X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

জ্বলছে রাখাইন, হাসছেন অং সান সুচি!

সালেক উদ্দিন
০১ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:০১আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৪৯

সালেক উদ্দিন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি। তিনি এক সময় গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেছিলেন। তৎকালীন বার্মার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার অনুপ্রেরণা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি বার্মায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছেন বহুকাল। এজন্য তাকে বহুবার কারাবন্দী থাকতে হয়। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ বছর কারা ও গৃহবন্দি থাকেন তিনি। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের জন্য তাকে ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়।
তারপর অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে তার দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি মিয়ানমারের ক্ষমতায় আসে। স্বাভাবিকভাবেই সারা বিশ্বের আশা ছিল সেদেশের সেনা শাসক কর্তৃক লংঘিত গণতন্ত্র ও মানবাধিকার এবার মুক্তি পাবে। না, বিশ্ববাসীর সে আশা পূরণ হয়নি। ক্ষমতার লোভ তাকেও পেয়ে বসে। একবারের জন্যেও সেনাবাহিনী বিপরীতে অবস্থান নেননি তিনি বরং সেনাবাহিনীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলছেন। আগে সেনা শাসিত সরকার যা বলতো এখন অং সান সুচিও বলছেন তাই। আগেও রাখাইন-এর মুসলমানদের ওপর হত্যা গণহত্যা ধর্ষণ গণ-ধর্ষণ লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ চলতো। সুচির নেতৃতত্বাধীন মিয়ানমারে এখনও তাই চলছে। আগেও রোহিঙ্গা মুসলমানদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার জন্য সামরিক শাসকরা তাদের ভোটাধীকার বাতিল করেছিল সুচির আমলেও তাই আছে। সামরিক জান্তারা আগেও বলতো রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের নাগরিক নয়, তারা বাঙালি অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে এসে জুড়েবসা অধিবাসী। এবার গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মানস কন্যা শান্তির দূত সূচি রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে বাঙালি শব্দটিই ব্যবহার করলেন।
রোহিঙ্গা মুসলমানরা মিয়ানমারের নাগরিক নয় তারা বহিরাগত। তাদের দেশ থেকে তাড়াতে হবে বলে সেনাবাহিনী ও সেনা সমর্থিত বৌদ্ধ সম্প্রদায় যে কর্মসূচি হাতে নিয়েছে কার্যক্ষেত্রে সূচি ও তার সরকার তাদেরই সমর্থন করে যাচ্ছেন। অথচ এই মুসলিম রোহিঙ্গাদের সেদেশে বসবাস কতকাল ধরে তা কারো অজানা নয়। ইতিহাস বলে শতশত বছর আগে থেকে এমনকি স্বাধীন আরাকান রাজ্য এবং ব্রিটিশ শাসনের আগে থেকেই মিয়ানমার বা তৎকালীন বার্মায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের বসবাস ছিল। আজকের মিয়ানমারে একসময় আরাকান রাজ্য বলে একটি মুসলিম অধ্যুষিত স্বাধীন রাষ্ট্র ছিল। মুসলিম রোহিঙ্গারা ছিল সেই রাজ্যের বাসিন্দা। আরাকানের রাজা একপর্যায়ে ইসলাম ধর্মে মুগ্ধ হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন। সেই থেকে রাজ কর্মকাণ্ডে মুসলমানদের প্রভাব সৃষ্টি হয়। রাজা আরাকান রাজসভায় বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

আরাকান রাজ্যের অধিবাসীদের প্রধান দুই সম্প্রদায় ছিল মুসলিম রোহিঙ্গা ও বৌদ্ধ রাখাইন। তখন সেখানকার ৬০ ভাগ জনসংখ্যাই ছিল রোহিঙ্গা মুসলিম। পরে ব্রিটিশ উপনিবেসিক বার্মা ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভূক্ত হয়। ব্রিটিশ শাসন আমলেও মুসলিম রোহিঙ্গারা অন্যদের মতই নাগরিক অধিকার ভোগ করতো।

ব্রিটিশদের থেকে বার্মা স্বাধীনতা লাভের পর মুসলিম রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে ঘনঘটা নেমে আসে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী রাখাইনরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলে এবং তা প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সমর্থন লাভ করে। এ নিয়ে রাখাইন ও রোহিঙ্গাদের মধ্য শুরু হয় চিরস্থায়ী দাঙ্গার ঘটনা।

১৯৮২ সালে বার্মার সামরিক সরকার নাগরিকত্ব আইন করে মুসলিম রোহিঙ্গাদের অ-নাগরিক ও রাষ্ট্রহীন করে দেয়। কয়েক দশকধরে তাদের ওপর চালানো হয় জাতিগত নির্মূল অভিযান। দীর্ঘদিনের সামরিক জমানায় সেনাবাহিনী মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে ক্রমবর্ধমান হারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক পদক্ষেপ নেই। একবার ১৯৭৮ সালে ও তারপর ১৯৯০-এর দশকে রাখাইন প্রদেশে যে সহিংসতা চালানো হয় তার ফলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে।

শতশত বছর ধরে বসবাসকারী ২০ লক্ষ রোহিঙ্গাদের মধ্যে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা বাংলাদেশ, সৌদি আরব, ভারত, পাকিস্তান, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নেয়। অবশিষ্ট ছিল ১৩ লক্ষ রোহিঙ্গা। ১৯৯২ সালে যে ২লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল তার মধ্যে ২লাখ ৫০হাজার জনকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে সক্ষম হয়েছিল বাংলাদেশ। সাম্প্রদায়িক হানাহানির পর ২০১২ সালে আবার বিপুলসংখক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আরো পরে ২০১৬ এর অক্টোবরে মিয়ানমারে সীমান্ত চৌকিতে হামলার জেরধরে সেখানে যে লোমহর্ষক গণহত্যা, গণধর্ষণ অগ্নি সংযোগের ঘটণা ঘটে তাতে ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা নরনারী জীবন বাচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। সে সময়ে এমনও ঘটনা ঘটে যে, বেশ কয়েকটি গ্রামের রোহিঙ্গাদের একত্র করে সমবেত নারী-পুরুষ সবাইকে উলঙ্গ করে পুরুষদের চোখবেঁধে বেয়োনেট দিয়ে রক্তাক্ত করা হয় এবং নারীদের পাশবিক নির্যাতন ও ধর্ষণ করা হয়। অনেক নারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। অনেককে গুলি করে গণহত্যার নরক রচনা করা হয়। সৈন্যদের ছত্রছায়ায় রাখাইন উন্মত্ত যুবকরা বাড়ি-ঘর লুট করে এবং লুট শেষে আগুন জ্বালিয়ে দেয়।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর এই পৈশাচিক নির্যাতনে বিশ্ববিবেক নড়ে ওঠে। রাখাইনের ভবিষ্যত উন্নয়নের স্বার্থে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন একটি কমিটি গঠিত হয় কমিটি এক চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। তাতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত ও চলাফেরায় বিধিনিষেধ প্রত্যাহার সহ ৮৮টি সুপারিশ করা হয়।

এই প্রতিবেদন জমার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাখাইন রাজ্যের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে মুসলিম বিদ্রোহীদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। সেই সংঘর্ষের সুত্র ধরে আবার শুরু হলো রোহিঙ্গা নিধণ।

এখন মুসলিম সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের নিবাস এ অঞ্চলে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর তাণ্ডব চলছে। হাজার হাজার ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগে নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছে অন্তত ৫০ হাজার রোহিঙ্গা।

বৌদ্ধ গ্রামবাসী ও সেনাবাহিনীর আক্রমণ-অভিযানের মুখে প্রাণ বাঁচাতে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশ সীমান্তে অবস্থান নিয়েছেন। তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন। সেখানেও তাদের ওপর মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনী মর্টারশেল ও মেশিনগানের গুলি ছুড়ছে। জীবন বাঁচাতে তারা ছুটছে দিকবিদিক। অসহায় এসব মানুষদের আর্তনাদের ভারি হয়ে ওঠছে বাতাস। সেনাবাহিনী ও তাদের ছত্রছায়ায় লালিত বৌদ্ধ গ্রামবাসীর আগুনে জ্বলে পুড়ে ছাই হচ্ছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঘড়বাড়ি সহায় সম্বল। আর বিশ্ববিবেককে বৃদ্ধাআঙল দেখিয়ে হাসছেন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মূর্ত প্রতীক শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সুচি।

কোথায় গেলো সুচির সেই গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের বুলি যাতে মুগ্ধ হয়ে তাকে ১৯৯১ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল?

লেখক: কথাসাহিত্যিক

 

/এসএএস/আপ-এমও/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
এক সপ্তাহের মাথায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আরেকজন নিহত
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
‘উচিত শিক্ষা’ দিতে পঙ্গু বানাতে গিয়ে ভাইকে হত্যা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মানবাধিকার উইং চালুর পরামর্শ সংসদীয় কমিটির
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
পণ্ড হলো না পরাগের শ্রম, দিল্লিকে হারালো রাজস্থান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ