X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গিবাদের অন্তরালে

মুনির আহমদ
০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:৪৫আপডেট : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১১:৫১

মুনির আহমদ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান কেন? কেন তরুণরা যুক্ত হচ্ছে জঙ্গিবাদে? বিশেষজ্ঞরা বলেন, সমাজে অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বিরাজ করলে, রাজনৈতিক অঙ্গনে দমন-পীড়ন ও বিভাজনের মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করলে এবং ব্যক্তি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ন্যায়বিচার পাওয়ার থেকে বঞ্চিত হলে জঙ্গিবাদ, উগ্রবাদ ও চরমপন্থীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
গণতন্ত্রহীন সমাজে বিরাজ করে স্বৈরতন্ত্র। তাতে লুণ্ঠিত হয় ব্যক্তির মৌলিক ও মানবাধিকারসহ সব রাজনৈতিক অধিকার। সমাজে চলে অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নির্যাতন, মামলা-হামলা, গুম-খুন-অপহরণ, দুর্নীতি-বৈষম্য, স্বজনপ্রীতি, দখলবাজি, চাঁদাবাজির মহোৎসব। সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তির ব্যবস্থা। স্বাধীন মত প্রকাশের পথরুদ্ধ হলে, সুশাসনের অভাববোধ করলে, ন্যায়বিচার ভুলুণ্ঠিত হতে দেখলে, বঞ্ছনা, উপহাস ও বিদ্রুপের শিকার হলে কিংবা নিরাপত্তাহীনতায় নির্ঘুম রাত কাটালে ব্যক্তি জীবনে হতাশা ও ক্ষোভ তৈরি হয়। এমন পরিস্থিতিতে ধর্মীয় উগ্রবাদ, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ বা চরমপন্থার বিস্তার ঘটে। বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইলাম দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ‘Real source of Terror in Bangladesh’ শিরোনামে তারই ইঙ্গিত দিয়ে লিখেছিলেন ‘বাংলাদেশে সংঘটিত সাম্প্রতিককালের নৃশংস হত্যাকাণ্ডসমূহ সন্ত্রাসবাদের চেয়ে অধিক পরিমাণ শাসনের সমস্যা। ক্ষমতাসীন সরকার ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের ওপর ব্যাপকহারে যে নির্যাতনমূলক কার্যকলাপ শুরু করেছে সেটাই বাংলাদেশে চরমপন্থা সক্রিয় হওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে’।
বাংলাদেশ সামরিক শাসনের অধীনে ছিল বহুকাল। সে বিষফোঁড়ার যন্ত্রণায় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো হারায় তাদের স্বকীয়তা। ভেঙে যায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মেরুদণ্ড। পরিণামে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, রীতিনীতি ও ঐতিহ্য পরিচালিত হয় বিপথে। তাতে বিনষ্ট হয় গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাজনীতি হারিয়ে ফেলে তার আদর্শভিত্তিক চরিত্র। শুরু হয় হালুয়া-রুটির ভাগবাটোয়ারার রাজনীতি। দলভাঙ্গা ও গড়ার অপ রাজনৈতিক সংস্কৃতি। পঁচাত্তর পরবর্তী রাজনীতির নিয়ন্ত্রক সামরিক শাসকরা এর পাশাপাশি রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে যায় স্বাধীনতা বিরোধী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির হোতাদের। সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রতিস্থাপিত করে আঘাত হানে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনায়। তাতে ভুলণ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির অসাম্প্রদায়িক ভাবধারা।
৯০ দশক পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকে। এর পরবর্তী সরকারগুলো গণতন্ত্রের লেবাসে কায়েম করে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের স্বৈরতন্ত্র। সরকারি দলের আজীবন ক্ষমতায় থাকার মোহ এবং বিরোধী দলের বিরামহীন সংসদ বর্জনের রীতি রাজনৈতিক অঙ্গনে মাৎসন্যায়ের উদ্ভব ঘটায়। একপক্ষ ক্ষমতার মসনদ চিরস্থায়ী করতে বিরোধী নির্মূলে গুম, খুন, অপহরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, জেল-জুলুম, নির্যাতন, মামলা, হামলা তথা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মহোৎসবে মেতে ওঠে। পক্ষান্তরে, সরকার বিরোধীদের নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড হয়ে ওঠে সহিংস, নৈরাজ্যকর। দেশের প্রধান দুটি দলই এই দোষে দুষ্ট। রাজনীতির এই নেতিবাচক ধারার সুযোগটাই নিয়েছে ধর্মীয় উগ্রবাদীরা। খিলাফত ও তথাকথিত ইসলামি ভাবধারার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়ে তারা ধর্মের অপব্যাখ্যা ও মগজ ধোলাই নীতিতে নতুন প্রজন্মের সম্ভাবনাময় তরুণদের সম্পৃক্ত করে জঙ্গিবাদে। ধর্মের নামে খুনোখুনিতে করে উদ্ধুদ্ধ। যার পরিণতি হলি আর্টিজানে মৃত্যুর মিছিল ও শোলাকিয়ার ঈদগাহ মাঠে জঙ্গি হামলা।
সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, নৈতিক ও সঠিক ধর্মীয় শিক্ষার অভাব এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের ঠেলে দিচ্ছে বিপর্যয়ের মুখে। বিশেষ করে কর্মব্যস্ত পিতা-মাতার সন্তানটি পরিবারে থাকে নিঃসঙ্গ। তার প্রতি পিতা-মাতার উদাসীন আচরণে সে নিজের অজান্তেই নেতিবাচক ভাবধারা নিয়ে বেড়ে ওঠে। অবজ্ঞা ও অবহেলায় চৈতন্য হারিয়ে তারা অ্যাডভোরিজম এ মেতে ওঠে। এই সুযোগে জঙ্গিবাদের হোতারা তাদের টার্গেট করে বেঁধে ফেলে নিজেদের ছকে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, আধ্যাত্মিক প্রলোভনকারীরা ওইসব তরুণদের জঙ্গিবাদে যুক্ত করছে যারা বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণে স্বাভাবিক জীবনে আগ্রহ হারিয়ে নতুন কিছু করার স্বপ্নে বিভোর রয়েছে। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জঙ্গিবাদের উত্থান ও করণীয়’ শীর্ষক সেমিনারে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম উল্লেখ করেছিলেন, ‘উঠতি বয়সের হতাশাগ্রস্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের তরুণদের টার্গেট করে সহানুভূতিশীল, সমর্থক, সদস্য ও নেতা হিসেবে প্রশিক্ষিত করে জঙ্গিবাদের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আর স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারাগার, ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল, জিম ফিটনেস সেন্টারে পরিচিতির সূত্রে বন্ধুত্ব ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের বিস্তার হচ্ছে’।
জনবহুল এদেশে বিনোদনসহ সৃজনশীল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চর্চার পরিবেশে বেড়ে না ওঠা প্রজন্মের সংখ্যাই বেশি। প্রযুক্তি নির্ভর বিনোদনই তাদের একমাত্র অবলম্বন। এই সুযোগে অন্ধকারের শক্তিরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোকে ব্যবহার করে জিহাদের অপব্যাখ্যায় বিভ্রান্তিকর তথ্য পাঠিয়ে তরুণদের ধর্মরক্ষার যুদ্ধে সামিল হতে উদ্ধুদ্ধ করে। আজকের দিনে বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিরাজমান নেতিবাচক পরিবেশ বিশেষ করে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চর্চার অনুকূল পরিবেশের যেমন অভাব তেমনি শিক্ষকদের মৌলিক মানবীয় গুণাবলির স্খলন, লেজুড়ভিত্তিক রাজনীতির পদলেহন, নিজ এজেন্ডা বাস্তবায়নে ছাত্রদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার, তাদের উচ্চভিলাষী বিপথগামী আকাঙ্ক্ষা; শিক্ষার্থীদের বিবেক, বুদ্ধি এবং আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গাগুলো নষ্ট করে দিচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনে বিরাজমান এ বৈরি অবস্থাও তরুণ প্রজন্মকে জঙ্গিবাদের দিকে ঠেলে দিতে অনেকটা দায়ী।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের অন্তরালে দেশি-বিদেশি অন্ধকার জগতের নানা শক্তিরও ইন্ধন থাকতে পারে। যাদের মূল লক্ষ্য দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও প্রগতির বহমান ধারাকে বাধাগ্রস্ত করা। সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। ধ্বংসাত্মক এই মরণব্যাধী এককভাবে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। প্রয়োজন সকল মত, পথের মানুষকে আস্থায় নিয়ে জাতীয় এই দুর্যোগ মোকাবিলায় অগ্রসর হওয়া। সরকারকেই এই উদ্যোগ নিতে হবে। গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্র রচনা করে সর্বস্তরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করতে হবে। বিভেদের বদলে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র এবং দল, মত, পথের ঊর্ধ্বে ওঠে সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে সেতুবন্ধন রচনায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। এমনটা হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে ফিরে আসবে স্থিতিশীলতা। সমাজ জীবন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে বেজে ওঠবে আস্থা, বিশ্বাস ও ঐক্যের সুর।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হাজারীবাগে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
হাজারীবাগে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
ব্রাজিলিয়ান মিগেলের গোলে কষ্টে জিতলো কিংস
ব্রাজিলিয়ান মিগেলের গোলে কষ্টে জিতলো কিংস
তীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগতীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ