাত্মিক গুরুদের কমতি নেই বললেই চলে। তাদের বিভিন্ন ধর্মবিরোধী কার্যকলাপ সকলেরই কম-বেশি জানা আছে। তাদের কেউ কেউ স্বর্গে যাওয়ার অগ্রিম টিকেট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। জীবনের সকল মুশকিলের আহ্সান করেন। নিদান দেন সব সমস্যার। ‘আধ্যাত্মিকতা’র আড়ালে বিভিন্ন ধরনের কেলেঙ্কারিতে তারা লিপ্ত থাকেন। নানা অপকর্ম ও বেপরোয়া যৌনাচার করেন।
এই ‘গুরুজি’ বা মহান ‘বাবা’ এবার আর পার পাননি। আদালত পৃথক দুটি ধর্ষণ মামলায় তাকে দশ বছর করে বিশ বছর কারাদণ্ড দিয়েছে। আর এই ধর্ষককে দোষী সাব্যস্ত করার জেরে প্রাণ গেছে অন্তত ৩৭ জনের। আহত ৩০০। হরিয়ানার এই নজিরবিহীন ঘটনার কথা শুনে বিস্মিত গোটা দুনিয়া। এই ধর্ষক আবার ‘গুরুজি’। নিজেকে তিনি ‘মেসেঞ্জার অফ গড’ বা ঈশ্বরের দূত বলে দাবি করেন। ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরেই ভক্তদের তাণ্ডব শুরু হয়।  

আইনের চোখে তার ‘দেবত্ব’ কাজে আসেনি, সেখানে তিনি ‘ইনসান’ অর্থাৎ এক সাধারণ মানুষ। বিশেষ আদালত সেটাই বুঝিয়ে দিয়েছে। ১৫ বছর ধরে চলা ধর্ষণের মামলায় তিনি শেষপর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। এই ‘সাধুবাবা’ সত্যিই একটি বর্ণময় চরিত্র। হরিয়ানা-পাঞ্জাবে অন্তত ৫ লক্ষ সরাসরি ভক্ত আছে গুরমিত রাম রহিমের। তাদের দাবি, সারা বিশ্বে গুরু রাম রহিমের ছয় কোটি ভক্ত আছে।

তবে বিতর্ক সব সময় রাম রহিম সিংকে তাড়িয়ে বেরিয়েছে বা তিনি নিজেই বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।তিনি ডেরা সাচ্চা সৌদা নামের একটি সম্প্রদায়ের নেতা। হরিয়ানার সিরসায় তার প্রকাণ্ড হাই-টেক আশ্রম।তাকে সবসময়ে ঘিরে থাকে সশস্ত্র ব্যক্তিগত রক্ষীর দল।শিখ, হিন্দু, মুসলিম সব ধর্মের চেতনার মিশেলেই তৈরি হয়েছে তার ধর্মীয় সম্প্রদায়। ডেরা সাচ্চা সৌদার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৪৮ সালে। শাহ মস্তানা নামের এক ধর্মগুরু এর পত্তন করেন। বর্তমান প্রধান গুরমিত সিং ১৯৯০ সালে সম্প্রদায়ের নেতৃত্বের ভার নেন।

অনেকগুলো চলচ্চিত্র তিনি তৈরি করিয়েছেন, আর সেই সব ছবিতে নিজেই নানা রকম স্টান্ট দেখান তিনি। যেগুলো হরিয়ানা, পাঞ্জাবসহ উত্তরপ্রদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের যুবক, নারীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়।

হরিয়ানার সিরসায় তার ডেরা সাচ্চা সৌদা আশ্রমের প্রাঙ্গণে নিয়মিত বসে পপ কনসার্ট। সেখানে গান ডেরার প্রধান, গুরমিত রাম রহিম সিং নিজেই-তার তুমুল জনপ্রিয় ‘ইউ আর মাই লাভ চার্জারে’র মতো আরও অনেক গান! চাকচিক্যময় পোশাক পরে গানের ভিডিওতে পারফর্ম করার জন্য তাকে অনেকে ‘রকস্টার বাবা’ নামে অভিহিত করেছেন।

তিনি তিনটি সিনেমা তৈরি করেছেন যেগুলো অনেক বিতর্কের পর কয়েকটি ভারতীয় ভাষায় মুক্তি পায়।এই সিনেমাগুলির একটি, ‘এমএসজি: মেসেঞ্জার অফ গড’-এর ট্রেইলারে মি. সিংকে দেখা যায় বিভিন্ন স্টান্ট পারফর্ম করতে, অন্য গ্রহের বাসিন্দা, ভুত এবং হাতীর সাথে লড়াই করতে এবং খলনায়কদের শায়েস্তা করেতে।‘এমএসজি: মেসেঞ্জার অব গড’ সিরিজের যে সিনেমাগুলোতে বাবা রাম রহিম নিজেই নায়ক গুরুজির অভিনয় করেছেন, হাজার হাজার গাড়ির কনভয় নিয়ে সেই ছবি দেখতে এসে তার ভক্তরা একাধিকবার দিল্লির কাছে গুরগাঁও অচল করে দিয়েছেন!

যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ, দত্তক মেয়ের সঙ্গে যৌনতা, সাংবাদিক হত্যা, অরাজকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সমাজবিরোধীদের মধ্যে টাকা ছিটানো, সবই তিনি করেছেন। অন্তত চারশ পুরুষ-ভক্তকে নপুংসক বানিয়ে দিয়েছেন। তিনি নিজে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা পেয়েছেন। ভোগ করেছেন চরম বিলাসবহুল জীবন।

অসংখ্য নারীর অভিশাপ আর চোখের জলে এই ‘সাধুবাবা’ নিজের যাবতীয় কাম ও লালসা চরিতার্থ করেছেন। অথচ থানা-পুলিশ-আইন-প্রশাসন-সমাজ নীরব ভূমিকা পালন করেছে। আবারও প্রমাণ হয়েছে, পৃথিবীটা কার গোলাম?

বর্তমান জমানায় এ ধরনের গুরুজি কিংবা কোনও ‘আধ্যাত্মিক’ দাবিদার ব্যক্তি এমনি এমনি পয়দা হয় না। তাদের ‘পয়দা করা হয়’ (created)। অর্থাৎ একশ্রেণির মানুষ তাদের সৃষ্টি করেন। আর রাষ্ট্র কিংবা রাষ্ট্রের কর্তাব্যক্তিরা তাদের লালন-পালন করে ধন্য হয়।

এই ‘গুরুবাবা’ কিংবা সুপারম্যান তৈরি হয় বিজ্ঞাপনের যুক্তি মেনে। বিজ্ঞাপনের জোরে মানুষ যেমন একটি হেলথ ড্রিংককে দীর্ঘ দিন ধরে ‘পরিবারের মহান পুষ্টিদাতা’ হিসেবে বিশ্বাস করে এসেছে। ঠিক তেমনি রটিয়ে দেওয়া হয়, উনিই গুরুবাবা, ওনার আধ্যাত্মিক শক্তি আছে। তাদের সামান্য একটা ফুতেই যেকোনও জটিল-কঠিন-মারাত্মক ব্যাধির উপশম ঘটে৤ এসব প্রচারের জন্য কিছু চেলা-চামুন্ডাও জুটিয়ে নেওয়া হয়। কেউ হয়তো এমনি এমনিই কোনও বালাই কিংবা সমস্যা থেকে থেকে রেহাই পেয়ে যান৤ কিন্তু ঝড়ে বক মরার মতো আমাদের দেশে এটাকেও পীর-ফকিরের কেরামতি হিসেবে দেখানো হয়। ভারতবর্ষে লোক ঠকানোর, বড়লোক হওয়ার এটাও একটা কৌশল।

আমাদের সমাজে মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে কত শত যে সাধু-বাবা জন্ম নিয়েছে তার কোনও ইয়ত্তা নেই। তাদের আধ্যাত্মিক গুণের কথা মুখে মুখে প্রচার করা হয়। একজনের মুখ থেকে আরেক জন, তার থেকে আরেকজন৤ এভাবেই প্রচার-প্রপাগাণ্ডায় বিশ্বাসের ভাইরাস ছড়িয়ে তাদের ভক্তকূল সৃষ্টি হয়। অনেকই জ্বিনের বাদশা, ন্যাংটা বাবা, ‘মেসেঞ্জার অব গড’ হিসেবে রাতারাতি খ্যাতিমান হয়ে উঠেন।

রাম রহিমের গল্পটাও যে সুপারহিরো নির্মাণেরই আখ্যান। এমন ভাবে এই বাবাদের নির্মাণ করা হয়, যে ভক্তরা বাবাকে সব কিছুর ঊর্ধ্বে বলে মানতে শুরু করে। তারা প্রতারণা করতে পারেন না। মিথ্যে বলতে পারেন না। ধর্ষণ করতে পারেন না। যে কারণে ভারতের কোটি কোটি মানুষ রাম রহিম নামক ‘বাবা’র একটা ধর্ষণ বা একটা খুনের অভিযোগকে ‘মিথ্যে’ বলে ধরে নিতে পেরেছেন। যেভাবে আমাদের দেশে এক শ্রেণির মানুষ চাঁদে সাঈদীকে দেখতে পেয়েছিলেন!

যারা সমাজে এভাবে পীরবাবা বা গুরুবাবা কিংবা পাগলাবাবা হিসেবে আবির্ভূত হন, তারা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি হিসেবে প্রচার করেন। এতে করে ভক্তদের চোখে তার যাবতীয় দোষত্রুটি ঢাকা পড়ে যায়। চোখে নয়, আসলে মনে। আমরা যাকে পছন্দ করি, সেই লোকটি কোনও দিক থেকে মন্দ হতে পারেন, এই কথাটা বিশ্বাস করা আমাদের পক্ষে মুশকিলের। অতএব, যে তথ্যে আমাদের পছন্দের মানুষের গায়ে কালি পড়ে, সেই তথ্যটিকে হরেক যুক্তিতে অস্বীকার করাই মনের ধর্ম। তাই আমরা নির্বোধের মতো আচরণ করি। গুরুবাবার জন্য জীবন দিতে কিংবা নিতেও পিছ পা হই না!

তবে ভক্তরা সবাই যে হিংসাত্মক হয়, তা নয়। তারা বুঝে উঠতে পারে না কি করা উচিত। গুরু বাবারা কিছু সমাজবিরোধীকে নিয়োগ দেন। কিংবা কিছু কিছু সমাজ বিরোধী নিজ উদ্যোগেই এগিয়ে আসেন। তারাই হিংসাত্মক কার্যক্রম শুরু করেন। এরপর ভক্তকূল সেই ধান্দাবাজদের দেখানো পথ ধরেই হাঁটতে থাকেন। মগজহীন এই ভক্তকূল না ভেবেই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা শুরু করে দেন। অন্যরা যা করছে, বিনা ভাবনায় সেই কাজটাই করতে থাকে প্রত্যেকে!

প্রশ্ন হলো এই যে ‘বাবা’ রাম রহিম, তার এত কোটি ভক্ত হয় কিভাবে? এবং ভক্তির মাত্রা এতই তীব্র যে, শহরে শহরে আগুন ছড়িয়ে দিতে এক নিমেষও লাগে না কেন?

এই প্রশ্নের উত্তর আছে আমাদের চিন্তাহীনতায়, আবেগে, বিশ্বাস নামক ভাইরাসের প্রতি গভীর আসক্তিতে। আর এই বিশ্বাসের ভাইরাসের ভয়ঙ্কর প্রকোপ আমরা দেখতে পাই আজ থেকে পনেরো বছর আগে লেখা এক চিঠিতে। সেই চিঠির প্রতিটি ছত্র মর্মান্তিক, বস্তুতই শিউরে উঠতে হয় পড়লে। এক আশ্রমের দুর্ভেদ্য অন্দরমহল থেকে কোনও ক্রমে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে ওই চিঠি পাঠাতে পেরেছিলেন এক তরুণী। লিখেছিলেন, কিভাবে রাতের পর রাত তিনি এবং তারই মতো আরও অনেক তরুণী গুরুজির লালসার শিকার হচ্ছেন। হচ্ছেন ধর্মের নামে, পারিবারিক ভক্তির নামে এবং সামনে রাখা রিভলভারের নামে, ওই গুরুই বাবা রাম রহিম, শিষ্য তরুণীর গোটা পরিবারই। বছরের পর বছর এই কারবার চালিয়ে এসেছেন এই জালিয়াত, এই গুরুগিরিকে মূলধন করেই।

এই তরুণীর চিঠি মর্মান্তিক এই কারণেই যে, তার ওপর দিনের পর দিন এই অত্যাচারের বিবরণ বিশ্বাস করতে চায়নি তার পরিবারও। বরং জুটেছিল ভর্ৎসনা এই অভিযোগ তোলার জন্য। অবিশ্বাসের পেছনে কোনও যুক্তি ছিল না, ছিল অপার বিশ্বাস। যে বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু। আর কে না জানে ভারতীয় সংস্কৃতি শেখায় এই বিশ্বাসেরই চর্চা, তর্কের নয়। বস্তুত সেই কারণেই এই গুরু ব্যবসায় লগ্নিও বিশেষ করতে হয়নি এই রাম রহিমকে, মূলধন ছড়ানো আছে এ ভারতবর্ষের প্রান্তরে প্রান্তরে। এতএব এই গুরু মাহাত্ম্যের আবরণের আড়ালে হিন্দি ফিল্মে দেখা ভিলেনের চেয়েও কদর্য কাণ্ডকারখানা চালিয়ে এসেছেন শুধু রাম রহিম নয়, আমাদের দেশেরও অনেক বাবাজি। এবং গুরুমহিমার মোহজাল এমনই যে ভক্তসংখ্যা দিনে দিনে আরও বেড়ে ওঠে। সমানুপাতিক ভাবে বাড়ে রাজনৈতিক প্রভাবও।

অতএব দায় আছে আমাদেরও। কারণ আমরা ভুলে গিয়েছি, এ দেশের সংস্কৃতিতে তর্কেরও একটা যোগ্য স্থান ছিল। যুক্তির কোষ্ঠীপাথরে যাচাই না করে আমরা কোনও কিছু গ্রহণ করতাম না। এখন আমরা বিশ্বাসের কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। ধর্মীয় বিশ্বাস, রাজনৈতিক বিশ্বাসসহ যাবতীয় বিশ্বাস আমাদের অন্ধ ও বধির বানিয়ে ফেলেছে। আমাদের নেতৃত্ব, আমাদের ধর্মও তাই-ই চায়। তর্কহীন বিশ্বাস, আনুগত্য। এক সামূহিক বিশ্বাসে ভর করে গড্ডল প্রবাহে নিয়ত প্রবহমান আমরা। কিন্তু এই পরিস্থিতির পরিবর্তন দরকার। আমাদের ফিরতে হবে যুক্তিতর্কের আবহে, পরিমণ্ডলে। যুক্তি-তর্কের আবহ ফিরুক, যুক্তির চর্চা হোক। এই ভণ্ড গুরুদের দিন না হলে কোনও দিনও শেষ হবে না।

লেখক: কলামিস্ট

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
ইউএনআরডব্লিউএ-তে ফের অর্থায়নের পরিকল্পনা জাপানের
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
লিবিয়ায় জিম্মি চট্টগ্রামের ৪ যুবক, পাঠানো হচ্ছে নির্যাতনের ভিডিও
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ