X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

নগরে ফিরবে কি স্বপ্ন?

শান্তনু চৌধুরী
০৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৪:০৭আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৫০

শান্তনু চৌধুরী বহুল প্রচলিত এবং বহুল ব্যবহৃত একটি বাক্য ‘নাড়ির টানে বাড়ি ফেরা’। কিন্তু এটাও ঠিক এর বিকল্প হয় না। যে মাটি থেকে নাগরে মানুষ আসেন জীবন ও জীবিকার টানে, উৎসব উপলক্ষে অন্তত ফিরে যেতে হয় সেই মাটির টানে। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে এই যে যাত্রা সেই যাত্রায় প্রতিটি মানুষের চোখে একএকটি স্বপ্ন যেন। তাই টিভি পর্দায় দেখি কেউ কেউ বলছেন, ‘জানি পথে অনেক দুর্ভোগ, যেতে কষ্ট হবে। কিন্তু এরপরও যেতে হবে’। বাবা-মা অপেক্ষা করছেন প্রিয় সন্তানের জন্য। স্ত্রী হয়তো প্রিয়তম স্বামীর জন্য। এমনি আরও আরও স্বজনদের অপেক্ষা কবে আসবে প্রিয়জন। এই ছুটিতে কেউ হয়তো বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন, কারো পাকা কথা হচ্ছে, কারো বা দেখাদেখি। কেউবা প্রিয়জনের জন্য নিয়ে গেছেন পছন্দের কোনও জিনিস। এমনও মানুষকে আমি জানি হয়তো সারাবছর গ্রামের বাড়িতে যান না। সেখানে কাছের কোনও স্বজনও থাকেন না। কিন্তু কোরবানির ঈদটা সেখানে করা চাই। বড় দেখে গরু বা ছাগল জবাই করে সেটা আত্মীয় স্বজন বা গ্রামের মানুষদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়াও যেন এক অন্য ধরনের আনন্দ।
আবার কেউ হয়তো কোরবানির মাংস বা কোরবানির টাকার কিছু অংশ তুলে দিচ্ছেন বা দেবেন বন্যার্তদের হাতে। যাদের প্রিয় পশু কোরবানি দেওয়ার মতো সামর্থ্য কেড়ে নিয়েছে প্রকৃতি। এবার ঈদ জামাতে অবশ্য তাদের জন্য দোয়া করা হয়েছে। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি বলেছেন, সামর্থবানরা যাতে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ান। এবার যারা শেকড়ের টানে ছুটে গেছেন তারা এক একটি স্বপ্ন নিয়ে গেছেন সাথে করে। কিন্তু সেই স্বপ্নের বাড়ি যাওয়া কি নির্বিঘ্নে হলো? মোটেই না। পাঁচ ঘণ্টার পথ বারো তেরো ঘণ্টায় পেরিয়েছে এমন নজির অনেক। একমাত্র গতকাল সকালে যারা বাড়িমুখী ছিলেন তারা গেছেন সহজেই। কিন্তু সেখানে আনন্দের লেশ কোথায়? হয়তো পেশার কারণে শেষ মুহূর্তে ছুটি পেয়ে বা কেউ কেউ যানজট এড়াতে গেছেন বাড়িতে।

আনুষ্ঠানিক ঈদযাত্রা শুরুর পর থেকে এখনও কেউ কেউ বাড়ি যাচ্ছেন। হয়তো প্রথম দিনের ঈদটা নগরীতে কাটিয়ে পরের কয়েকদিন গ্রামের বাড়িতে কাটাতে। কিন্তু ঈদের আগের দিন পর্যন্ত যারা বাড়ি গেছেন তাদের কাছে কোনও বাধাহীন যাত্রার খবর সংবাদ মাধ্যম বা নিকট পরিজনদের কাছ থেকে পাওয়া যায়নি। একমাত্র উড়ালপথ ছাড়া। সেখানে হয়তো জট ছিল না। কিন্তু ছিল বেশি ভাড়া নেওয়ার প্রবণতা। আশ্চর্যের ব্যাপার এয়ারলায়েন্স কর্তৃপক্ষ সেটা স্বীকার করে বলছেন, যেহেতু ফিরতি পথে খালি ফিরতে হবে তাই ভাড়া একটু বেশি নিচ্ছে। এ যেন পাড়ার কোনও রিকসাওয়ালার আবদার। ‘মামা ফেরার পথেতো যাত্রী পামু না, কিছু বাড়াইয়া দিয়েন’। মুশকিল হচ্ছে বেশি ভাড়া নিচ্ছে বা বেশি ভাড়া দিয়ে যেতে হচ্ছে কিন্তু এর প্রতিকার করার কেউ নেই। দেখার কেউ নেই। সবাই মেনে নিয়েছে এই অনিময়ই নিয়ম! অথচ সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যদি এ ব্যাপারে একটু সোচ্চার হতো তবে হয়তো আরো অনেক মানুষ যেমন যাতায়াত করতে পারতেন তেমনি বেশি ভাড়া দেওয়ার জিম্মি দশা থেকেও মুক্তি পেতেন। যেখানে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে উৎসব উপলক্ষে নানা ছাড়ের মহোৎসব চলে সেখানে আমাদের দেশে চলে ‘মারের’ মহোৎসব।

রেলপথে এবার ভোগান্তির আশঙ্কা ছিল বন্যার কারণে সেতু ডেবে যাওয়া বা মাটি নরম হয়ে লাইনের ক্ষতি হওয়া। সে বিষয়টি মাথায় রেখে ট্রেন চলেছে ধীরগতিতে। এতে করে সিডিউল বিপর্যয় ঘটছে। ছাদ ভর্তি ছিল লোকজনে। ভিড় টেলে উঠতে হয়েছে ট্রেনে। তবে এ প্রসঙ্গে রেলমন্ত্রীর কথাটি বেশ প্রেরণাদায়ক! তিনি বলেছেন, ‘ট্রেন দেরিতে ছাড়লেও মানুষতো বাড়ি পৌঁছাচ্ছে’। এটা অবশ্য ঠিক। ভাঙাচোরা রাস্তার এই আকালে গাদাগাদি করে ট্রেনে যে বাড়ি পৌঁছাতে পেরেছেন সেটাই বা কম কিসে!

নৌপথে ভোগান্তি তেমন ছিল না। তবে হাজার হাজার মানুষ কোনও নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে লঞ্চে উঠে গেছেন বাড়ি।

তবে এবার ভোগান্তির অপর নামে পরিণত হয়েছে সড়কপথে যাত্রা। সবশেষ বিভিন্নস্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ২০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। পথে পথে ভাঙা সড়ক, খানা-খন্দ, নিম্নমানের কাজের কারণে চুন-সুরকি ওঠে গিয়ে বেহাল দশা। তবে সড়কমন্ত্রী এ ক’দিন ঘুরে বেড়িয়েছে রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথা। সড়ক পরিবহনের সঙ্গে যুক্ত সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। এরপরও কমেনি দুর্ভোগ। এর কারণ বিভিন্ন জায়গায় বাস-ট্রাক বিকল, মেঘনা-গোমতী সেতু টোল প্লাজায় ওজন নিয়ন্ত্রণের নামে বেশি টাকা নেওয়া, রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে চাঁদাবাজি। সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ ছিল গাজীপুরের কালিয়াকৈর, চন্দ্রা ও এলেঙ্গা এলাকায়। কুমিল্লার বিশাল এলাকাজুড়ে প্রতিদিন ছিল যানজট। আবার কিছু কিছু জায়গায় রাস্তা সংস্কার ও মেরামতের কারণেও গতি ছিল কম। পাটুরিয়া, দৌলতদিয়া ও শিমুলিয়া ফেরিঘাটে ফেরি নষ্ট হয়ে দীর্ঘ যানজট পোহাতে হয়েছে যাত্রীদের। এছাড়া মহাসড়কের বাইরে বিভিন্ন আঞ্চলিক সড়কের অবস্থা আরো খারাপ। সেসব ভোগান্তির কথা জাতীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে ফলাও করে প্রচার না হলেও স্থানীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে দৃশ্যমান। ফলে ঈদ যাত্রায় ছিল ভোগান্তি। নষ্ট হয়েছে সময়।
এদিকে, আজ থেকে স্বপ্ন নিয়ে বাড়ি যাওয়া মানুষরা ফিরবেন নগরে। কিন্তু এতোকষ্টের যাত্রার ব্যাথাতো এখনও ভুলেনি তারা। তবে স্বপ্ন কি ফিরবে নগরে। ফিরতেই হয়তো হবে যেহেতু জীবন জীবিকার টান। আবার ফেরার পথে হয়তো ধীরে ধীরে ফিরবে বলে এতো ভোগান্তি থাকবে না। কিন্তু কথা হলো, আগামীতে আরও উৎসব রয়েছে। সেসব উৎসবেও বাড়ি যাওয়া যাত্রীর সংখ্যা বাড়বে। কিন্তু রাস্তার সমস্যার সমাধান হবে কি? কারণ এসব সমস্যাতো নতুন নয়। তাহলে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সমস্যা কোথায়? সড়ক ও জনপথ বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গেলো রমজানের ঈদে সারাদেশের মহাসড়কের কুমিল্লা জোনে ৩১ এবং এবারের ঈদে ৩৩টি স্থানে সংস্কার করা হয়েছে। এই সংখ্যা যথাক্রমে গাজীপুর জোনে ৫৫ ও ৪৭, বগুড়া জোনে ১৭ ও ১১৫, মাদারীপুর জোনে ২০ ও ৪৭। এর মধ্যে বেশিরভাগ জোনেই প্রায় ২০ ভাগ রাস্তা দুই ঈদেই সংস্কার করা হয়। ঈদ এলেই তড়িঘড়ি করে কাজ করার হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু এরপরও যান চলাচলের কারণে বা পানিতে নষ্ট হয়ে যায় রাস্তার পিচ। এর অবশ্য মূল কারণ হচ্ছে নিম্নমানের কাজ। কাজের কোনও তদারকি না থাকায় সরকারের গচ্ছা দিতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
মন্ত্রী যতোই এখানে সেখানে গিয়ে আশ্বাস দিন, ছুটি বাতিল করুন না কেন সংস্কার কাজে যদি গাফিলতি থাকে তবে যাত্রা ভোগান্তি কমবে না। তবে এবারের হাইওয়ে পুলিশের কিছুটা তৎপরতা ছিল। আর একটা বিষয় বারবার বলা হচ্ছে, টেকসই নির্মাণ এবং পরিকল্পনা নিয়ে এগুনো। এছাড়া স্থায়ী সমাধান কোনোমতেই সম্ভব নয়। কারণ সাময়িক সমাধান সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে। হয়তো ঈদের পর সংবাদমাধ্যমের চোখ রাস্তাঘাটের দিকে কম থাকে বলে কর্মকর্তারাও আরামে ঘুমিয়ে অপেক্ষা করেন আগামী ঈদের জন্য। এই কারণে ঘরমুখী ছোট ছোট স্বপ্নগুলোও নড়বড়ে হয়ে পড়ে। হয়তো লক্ষ্য বাড়ি বলেই শত কষ্টের মাঝে ক্ষোভ জানানো ছাড়া সাধারণ মানুষের কিছুই করার থাকে না। কিন্তু স্থায়ী সমাধানে যদি সংশ্লিষ্ট বিভাগ আন্তরিক হয় তবে স্থায়ী ক্ষোভ থেকেও রক্ষা পাবে সরকার।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

/এসএএস/আপ-এমও/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ