X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গা সংকট: প্রতিরোধেই সমাধান?

আমীন আল রশীদ
১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৪০আপডেট : ১০ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৪২

আমীন আল রশীদ যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে ভূমি মাইন পুঁতে রেখেছে মিয়ানমার, যাতে করে সেনা অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা আর রাখাইন রাজ্যে ফিরতে না পারে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে এটি একটি নতুন ডাইনেমশন।
এর আগে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে জানানো হয়, ২৭ ও ২৮ আগস্ট মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশে অনুপ্রবেশ করার পর পহেলা সেপ্টেম্বর সকালে উখিয়ার কাছে দেশটির কয়েকটি হেলিকপ্টার তিন দফা বাংলাদেশ আকাশসীমায় অনুপ্রবেশ করে। রোহিঙ্গা সংকটে এটি আরেকটি ডাইমেনশন।
তৃতীয় ডাইমেনশন রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গা হিন্দুদের পালিয়ে আসা। এর আগেও বহুবার রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর বর্বরোচিত হামলার শিকার হয়ে দলে দলে রোহিঙ্গা মুসলমানরা বাংলাদেশে এসেছে। কিন্তু এবার অনেক হিন্দু নাগরিকও পালিয়ে বাংলাদেশের সীমান্তে এসেছে। কারণ সে দেশের সরকার মনে করে, সম্প্রতি মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর যে হামলা হয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গা মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দুরাও জড়িত।

তবে এবারের রোহিঙ্গা সংকটের সবচেয়ে বড় ডাইনেমশন ‘প্রতিরোধ’। বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে জার্মানির গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলের খবরে বলা হচ্ছে, অন্যান্যবার পুরো পরিবারসহ রোহিঙ্গারা পালিয়ে এলেও এবার শরণার্থীদের দলে পুরুষদের সংখ্যা একেবারেই কম। পালিয়ে আসা অনেকেই বলেছেন, লড়াই করার জন্য পুরুষরা রয়ে গেছে। আয়েশা বেগম নামে এক সন্তানসম্ভবা নারী বলেন, ‘আমাদের তিনি (আয়েশার স্বামী) নদী পাড়ে এনে বিদায় দিয়েছেন। বলেছেন, বেঁচে থাকলে দেখা হবে স্বাধীন আরাকানে, মারা গেলে স্বর্গে৷’

কিন্তু যে রোহিঙ্গারা এবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে বা স্বাধীন আরাকানের স্বপ্ন দেখছে তাদের বেশ কিছু প্রশ্নেরও মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন অস্ত্র। বিদ্রোহী/স্বাধীনতাকামীদের ভারী অস্ত্র বলতে কিছুই নেই। যেসব সংগঠন এই ঘুরে দাঁড়ানোর প্রশ্নে নেতৃত্ব দিচ্ছে, তাদেরকে আন্তর্জাতিক মহলে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে পরিচিত করানোর প্রক্রিয়া এখানে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। দ্বিতীয়ত এসব সংগঠন এখনও ওই অর্থে অস্ত্র-শস্ত্রে শক্তিশালী নয়। ‍বিভিন্ন সূত্রের খবরে যতটুকু জানা যাচ্ছে, তাতে এখন পর্যন্ত ছুরি, ঘরে তৈরি বোমা এবং আগ্নেয়াস্ত্রই তাদের সম্বল। আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (এআরএসএ) হাতে কিছু একে-৪৭ রাইফেল আছে বলে জানা যায়। কিন্তু তারপরও মিয়ানমারের সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে তারা কতটুকু টিকতে পারবে, সে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে৷

রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন ও ভারতের ভূমিকা সবচেয়ে মূখ্য। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ইস্যুতে তাদের ভূমিকা মিয়ানমার সরকারের পক্ষে। সুতরাং রোহিঙ্গারা যে স্বাধীন আরাকানের স্বপ্ন দেখছে, সেখানে এটি একটি বড় অন্তরায়। কারণ মিয়ানমার নিজেই সামরিক দিক দিয়ে বেশ শক্তিশালী। তার সঙ্গে যদি এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম পরাক্রমশালী চীন ও ভারত তাকে সহায়তা না দিয়ে অন্তত চুপও থাকে––সেটিও রোহিঙ্গাদের স্বপ্ন পূরণের পথে একটা বড় চ্যালেঞ্জ।

রোহিঙ্গাদের ওপরে এই নিপীড়ন বন্ধ কিংবা তাদের স্বাধীন আরাকানের স্বপ্ন পূরণের লড়াইয়ে বাংলাদেশ কি সহায়তা করবে? একদিন সত্যিই স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠিত হলে বাংলাদেশে থাকা কয়েক লাখ রোহিঙ্গা নিশ্চয়ই তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যাবে। সেটি বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। কিন্তু তা সত্ত্বেও মিয়ানমার যেহেতু ভারত ও চীনের বন্ধুপ্রতিম––সুতরাং সেই কূটনীতির হিসেবে বাংলাদেশ প্রকাশ্যে রোহিঙ্গাদের অস্ত্র বা অন্য কোনোভাবে সহায়তা দিতে পারবে না।

পশ্চিমা বিশ্ব তো দূরে থাক, রোহিঙ্গাদের ধর্মপরিচয়ের কারণে মুসলিমপ্রধান মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশ বিশেষ করে সৌদি আরব কিংবা এশিয়ায় রোহিঙ্গাদের অন্যতম বড় আশ্রয়স্থল মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার সরকারও রোহিঙ্গাদের স্বাধীন আরাকানের স্বপ্ন পূরণে কতটা সহায়তা করবে, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। সুতরাং রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন শুধু দুরূহই নয়, বরং এটি একটি অসম্ভব কাজও বটে। যদিও শোনা যায় যে, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর মাধ্যমে ‘এআরএসএ’ কিছু অস্ত্র-অর্থ পেয়ে থাকে। সেইসঙ্গে আরব আমিরাত ও সৌদি আরব তাদের কিছু অর্থ সহায়তা দেয়। কিন্তু তার পরিমাণ কত এবং সেটি মিয়ানমার সরকারের বিরদ্ধে লড়াই করে স্বাধীন আরাকানের স্বপ্ন পূরণের জন্য যথেষ্ট কী না, সে সংশয় রয়েই গেছে। আবার যদি মিয়ানমার ও ভারত এটা প্রমাণ করতে পারে যে, রাখাইনে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য পাকিস্তান সহায়তা করছে, তখন রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়াটা বাংলাদেশের জন্য বেশ বিব্রতকর হয়ে দাঁড়াবে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে তুরস্কের ভূমিকা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠছে। তারা বাংলাদেশে মানসম্মত আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করে দেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছে, বাংলাদেশ সেটি গ্রহণ করবে কিনা বা করলে সেটিকে ভারত ও চীন এমনকি যুক্তরাষ্ট্র কোন চোখে দেখবে, তাও বিবেচনার দাবি রাখে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ নিজেই একটা বড় ধরনের ‘কূটনীতিক ঝামেলা’র মধ্যে রয়েছে।

তবে রোহিঙ্গা সংকটের জল যতটা ঘোলা হয়েছে, তাতে শক্তিশালী মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীন আরাকান প্রতিষ্ঠা করা রোহিঙ্গাদের জন্য অত্যন্ত দুরুহ। আবার তারা যদি ঘুরে না দাঁড়ায় তাহলে কিছুদিন বিরতির পর সেনাবাহিনীর গণহত্যা আর মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হতেই হবে। তাহলে বিকল্প কী আছে? একমাত্র বিকল্প হতে পারে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ এবং প্রয়োজনে অবরোধ আরোপ। কিন্তু সেটি কে করবে? জাতিসংঘ? রোহিঙ্গাদের ধর্মপরিচয় অন্য কিছু হলে এতদিনে মিয়ানমারের ওপর হয়তো অবরোধ আরোপ হয়ে যেতো। রোহিঙ্গাদের ধর্ম যেহেতু ইসলাম, সে কারণে পশ্চিমা বিশ্বও হয়তো চাইবে না আরেকটা মুসলিম রাষ্ট্রের জন্ম হোক। পূর্ব তিমুর স্বাধীন করার পেছনে তাদের ইন্ধন ছিল কারণ সেখানের গরিষ্ঠ মানুষ খ্রিস্টান। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ধর্ম যে বরাবরই ফ্যাক্টর, তা সবারই জানা।

কিন্তু তারপরও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের এই বৃহৎ প্রশ্নে জাতিসংঘকেই ভূমিকা নিতে হবে। তারা মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে রোহিঙ্গা অধ্যূসিত এলাকাকে স্বাধীনতা দিয়ে দিতে পারে, যাতে তারা সেখানে নিজেদের মতো করে জীবন-যাপন করতে পারে। অন্যথায় রাখাইন রাজ্যে ১০ লাখের মতো যে রোহিঙ্গা আছে, উন্নত বিশ্ব বিশেষ করে কানাডার মতো বিশাল আয়তনের দেশগুলো তাদের আশ্রয় দিতে পারে। এরইমধ্যে রোহিঙ্গাদের সাময়িক আশ্রয় দিতে রাজি হয়েছে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। তবে এটি কোনও স্থায়ী সমাধান নয়। বরং রোহিঙ্গারা যাতে নিজেদের জন্মভূমিতেই মানবাধিকার নিয়ে বেঁচে থাকতে পারে, সেই চেষ্টা করা দরকার। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে মিয়ানমার সরকারকেই। কিন্তু তারা যে সেটি আদৌ করবে না, তা এরইমধ্যে স্পষ্ট। কেননা তারা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক বলেই স্বীকার করে না। বরং তারা জাতিগতভাবেই এই জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করে দিতে চায়। আরও স্পষ্ট করে বললে তারা মুসলমানসহ অন্য যেকোনও সংখ্যালঘু জাতিকেই মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করতে চায়। তবে এবার যেরকম রাখাইন থেকে অনেক হিন্দুও পালিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে এসেছে, এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ভারতের কী প্রতিক্রিয়া হয়–তার ওপর অনেকটাই নির্ভর করবে রোহিঙ্গা তথা রাখাইন সংকটের ভবিষ্যৎ।

লেখক: সাংবাদিক

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ