X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘রাজনীতি বসতে লক্ষ্মী’

রুমীন ফারহানা
০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৪৩আপডেট : ০৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৪৮

রুমীন ফারহানা ছোটবেলায় একটা বিষয় খুব অবাক করতো। শিক্ষিত, সচেতন কোনও মানুষকে আমার বাবা'র নাম বলতেই চমকে উঠতেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর শ্রদ্ধা আর বিস্ময় মাখা গলায় প্রশ্ন করতেন। অথচ তিনি না ছিলেন বিত্তবৈভবের মালিক, না কোনও সংযোগ ছিল ক্ষমতার সাথে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এই মানুষটি নিজের ছোট দল নিয়েই চলতেন। কিন্তু দল মত নির্বিশেষে কী ভীষণ শ্রদ্ধা নিয়েই না তাঁর নাম বলতেন মানুষ। রাজনৈতিক ভাবে ক্ষমতার বলয়ে থাকা বহু মানুষকে দেখেছি তাঁর কাছে আসতে, কখনও আলোচনা করতে, উপদেশ নিতে, করণীয় সম্পর্কে জানতে। রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত অতি বিখ্যাত ক্ষমতাবান মানুষ থেকে শুরু করে মাঠে জীবন দেওয়া কর্মীদের চারপাশে নিয়েই আমার বেড়ে ওঠা।
কঠিন নিয়মে বাঁধা জীবন ছিল তাঁর, প্রচুর পড়তেন, কড়া মেজাজ, অত্যন্ত স্পষ্টবাদী, নির্লোভ, স্বাধীনচেতা, আপোষহীন আর কঠোর সত্যবাদী। নিজে যা বিশ্বাস করতেন, তাই বলতেন, করতেন এবং সেটা ভুল বা ঠিক যাই হোক না কেন সেখান থেকে তাঁকে সরানো ছিল অসম্ভব। যারা তাঁকে চিনতেন, শত্রু হোক অথবা মিত্র, বুঝবেন যে সামান্যতম বাড়িয়ে বলছি না আমি। অত্যন্ত সুপুরুষ ছিলেন বলেই হয়তো কখনও কখনও ‘ঋষি’ বলে ভ্রম হতো আমার। ব্যক্তিগত জীবনে ধার্মিক আর রাজনৈতিক বিশ্বাসে চূড়ান্ত রকম অসাম্প্রদায়িক মানুষ ছিলেন। বিয়ে করেছিলেন অনেক বেশি পরিণত বয়সে এবং জানতে পারি এই শর্তে যে মা সংসারের সকল দায়িত্ব বহন করবেন যাতে তিনি নির্বিঘ্নে রাজনীতি করতে পারেন। এমনকি অবলীলায় বলতেন, 'বউ এর বাড়িতে থাকি, খাই আমি'। যেন এটাই স্বাভাবিক, এমনটাই হবার কথা। বাবা নিজে স্বচ্ছল পরিবারের সন্তান ছিলেন, মা বিদেশে লেখাপড়া করা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন, সুতরাং জীবন কেটে গেছে। না হলে কি হতো তা ভাবতেও ভয় লাগে। আপাত রাজনৈতিক ইতিহাস চিরকাল ক্ষমতাশীলদের তল্পীবাহক হয়েই চলে সুতরাং সেখান থেকে তাঁকে মুছে ফেলবার বালখিল্যতা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ইতিহাসের যে নির্মোহ বিশ্লেষণ হয় কালের পরিক্রমায় সেখানে বাংলাদেশের রাজনীতি তাঁকে বাদ দিয়ে লেখা অসম্ভব।

পিতা ‘অলি আহাদের’ স্মৃতিচারণ আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। লেখার মধ্য দিয়ে একটি সময়কে আমি তুলে আনতে চাইছি মাত্র। রাজনীতিবিদ ‘অলি আহাদ’ সম্পর্কে লিখছি কারণ সেটি যে শুধু একটি সময়কেই তুলে আনে তাই নয়, রাজনীতি'র প্রথম ধারণাও আমি পাই তাঁর কাছেই। আমার নিজের জীবনবোধও গড়ে ওঠে তাঁর হাত ধরে। ইংরেজ শাসন বিরোধী আন্দোলনে ‘সীমান্ত গান্ধী’ ও হিন্দুস্তান ছাড় আন্দোলনের শার্দুল খান আব্দুল গাফফার খান, শেখ হিসামুদ্দীন, মৌলানা ভাসানী, এ.কে. ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আতাউর রহমান খান সহ ভারত, পাকিস্তানের বহু প্রখ্যাত রাজনীতিবিদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল যাদের অনেকেই তখন এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন। যদিও ৮৪ বছরের জীবনে ১৯ বছর জেলে কাটানো মানুষটি বারবার অবহেলায় ফিরিয়ে দিয়েছেন ক্ষমতার হাতছানি। বাবা'র ‘জেল স্যুটকেস’ নামে আলাদা একটা স্যুটকেস সাজানোই থাকত সব সময়। শৈশবে যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ছায়ায়, রাজনীতিবিদদের গল্প শুনে আমি বেড়ে উঠেছি আজকে'র রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তাদের ন্যূনতম সাযুজ্য খোঁজাও হাস্যকর।

অবিভক্ত ভারত এবং পরবর্তীতে পাকিস্তান আমলে যারা রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন তাদের বেশির ভাগই এসেছেন অভিজাত এবং বিত্তশালী জমিদার পরিবার থেকে যাদের একটি অংশ রাজনীতি করতে এসে প্রায় সর্বশান্ত হয়েছেন। নবাব, ভূস্বামী বা জমিদার, স্বনামধন্য আইনজীবী, যশস্বী ডাক্তার বা সাংবাদিকেরাই রাজনীতিতে রাজত্ব করে গেছেন। ছোট্ট একটি উদাহরণ হয়তো বিষয়টিকে আর একটু স্পষ্ট করবে। নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী যিনি বঙ্গীয় গভর্নর এর কাউন্সিল অব মিনিস্টার্স এর কয়েক বারের মন্ত্রী ছিলেন এবং ইন্ডিয়ান কাউন্সিলে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি করেছিলেন তিনি তাঁর নিজস্ব জমিদারী বন্ধক রেখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় সিংহ ভাগ অর্থ জোগান। যেহেতু কয়েক পুরুষের আভিজাত্য ছিল তাদের সঙ্গে তাই রাজনীতিতে কিছু ব্যতিক্রম বাদে তারা বেশির ভাগই ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে ওঠে দেশকে কিছু দিতে পেরেছিলেন। রাজনীতি আর যাই হোক লাভজনক ব্যবসা হয়ে ওঠেনি। পরিবারের সবচেয়ে মেধাবী ছেলেটিই রাজনীতিতে নাম লেখাত, নষ্ট হওয়া বখে যাওয়া ছেলেটি নয়। প্লেন লিভিং হাই থিংকিং এর সময় ছিল সেটি। তারা স্বপ্ন দেখত আর স্বপ্ন দেখাত জাতিকে। স্বপ্ন পূরণের পথটিও তৈরি হতো তাদেরই হাত ধরে।

পরবর্তীতে বিশেষ করে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে রাজনীতির দখল ক্রমেই চলে যায় লুটেরা শ্রেণির স্বল্প শিক্ষিত নব্য ধনীদের হাতে। এদের মধ্যে ব্যবসায়ীরা প্রাধান্য পায় সবচেয়ে বেশি। ৫৪ সালের নির্বাচনে যেখানে সংসদে ব্যবসায়ী ছিল মাত্র ৪ শতাংশ স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের ৭৩ এর নির্বাচনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশে। এরপর থেকে এ সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে। বর্তমানে সংসদে ৭০ শতাংশ সরাসরি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত আর বাকি ৩০ শতাংশও পরোক্ষ ভাবে, নামে বেনামে ব্যবসা করে। ফলে রাজনীতি হয়ে গেছে টাকা বানানোর হাতিয়ার। নির্বাচনের সময় জমা দেওয়া হলফনামা সাক্ষ্য দেয় যিনি হয়তো ৫ একর জমির মালিক ছিলেন ৫ বছর সংসদে কাটিয়ে তিনি হয়েছেন ২৮৬৫ একর জমির মালিক। ব্যাংকে অর্থ বেড়েছে ৫৮৬ গুণ, জমি বেড়েছে ১৪৩ গুণ আর বার্ষিক আয় বেড়েছে ১০৮ থেকে ২০০ গুণ। অনেকের প্রাক নির্বাচনে নিঃস্ব স্ত্রী রাতারাতি বনে গেছেন হাজার কোটি টাকার মালিক। কানাডার বেগম পাড়া, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম জুড়ে রাজনীতিবিদদের ছড়াছড়ি। এখন ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতার বিত্তবৈভব দেখলে ভিরমি খেতে হয়। রাজনীতিতে এসেছে ভূমিদস্যু, মাদক ব্যবসায়ী, ইয়াবা সম্রাট, ব্যাংক লোপাটকারী এবং ফলস্বরূপ রাজনীতি নিজেই পরিণত হয়েছে বিনা পুঁজির অতি লাভজনক ব্যবসায়। তাই এখন অবলিলায় প্রশ্ন ওঠে ব্যবসার রাজনীতি নাকি রাজনীতির ব্যবসা। কোনও অভিজাত পরিবারের মেধাবী ছেলেকে রাজনীতি নিয়ে আর মাথা ঘামাতে দেখা যায় না।

একটি জাতির ভাগ্য অনেকাংশে নির্ধারিত হয় তার নেতার চরিত্র, জীবনাচরণ আর কাজের মধ্য দিয়ে। স্বনামধন্য আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল হক বেশ কয়েক বছর আগে তাঁর এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন জজ নিয়োগের সময় আরও অনেক কিছুর সাথে পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ডটাও যাচাই করা জরুরি। শুনতে যত খারাপই লাগুক না কেন রাজনীতিতেও এই বিষয়টি একই ভাবে খাটে। রাজনীতি করবার সমান অধিকার সকলেরই আছে। কিন্তু এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে যাওয়ার জন্য যে মেধা, দক্ষতা, শিক্ষা, ত্যাগের মানসিকতা, দেশের স্বার্থ আর মানুষের কল্যাণে ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে চিন্তা করার যে মনন, চিন্তাশীলতা আর শক্তি দরকার হয় তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হঠাৎ করে তৈরি হয় না। তাছাড়া জীবন, সমাজ আর রাজনীতি যেহেতু হাত ধরাধরি করে চলে তাই এর যে কোনও একটির পরিবর্তন চাইলে অন্যটির পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। রাজনীতি আর নেতৃত্ব আজ কোন পর্যায়ে গেলে দায়িত্বশীল পদে থাকা মানুষজন অবলীলায় বলতে পারে ক্ষমতায় থাকলে সম্পদ বেড়েই থাকে কিংবা ক্ষমতায় না থাকলে যা কিছু সম্পদ বানিয়েছেন তা নিয়ে পালাতে হবে, তা এখন ভেবে দেখার সময় এসেছে। জীবনের পরিবর্তন চাই কিংবা সমাজের, সবচেয়ে আগে প্রয়োজন রাজনীতির গুনগত পরিবর্তন। রাজনীতির এই পরিবর্তন ছাড়া অন্য কোনোটিরই কোনও পরিবর্তন আশা করা অর্থহীন।

লেখক: সহ আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি, বিএনপি

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
কাভার্ডভ্যান-লরির মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই গাড়িতেই আগুন, প্রাণ গেলো একজনের
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
বাড়লো ব্রয়লার মুরগির দাম, কারণ জানেন না কেউ
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
যুক্তরাষ্ট্র সফরে যাচ্ছেন তাইওয়ানের প্রতিনিধি
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ