X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিরোধী মত শুনতে না চাওয়া রাষ্ট্রীয় অসুখ!

চিররঞ্জন সরকার
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:০৫আপডেট : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১২:১৯

চিররঞ্জন সরকার আমাদের দেশে বিরোধিতা বা সমালোচনাকে সহ্য করা হয় না। আমরা চাই কেবল সমর্থন, প্রশংসা আর আনুগত্য। সমালোচনা তা যতো গঠনমূলক হোক না কেন, সেটা আমরা মানতে বা সহ্য করতে পারি না। ফলে আমাদের দেশে ‘সমালোচক’ তৈরি হয় না, তৈরি হয় স্তাবক আর শত্রু  বা বিদ্বেষকারী। এই মনোভাবের কারণে বিরোধী দল মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে না। অবশ্য বিরোধী দলও আমাদের দেশে কেন জানি গঠনমূলক সমালোচনার পরিবর্তে কেবলই হিংস্রতা প্রদর্শন, প্রতিদ্বন্দ্বীকে গুঁড়িয়ে দেওয়া, ‘ধ্বংস হোক নিপাত যাক’ টাইপের ধারণা পোষণ করে। ফলে আমাদের দেশে দুইটি রাজনৈতিক দল প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে পরিণত হয় ঘোরতোর শত্রুতে।
আমাদের দেশে যারা ক্ষমতায় থাকে তারা নামকাওয়াস্তে বিরোধী দল চায় বটে। তা না হলে আবার তাদের ‘সম্মান’ থাকে না। বাংলাদেশে এক আজব বিরোধী দলের সংজ্ঞা আবিষ্কৃত হয়েছে, তার নাম ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’! আসম আবদুর রব ছিলেন এরশাদ জমানায় ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’। আর আওয়ামী জমানায় এই খ্যাতি অর্জন করেছে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি।
এখানে বিরোধী দলকে কথা বলতে দেওয়া হয় না। অনেক সময় বিরোধী দলের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনেও বাধা দেওয়া হয়। বিরোধীদের ঘায়েল করতে মিথ্যে মামলায় জর্জরিত করে রাখা হয়। এত সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে বিরোধী দল তাই খুব একটা সুবিধা করতে পারে না। অথচ গণতন্ত্রের চর্চায় বিরোধী দল থাকা অপরিহার্য। শুধু গণতন্ত্রের খাতিরেই নয়, যে কোনও বিবেচনাতেই বিরোধী দল বা সমালোচক প্রয়োজন। কেননা একজন ব্যক্তি বা একটি দল সব সময় সব সিদ্ধান্ত সঠিক নিতে পারে না। তার সেই সিদ্ধান্ত ভুল না ঠিক, কোথায় গলদ, কোথায় সমস্যা-এগুলো আরেকজনের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে। বাইরের কেউ যদি একটা উদ্যোগ বা সিদ্ধান্তের ভুল-ত্রুটি ধরিয়ে দেয়, ভিন্ন কোনও ভালো পথের সন্ধান দেয়, আখেরে সেটা সবার জন্যই লাভ। সে জন্যই ইংরেজিতে বলা হয় Critics Are Your Best Friends অর্থাৎ সমালোচক হচ্ছেন আপনার সবচেয়ে বড় বন্ধু।

কিন্তু আমরা সবাই ‘সবজান্তা শমশের’ হয়ে বসে আছি। আমরা নিজেরাই নিজেদের মত ও পথ সেরা বলে ধরে নিয়ে স্থির সিদ্ধান্তে অটুট থাকি। তাই সমালোচনা ও বিরোধিতাকে আমরা শত্রুতা হিসেবে ধরে নিই। সবার চোখ ও জবান বন্ধ করে দিয়ে কেবল নিজেরটাকে শ্রেয় মনে করে পথ চলি। তাই আমাদের দেশে বিরোধী দল কখনও শক্তিশালী হয় না। বিরোধীদের কণ্ঠস্বর কখনও উচ্চকিত হতে পারে না।

একশোয় একশো পেতে হবে— এমন কথা গণতন্ত্রের কেতাবে লেখা নেই। বরং গণতন্ত্রে বিরোধী দলের উপকারিতা নিয়েই ছাত্রছাত্রীরা রচনা লিখে থাকে। কিন্তু সর্বশক্তিমান হওয়ার সাধনায় সে-সব কথা ভাবতে বসলে চলে না, সর্বগ্রাসী ক্ষুধাই সেই সাধনার মূল নিয়ামক। এটা নিতান্তই আমাদের রাজনীতিকদের অবদান। যে যখন ক্ষমতায় আসীন হয়েছে, সেই বিরোধী দলের নাম-নিশানা ভুলিয়ে দেওয়ার মিশন নিয়েছে। প্রয়োজন মতো গ্রেনেড হামলা করা হয়েছে। নেতাদের হত্যা করা হয়েছে। বিরোধীদলমুক্ত দেশ গড়ার একটা অদৃশ্য এজেন্ডা ক্ষমতায় যাওয়া সব দলই বাস্তবায়ন করেছে। এই ব্যাধি রাজনীতিকদের মজ্জাগত।

রাজনীতির পরিসরকে বিরোধীশূন্য করবার এই তাড়না গণতন্ত্রের স্বধর্ম নয়। যে ভাবে প্রশাসনযন্ত্র এবং দলতন্ত্রের অপব্যবহার করে এই তাড়নাকে রূপায়িত করা হচ্ছে, তা গণতন্ত্রের নীতির পরিপন্থী। তবে এ ঘোর কলিকালে ধর্ম বা নীতির কথা বলা হয়তো অরণ্যে রোদনমাত্র, সুতরাং সে কথা থাকুক। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের একটি কথা ভেবে দেখতে হবে। এটা বাস্তববুদ্ধির কথা। নির্বাচনি রাজনীতির স্বাভাবিক চালটিকে বজায় রেখে চললে আখেরে তাদের দলেরই লাভ। যেন তেন প্রকারে সব ভোট নিজের ঝুলিতে পুরতে ব্যগ্র হলে বিরোধী রাজনীতি তার স্বাভাবিক প্রকাশে ব্যর্থ হয়ে অস্বাভাবিক প্রকাশের পথ খুঁজবে। শেষ পর্যন্ত সেই অস্বাভাবিক প্রকাশের মোকাবিলা বহুগুণ কঠিন হতে বাধ্য। এই সত্যের স্বরূপ বুঝবার জন্য সেই ‘পেট্রোল-বোমা’র দিনগুলোর কথা স্মরণ করা যেতে পারে।

বিরোধী মত বিকশিত হওয়া খুব, খুবই প্রয়োজন। এই প্রয়োজনীয়তাকে স্বীকার করে নিয়ে ১৯৮৯ সালে সুমন একটা গান লিখেছিলেন, ‘বিরোধীকে বলতে দাও’। বিরোধীর নিজের কথা নিজের মতো করে বলার স্বাধীনতা কতটা জরুরি, ইতিহাস সেটা বার বার প্রমাণ করেছে। নানা দেশে, নানা পরিস্থিতিতে। যেমন এই মুহূর্তে বাংলাদেশে। যারা সরকারে আছেন তাদের স্ব-ভাবে বিরোধী মত শোনার অভ্যেস কম, যে কোনও বিষয়ে বিপরীত কথা শুনলেই তাদের ক্রোধ জেগে ওঠে, ক্ষমতার অস্ত্র— অনেক সময় আক্ষরিক অর্থেই অস্ত্র— হাতে নিয়ে সেই ক্রোধ বিরুদ্ধ মতের অনুগামীদের দমন করতে তৎপর হয়। এই অসহিষ্ণুতা এক ভয়াবহ রাষ্ট্রীয় অসুখ হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।

ভিন্ন মত প্রকাশের অধিকার দমনে আমাদের দেশে যখন যারা ক্ষমতাসীন থাকেন, তারা কী পরিমাণ তৎপর, সেটা এখন আর অজানা নয়। তাদের কথা অনেক হয়েছে, হচ্ছে, আরও অনেক হবে, হওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যাটা কেবল তাদের নিয়ে নয়। বিরোধীকে বলতে না দেওয়ার স্বভাব আমাদের দেশে অনেক বেশি পরিব্যাপ্ত। যারা রাষ্ট্রক্ষমতার বিরোধিতায় সরব ও সক্রিয়, তারাও সচরাচর ভিন্ন মত শুনতে আগ্রহী নন। এই কারণেই ‘বিরোধীকে বলতে দাও’ গানটির কথা আবার মনে পড়লো। সুমনের জবানিতে জানা যায়, পোলিশ মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, সমাজ দার্শনিক ও বিপ্লবী রোজা লুক্সেমবার্গকে স্মরণ করে তিনি বেঁধেছিলেন এই গান। রোজা লুক্সেমবার্গ পোল্যান্ড থেকে জার্মানিতে যান এবং সেখানকার নাগরিকত্ব অর্জন করে বামপন্থী আন্দোলনের বিকল্প পথ সন্ধান করতে গিয়ে, সেই বিকল্প পথে বামপন্থী আন্দোলন গড়ে, নিজেদের বামপন্থী বলে অভিহিত করা ক্ষমতাসীন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের হাতেই ১৯১৯ সালের জার্মানিতে নিহত হয়েছিলেন রোজা লুক্সেমবার্গ। এই কারণেই সুমনের গানটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। লুক্সেমবার্গের মৃত্যু দেখিয়ে দেয়— প্রতিবাদের রাজনীতিতে সওয়ার হয়ে যারা ক্ষমতায় আসে, তারাও প্রতিবাদী স্বরকে দমন করতে চায়, বিরোধীকে বলতে দেওয়ার স্বাধীনতা তারাও দিতে রাজি নয়। এই ব্যাধি কেবল ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ রাজনীতির নয়।

গত কয়েক বছরে এ দেশে ধর্মাশ্রিত সংখ্যাগুরুবাদের প্রবল দাপট। সেই দাপটের বিরুদ্ধে প্রতিবাদীরা সংগত কারণেই সরব হয়েছেন, ধর্মনিরপেক্ষতার গুরুত্বের কথা বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন নাগরিক সমাজকে, রাজনীতির কারবারিদের। কিন্তু এ কথাটাও খেয়াল না করলে ভুল হবে যে, তাদের প্রতিবাদী স্বরের যথেষ্ট জোর নেই। বিশেষ করে, সেই স্বর নাগরিক সমাজের সীমিত চৌহদ্দির বাইরে, বৃহত্তর সমাজে খুব একটা পৌঁছচ্ছে না, পৌঁছলেও কোনও সাড়া তুলছে না। আর ধর্মবাদী ও দোসররা সেই সুযোগেই আরও বেশি করে নিজেদের কথাগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। প্রশ্ন হলো, কেন আমাদের দেশের উদার গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবক্তারা বৃহত্তর জনসমাজের মন জয় করতে ব্যর্থ হয়েছেন। সচরাচর এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয় তাঁদের সামাজিক দূরত্বের বাটখারায়। সেটা অযৌক্তিক নয়— তাঁরা সত্য সত্যই আমজনতা থেকে অনেক দূরে, কেবল জীবনযাপনের দৈনন্দিনতায় দূরে নয়, মানসিকতাতেও দূরে। ঘটনা হলো, তাদের কথা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেন না, নিজেদের জীবন ও ভাবনার সঙ্গে সেই কেতাবি ধর্মনিরপেক্ষতা বা উদার গণতন্ত্রের বুলিকে মেলাতে পারেন না। এই দূরত্ব ঘোচানোর চেষ্টা নিশ্চয়ই করা দরকার।

কিন্তু সমস্যাটা নিছক দূরত্বের নয়। সমস্যা ভিন্ন মত না শোনারও। আমরা, যারা উদার গণতন্ত্রের কথা বলি, তারাও ভিন্ন মত মন দিয়ে শুনতে রাজি নই। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষতাকে যারা প্রশ্ন করেন, তাদের সঙ্গে আলোচনায় আমরা নারাজ। অথচ মনে রাখতে হবে, ধর্ম এবং রাজনীতিকে পরস্পর থেকে দূরে রাখার যে পশ্চিমা ধারণা আমাদের নাগরিক সমাজে স্বীকৃত হয়েছে, কিংবা সমস্ত ধর্মের প্রতি রাষ্ট্রের সমভাব পোষণের যে নীতি আমাদের দেশে গৃহীত হয়েছে, তার বাইরেও ধর্ম বিষয়ে, ধর্ম ও রাষ্ট্রের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে নানা মত থাকতে পারে। সেই মত আমরা মানি বা না মানি, তার সঙ্গে আলোচনা করা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষত, আমাদের জনজীবনে এবং চিরাচরিত রাজনীতির পরিসরে ধর্মের খুব বড় ভূমিকা ছিল এবং আছে। তাকে বাদ দিয়ে চলতে গেলে সমাজের বিরাট অংশকে বাদ দিয়ে চলতে হয়। সেটা গণতন্ত্রের স্বধর্মের বিরোধী। এই ধর্মচ্যুতিই আমাদের ক্ষতি করেছে, ক্ষতি করে চলেছে। আর তার ফসল তুলছে ধর্মবাদী রাজনীতির কারবারিরা।

তাই বিরোধীকে বলতে দাও— এই কথাটা খুব মূল্যবান। সব বিরোধীকে বলতে দেওয়া দরকার। আর হ্যাঁ, বিরুদ্ধ মত শোনাও দরকার। তা না হলে রাজনীতিতে আবর্তন হবে হয়তো, কিন্তু পরিবর্তন হবে বলে মনে হয় না!

লেখক: কলামিস্ট

.

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গাজা নিয়ে মার্কিন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ায় গণগ্রেফতার
গাজা নিয়ে মার্কিন ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ায় গণগ্রেফতার
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মশলা
হংকং ও সিঙ্গাপুরে নিষিদ্ধ হলো ভারতের কয়েকটি মশলা
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে ‘বড় পরিবর্তন’ দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে ‘বড় পরিবর্তন’ দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র
পদে থেকেই ইউপি চেয়ারম্যানরা উপজেলা নির্বাচন করতে পারবেন
পদে থেকেই ইউপি চেয়ারম্যানরা উপজেলা নির্বাচন করতে পারবেন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ