X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

ভারতীয় ‘ধর্মগুরু’

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
৩১ আগস্ট ২০১৭, ১৪:৩৬আপডেট : ৩১ আগস্ট ২০১৭, ১৫:৩০

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী দুজন নারী শিষ্যকে ধর্ষণের দায়ে ভারতের বিতর্কিত ধর্মীয় গুরু গুরমিত রাম রহিম সিং-কে ২০ বছরের সাজা দিয়েছে দেশটির আদালত। মিডিয়ার খবর হচ্ছে, রাম রহিম সিং-এর সাজা নিয়ে প্রথমে কিছুটা ধোঁয়াশা তৈরি হলেও আদালতের কর্মকর্তারা পরে বলছেন, তাকে দুটো মামলার প্রত্যেকটিতে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একটির সাজার মেয়াদ শেষ হলে আরেকটির সাজা শুরু হবে। সেজন্য রাম রহিম সিংকে ২০ বছর সাজা খাটতে হবে।
হরিয়ানার পাঁচকুলাতে রাম রহিমকে ধর্ষণে দোষী সাব্যস্ত করলে তার হাজার হাজার ভক্ত হরিয়ানা, পাঞ্জাব ও দিল্লির বিভিন্ন জায়গায় তুমুল বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন, ট্রেন-বাসও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সহিংসতায় অন্তত ৩৮জন নিহত ও আরও বহু লোক জখম হয়। ৫০ বছর বয়সী গুরমিত রাম রহিম সিংকে এখন বন্দি রাখা হয়েছে জেলে।
ভারতে গুরমিত প্রথম নয়। অনেক গুরুবাবাই সংবাদ শিরোনাম হচ্ছেন বছরের পর বছর। তারা ভক্তদের সঙ্গে প্রতারণা করছেন, শারীরিক-মানসিক শোষণ করছেন। ধর্ষণও সাধারণ ঘটনা। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং ধর্মীয় অন্ধত্বের সুযোগ নিয়েই এইসব হচ্ছে। নরেদ্র মোদির মতো লোকও দেখা যাচ্ছে এই গুরমিত এবং তার অনুসারীদের প্রশংসায় লিপ্ত ছিলেন।

হিন্দু ধর্মের কোনও প্রবর্তক নেই। মুনি ঋষিদের ধ্যান জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে এ ধর্মের ভিত্তি গড়ে উঠেছিলো। ১০৪ টি উপনিষেধই রচিত হয়েছিলো ঋষিদের আশ্রমে। আর এসব উপনিষেধই হচ্ছে আশ্রমে ছাত্রদের অধিবেশনে মুনিদের ভাষণের সমষ্টি। উপনিষেধের অর্থ হলো অধিবেশন। হিন্দু ধর্মের মুনি ঋষিরা সাধনা করে সত্যে উপনিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

মধ্যপ্রাচ্যের নবীদের মতো ভারতের মুনি ঋষিরা কখনও দাবি করেনি যে তারা স্রষ্টার পক্ষ থেকে কোনও প্রত্যাদেশ লাভ করেছেন। বা তারা স্রষ্টার পক্ষ থেকে কোনও ধর্মাদেশ প্রচারের জন্য মনোনিত হয়েছেন। সম্ভবতো সে কারণে রিচ্যুয়ালকে ভারতীয়রা ততোখানি স্পিরিচুয়াল করে তুলতে পারেনি। প্রত্যাদিষ্ট ধর্মগুলো বলেছে মানুষ স্বর্গচ্যুত সত্তা। সব সত্তাই খোদ পরম সত্তার দিকে ধাবমান।

ভারতের ধর্মীয় মনন এক স্রষ্টার সার্বভৌমত্বের প্রতি মনযোগী ছিল না। তারা বহু উপ স্রষ্টা সৃষ্টি করেছেন। সে কারণে স্বর্গীয় পতিত সত্তা হিসেবে তারা এক মহান সার্বভৌম পরম সত্তার দিকে ধাবমান হতে অপরাগ হয়েছেন। আধ্যাত্মিক সাধনায় তাই তারা বিভ্রান্ত বলা হয়। আধ্যাত্মিকতা হচ্ছে পতিত সত্তা হিসেবে মানবকূল চেষ্টা করবে পরম সত্তার কাছে উপনীত হতে। পরম সত্তা হচ্ছে নিষ্পাপ মাসুম, মানব সত্তাকেও নিষ্পাপ মাসুম হিসেবে তার কাছে উপস্থিত হতে হবে। নিজেকে সেই কলুষহীন করার সাধনাই হচ্ছে আধ্যাত্মিক সাধনা।

ফ্রয়েড বলেছেন, দুনিয়াটা সেক্স-এর চাকার ওপর ঘুরছে। ছেলেকে চুমু খাচ্ছে সেটাও সেক্স, স্ত্রীকে চুমু খাচ্ছে সেটাও সেক্স। আবার টাকার পেছনে ঘুরছে সেটাও সেক্স। মানব জাতির উলঙ্গ সেক্স নিয়ে কারবারটাই হচ্ছে বিশ্ব শান্তি বিঘ্নিত হওয়ার প্রধান কারণ।

ভারতীয় সাধক সমাজ নিজেকে সেক্স থেকে মুক্ত করার কোনও প্রয়াসে নিয়োজিত রাখার চেষ্টা করেন না। আমেরিকায় গুরু ভগবান শ্রী রজনীশ (যিনি পরে ওশো নামে পরিচিত হন) গুরু গুরমিত রাম রহিম সিং-এর মতো আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ভগবান শ্রী রজনীশের আশ্রম ছিল জমজমাট আশ্রম। তার নিজস্ব কয়েকটি প্লেন ছিল।

আমেরিকান সরকার পরে উৎঘাটন করে যে, যুবক যুবতিবাই রজনীশের ভক্ত বেশি। এবং তার আশ্রমে যুবক যুবতিরা অবাধ সেক্স করে। আমেরিকার সরকার তাকে আমেরিকা থেকে বিতাড়িত করেছিলো এবং রজনীশ পাঁচ প্লেন মালামাল নিয়ে ভারতে চলে আসেন। ভারত সরকারও তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। পরে গুরু রজনীশ নেপালে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গুরমিত রাম রহিমের আশ্রমও অনেক দিক থেকে রজনীশের আশ্রমের মতোই ছিল।

প্রাচীনকাল থেকে গুরুরা ভারতের আশ্রম ভিত্তিক কর্মকাণ্ডকে উৎসাহিত করেছিলেন। মহামতি গৌতম যখন ধর্ম প্রচার আরম্ভ করেন তখন তিনিও আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার আশ্রমকে ‘সংঘ’ বলা হতো। মহামতি গৌতম মঠের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে একবার নির্দেশ দিয়েছিলেন বালক ভিক্ষুকরা বয়স্ক ভিক্ষুদের সাথে থাকবে না। তিনি বালক ভিক্ষুদের জন্য পৃথক মঠ এর ব্যবস্থা করেছিলেন। মহামতি গৌতমের সিদ্ধান্তে বিক্ষুব্দ হয়ে ৯ শত বয়স্ক ভিক্ষু তাকে ত্যাগ করে।

গৌতম সেক্স এর অনাচার থেকে ভিক্ষু গোষ্ঠীকে বাঁচাতে গিয়ে অনুরূপ বিচ্ছেদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। বৌদ্ধ সন্ন্যাসী এবং খ্রিস্টান সন্ন্যাসীদের মিল ছিল এই যে- উভয়কেই ব্রহ্মচার্য ও দারিদ্র্যের শপথ নিতে হতো। আর অমিল ছিল বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে বাধ্যতার কোনও শপথ নিতে হতো না। আসলে এ পদ্ধতিটার বাস্তবতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। সংসার না করা, মহিলা সংশ্রব থেকে নিজেকে দূরে রাখা-এই তো ছিল সম্পূর্ণ মানব স্বভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান।

ধর্মকে সব সময় যুক্তিবাদী সমন্বয় আদর্শের ভেতর দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হয়। অতিরিক্ত গোড়ামির প্রশ্রয় দিয়ে নীতির কঠিন শাসনে বেঁধে রাখতে গেলে সে ধর্ম টিকতে পারে না।  ভারতে আশ্রম নিয়ন্ত্রণ করার কোনও কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান নেই ইউরোপের রোমান চার্চের মতো। তাই দেখা যায় অনেক সময় আশ্রম নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থার মধ্যে থাকলে আর ধর্মগুরুদের মর্জির ওপর ধর্মের নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিলে সেখানে নৈরাজ্য আসবে আর তার সুযোগ নেবে রজনীশ আর গুরমিতরা।

২০১৪ সালের পর থেকে ভারতের মোহন্তরাই শাসন ক্ষমতায়। আসলে এখন ভারত চলে নাগপুর আশ্রমের নিয়ন্ত্রণে, যদিওবা বিজেপি ক্ষমতায়। নাগপুর আশ্রমই হচ্ছে আরএসএস- এর হেড কোয়ার্টার। বিজেপি হচ্ছে আরএসএস-এর রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, ভাইস প্রেসিডেন্ট ভেনকেডা নাইডুরা হচ্ছেন আরএসএস- এর ক্যাডার।

উত্তর প্রদেশ আর উত্তরাখল্ডের মুখ্যমন্ত্রীও হচ্ছেন আশ্রমের সাধু। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী সাধু আদিত্য নাথের আশ্রমও বেশ বড় আশ্রম। তার বিরুদ্ধেও নারী কেলেঙ্কারির কথা প্রচারিত। কেলেঙ্কারির জন্য আদিত্যনাথ একবার রাজ্যসভার সদস্যপদও হারিয়েছিলেন।

সিন্ধু সভ্যতার পরে আর্যরা ভারতে এসেছিলেন। হিন্দু ধর্মেরও সূচনা, সব ধর্মীয় গ্রন্থ রচিত হয়েছিলো আর্যদের হাতে। পুরো আর্যবর্তে তারা বসবাস করেছিলো। হিন্দু সংস্কৃতির উৎসভূমিই হলো আর্যবর্ত। মূলত গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলই হলো এলাকাটা। হিন্দুদের ধর্মীয় গ্রন্থে হিমালয়ের উল্লেখ আছে।

দক্ষিণের ধর্মমতের সঙ্গে একটা সমঝোতার মাধ্যমে হিন্দুধর্ম দক্ষিণে জায়গা করে নিয়েছিলো। দক্ষিণ ভারত এক বিশাল উপদ্বীপ। এ উপদ্বীপের দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চল এক বিস্তৃত সমতল ক্ষেত্র। এটি তামিলভূমি। এখানকার সংস্কৃতির সঙ্গে আর্যবর্তের সংস্কৃতির কোনও মিল নেই। ভাষাগুলোর মাঝেও কোনও মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। জাতিগতভাবে উত্তর-দক্ষিণের অধিবাসীও পৃথক পৃথক জাতি।

আর্যবর্তের আর্যরাই এখন ভারতের ক্ষমতায়। বিজেপি তার সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে আর্যবতে। তাই সাধু সন্ন্যাসীদের এত প্রতাপ। গুরমিত রাম রহিম সিংয়ের মতো আরো বহু সাধুর আশ্রম রয়েছে গোবলয়ে। আর্য সংস্কৃতির বহুকিছু যুগোপযোগিতা হারিয়েছে। কিন্তু সাধুরা তা পুনজীবনদানে সচেষ্ট হলে ভারতের মাঝে অনেক কলহ বিবাদ শুরু হবে। ভারতের বিচার ব্যবস্থা সম্ভবতো বিষয়টা উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং রাম রহিমকে ২০ বছর জেল দিয়ে সাধুদের বাড়াবাড়িতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির সূচনা করেছেন।

রজনীশ আর গুরমিতরা আশ্রম তৈরির পেছনে ভারতের ধর্মীয় কালচার যেমন প্রভাব ফেলেছে তেমনি সরকারের ব্যর্থতাও রয়েছে। ভক্তদের যে কোনোরকম সমস্যা আশ্রম/ডেরাই সমাধান করে দেয় - তা পানির অভাব হোক বা অন্য কিছু। এমন কোনও আশ্রম পাওয়া যাবে না যার নিজস্ব স্কুল, ক্যান্টিন, কোঅপারেটিভ মেস এসবের মতো প্রতিষ্ঠান নেই।

যে কাজগুলো সরকারের বা নাগরিক সমাজের করার কথা ছিল, সেগুলোরই অভাব মেটায় এই আশ্রম, ধর্মীয় সম্প্রদায় বা ডেরাগুলো। তার ফলে ভক্তদের মনে এইসব আশ্রম প্রধানের প্রতি তৈরি হয় এক প্রশ্নহীন আনুগত্য। তার প্রেক্ষিতে, আমরা দেখতে পাই ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত একজন ব্যক্তির গ্রেফতারের ঘটনায় ৩৮ ব্যক্তি প্রাণ দিতে। রাম রহিমের ভক্তরা অচল করে দিতে পারে দুটি রাজ্য। সরকার সচেতন না হলে ভারতে এ জাতীয় গুরুদের উত্থান থামানো সম্ভব নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে গুরু, সন্ন্যাসী, মোহন্ত এবং সাম্প্রদায়িকতা নির্ভর মোদি সরকারের পক্ষে আদৌ কি সম্ভব গুরমিত সিংদের থামানো?

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ