X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা নিয়ে মিয়ানমারের পোড়ামাটি নীতি

আনিস আলমগীর
১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৫৪আপডেট : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৫৯

আনিস আলমগীর অং সান সু চির সঙ্গে গোপনে দেখা করে সিরিজ কথপোকথন রেকর্ড করেছিলেন লেখক অ্যালান ক্লিমেন্টস। তিনি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছিলেন রেঙ্গুনের ৫৪নং ইউনিভার্সিটি এভিনিউতে অবস্থিত অং সানের পৈতৃক বাসভবনে বসে, যেখানে অং সান সু চিকে গৃহবন্দী করে রেখেছিলো তার দেশের সামরিক জান্তা। অ্যালান ক্লিমেন্টস সূ চির সাক্ষাৎকারটি বই আকারে প্রকাশ করেছিলেন। সু চির অনুরোধে অ্যালান ক্লিমেন্টস ওই বইতে সূ চির দুইজন মূখ্য লেফটেন্যান্ট-এর সাক্ষাৎকারও জুড়ে দিয়েছেন।
অ্যালান ক্লিমেন্টস হচ্ছেন একজন আমেরিকান নাগরিক। তিনি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে দীর্ঘদিন রেঙ্গুনে সংঘ জীবন-যাপন করেছিলেন। তার বইটিতে সামরিক সরকারের আরও বহু উপ-জাতির ওপর চালানো অত্যাচারের কাহিনি রয়েছে। অ্যালান ক্লিমেন্টস বইটির নাম দিয়েছেন ‘দ্য ভয়েস অব হোপ’। বইটা পড়েছিলাম বহুদিন আগে। সু চির কথাবার্তা পড়ে মনে হয়েছিলো গৌতম বুদ্ধ বুঝি ধরায় পুনঃজনম নিয়ে নারীরূপে আবির্ভূত হয়েছেন।
মিয়ানমারের লোক সংখ্যা ৫ কোটি। এখানে ৫ হাজার বৌদ্ধ বিহার রয়েছে, এক লাখ ভিক্ষু বাস করে এ বিহারগুলোতে। সুতরাং মিয়ানমারের সমাজে ধর্মের প্রভাব যে থাকবে সে কথা কেউ অস্বীকার করতে পারে না। মিয়ানমারের প্যাগোডাগুলো রাজনৈতিক, সামাজিক জীবনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে আছে। সু চির জীবনে মহামতী বুদ্ধের প্রভাব থাকাও স্বাভাবিক। তার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ও শান্তিপূর্ণ স্বভাব দেখে তাকে নোবেল কমিটি শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কারও দিয়েছিলেন।

গত নির্বাচনে সু চির দল মিয়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছে এবং সরকার গঠন করেছে। কিন্তু শাসনতন্ত্রের বিধিবদ্ধ বাধার কারণে সু চি রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি। কারণ তার স্বামী ব্রিটিশ নাগরিক। তিনি মিনিস্ট্রারিয়াল কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মূলত তিনিই সব। অবশ্য নেপথ্যে সব ক্ষমতাই জান্তার হাতে।

মিয়ানমারের পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর ২৫% প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। যাদের আধিপত্য ৭৫% এর আধিপত্যের সমান। সুতরাং সু চির সরকার সামরিক জান্তার ইচ্ছার বাইরে এক কদমও দিতে পারে না। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন ক্ষমতায় আসার পর থেকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নেই। সামরিক সরকার ১৯৬২ সাল থেকে বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর ওপর অত্যাচার চালাচ্ছে।

সু চির সাক্ষাৎকার পড়ে তার সম্পর্কে যে ধারণা হয়েছিলো এখন সব পাল্টে গেছে। এখন দেখি মিয়ানমার গঠনের ব্যাপারে সু চি আর জান্তা এক ও অভিন্ন হয়ে গেছেন। জান্তা এক সময় মিয়ানমার ও থাই সীমান্তে খুবই নির্মমভাবে কারেন সম্প্রদায়কে নির্মূল করেছিলো। ঠিক এখন রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে সু চি একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মোট ১৩৫টি নৃ-তাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী রয়েছে মিয়ানমারে।

সু চির এই বিবর্তনে শুধু সাধারণ মানুষ নয়। রাজনীতিবিদরাও বিস্মিত। তারা যাকে নোবেল বিজয়ী করার জন্য ইমেজ তৈরি করেছিল তারাও। ব্রিটেনে প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির উদ্দেশ্যে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমরা ম্যাডাম অং সান সু চির প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তার উদ্দেশ্যে আমার বার্তা হলো- আমরা আপনাকে পছন্দ করি- বহু বছর আপনি যখন গৃহবন্দী ছিলেন আমরা আপনাকে সমর্থন করেছি। আমরা আপনার সমর্থনে মিছিল করেছি, মানবাধিকারের প্রতি আপনার অঙ্গীকারকে আমরা স্বীকৃতি দিয়েছি। রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক আচরণ করুন’।

সু চির মুক্তির জন্য দুনিয়ার মানুষ কী করেছে তার আসলে জানাই নেই। নয়তো জেরেমি করবিনকেও কেন স্মরণ করিয়ে দিতে হচ্ছে সু চিকে! গত জানুয়ারি মাসে বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে সু চি বলেছিলেন, আরাকানে নাকি বৌদ্ধ জনগোষ্ঠী কমে গেছে। কারেনদের মতো এবার নির্বিচারে হত্যা করেছে রোহিঙ্গা যুব গোষ্ঠীকে। এখন যারা আরাকান থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে তারা হলো বৃদ্ধ, নারী, নাবালক ছেলে-মেয়ে, শিশু-কিশোর। ইংল্যান্ডের সাপ্তাহিক অবজারভার বলেছে, যুবা বয়সের লোক নাই। কারণ তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করেছে মিয়ানমারের সৈন্যবাহিনী।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ সরকার এক কঠিন বিপদের মধ্যে পড়েছে। চীন ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুখ খুলছে না। তারা মিয়ানমার সরকারের রোহিঙ্গা নীতিকে নীরবে সমর্থন করবে বলে মনে হচ্ছে। অনুরূপ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বড় দেশের নীরব বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছে। সুতরাং পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য জটিল বলেই মনে হচ্ছে। চীন চায় না যে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সক্রিয় হোক।

চীনের কথাই শুনে আসছিল মনে হচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক ব্যর্থতা প্রতিবেশী ভারতকে এই সমস্যার কথা বুঝাতে ব্যর্থ হওয়া। এক যোগে কাজ না করা। লক্ষ করুন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী যখন মিয়ানমার যাচ্ছেন, আরাকানে এতো বড় গণহত্যা চলার পরও আমাদের দিল্লির হাই কমিশনার ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। বাংলাদেশের চাওয়া, বাংলাদেশের যন্ত্রণার কথা তিনি মোদিকে বলতে পারেননি। অবশ্য ১৬ বছর আগে অবসর নেওয়া একজন কূটনীতিককে দিল্লির মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে পাঠালে  ফলাফল এর থেকে ভালো আশা করাও বোকামি।

অনেক জল গড়িয়ে যাওয়ার পর হাই কমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দেখা করার ফুসরত পেয়েছেন। এরপরই ভারত রাখাইন প্রদেশের ঘটনায় হালকা পাতলা একটা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। দিল্লির সিগনাল পেয়ে ঢাকার ভারতীয় হাই কমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা স্থানীয় মিডিয়ায় বলেছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত বাংলাদেশের পাশে আছে। অবশ্য, ভারতীয় পররাষ্ট্র  মন্ত্রণালয়ের পুরো বিবৃতি পড়ে কেউ কেউ মনে করছেন এতে রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার চেয়েও মিয়ানমারের নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বিগ্নতা বেশি প্রকাশ পেয়েছে।

অন্যদিকে তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান চেষ্টা করছে সক্রিয় ভূমিকা রাখার জন্য। জাতিসংঘও সক্রিয় হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের প্রধান জেইদ রাদ আল-হুসেইন বলেছেন, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যেভাবে পদ্ধতিগত-ভাবে হামলা চালানো হচ্ছে, সেটি ‘জাতিগত-ভাবে নির্মূল’ করার শামিল। মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান বলেছেন, রোহিঙ্গাদের লক্ষ্য করে যেভাবে সামরিক অভিযান চালানো হচ্ছে, সেটি মনে হচ্ছে পাঠ্যবইয়ের জন্য ‘জাতিগত নিধনের’ উদাহরণ হয়ে থাকবে। অবিলম্বে মিয়ানমার সরকারকে সামরিক অভিযান বন্ধের আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, জাতিসংঘের তদন্তকারীদের রাখাইন রাজ্যে ঢুকতে না দেওয়ায় সেখানকার পরিস্থিতি পুরোপুরি নির্ণয় করা যাচ্ছে না।

কিন্তু মিয়ানমারের অত্যাচারকে এমন সক্রিয়তা বন্ধ করতে পারবে না যতক্ষণ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে। অথচ নিরাপত্তা পরিষদে কোনও সিদ্ধান্ত প্রস্তাব আসলে চীন ভেটো প্রদান করবে। চীনের আশকারাই মিয়ানমারের প্রধান শক্তি। মিয়ানমারকে চীন গ্রাস করেছে। অবশ্য তাদের দুই দেশের এই মধুর বন্ধন নতুন কিছু না। মিয়ানমার এক সময় চীনের করদ রাজ্য ছিল। ব্রিটিশেরা ১৮০০ সালে মিয়ানমার অধিকার করে নিলেও চীনকে কর দেওয়ার নিয়ম অব্যাহত রেখেছিল।

অনেকে বলছেন বাণিজ্যিক অবরোধের কথা চিন্তা করতে। যেখানে আমেরিকার মতো দেশ বাণিজ্যিক অবরোধ করে অন্যের বিরুদ্ধে সফল হচ্ছে না সেখানে অন্য কারও বাণিজ্যিক অবরোধ কোনও উপযোগিতা বয়ে আনবে বলে মনে হয় না।

মূলত আরাকান উপকূলে বিরাট গ্যাস ও তেলক্ষেত্র পাওয়া গেছে। চীন এককভাবে এই তেল ও গ্যাস পাইপ লাইন বসিয়ে চীনের কুনমিংয়ের উনান প্রদেশে নিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা পাকা করেছে। তাই মনে হয় না যে চীন মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম দেশগুলো ওআইসির কাঠামোতে হোক, স্বতন্ত্রভাবে হোক- এ সমস্যা সমাধানের একটা উদ্যোগ নিতে পারে। বাংলাদেশ প্রতিবেশী হিসেবে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এর সাহায্য নেওয়ার জন্য কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করা উচিৎ। এই তিনদেশ যেহেতু মিয়ানমারের প্রতিবেশী তাদের কথাকে হয়তো মিয়ানমার উপেক্ষা নাও করতে পারে।

মিয়ানমার খুব ধনী দেশ না হলেও তার পাঁচ কোটি লোকের ভাত-কাপড়ের জন্য কারো দ্বারস্থ হতে হয় না। প্রতিটি আবেগকে উপেক্ষা করে বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নীরব থাকার এক কু-অভ্যাসে ভোগে মিয়ানমার। তাদের সঙ্গে সমাধানের উদ্দেশ্যে কোনও ডায়লগ ওপেন করা যায় কিনা তার চেষ্টা করাও উচিৎ। তবে এ সমস্যার একটা সমাধান পৌঁছানোর জন্য বাংলাদেশের উচিৎ হবে চীনকে বোঝানোর চেষ্টা করা। ভারতকে হাতে রাখা। চীন সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করলে সমস্যার একটা সমাধান হতে পারে।

মিয়ানমার যে শুধু রোহিঙ্গা বিতাড়ন করছে তা নয় তারা এ যাবৎ অর্থাৎ ২৫ আগস্ট থেকে ১৭ বার বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করেছে। চীনের সমর্থনে উত্তর কোরিয়া যেমন কাউকেও মান্য করছে না ঠিক অনুরূপ অবস্থা হচ্ছে মিয়ানমারের। মিয়ানমারের সামরিক জান্তাও নাকি চীনকে রাজী করানোর চেষ্টা করেছে- তাদের আনবিক শক্তি অর্জনের চেষ্টার প্রতি চীন যেন সমর্থন দেয়।

মিয়ানমারের লোক সংখ্যা পাঁচ কোটি কিন্তু তাদের সামরিক বাহিনী সংখ্যা চার লাখ। উচ্চ-ভিলাসী না হলে এতো সৈন্য পুষবে কেন? ১৪/১৫ বছরের কিশোরও আছে সামরিক বাহিনীতে। মিয়ানমার রোহিঙ্গা বিতাড়িত করবেই এটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। বাংলাদেশ মানবীয় কারণে রোহিঙ্গার আগমনকে নির্বিঘ্ন রেখেছে সব মিলিয়ে প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। শেষ পর্যন্ত কত রোহিঙ্গা আসে জানি না। এটা প্রতিরোধের উপায় স্থির করাও কঠিন। তবে শান্তি অনিবার্য।

মিয়ানমার যদি মনে করে রোহিঙ্গা বিতাড়িত করে সে শান্তিতে থাকতে পারবে সে স্বপ্ন মিথ্যা। ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠীকেও সহজে নির্মূল করা যায় না। সম্ভবতো মিয়ানমার অশান্তির হাট বসালো যা মিয়ানমারের জন্য কল্যাণ জনক হবে না, বাংলাদেশের জন্যও নয়। সার্বিয়ায় কসোভোর আলবেনিয়া জাতিগোষ্ঠীকে নির্মূল সম্ভব হয়নি, বিলম্বে হলেও মিয়ানমার বুঝবে যে রোহিঙ্গা নির্মূলে তারাও ব্যর্থ হয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
নিজ বাড়ির সামনে ছাত্রলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
কয়রায় সুইডেনের প্রিন্সেস ক্রাউন ভিক্টোরিয়া
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
হলমার্কের দুর্নীতির এক মামলার রায় আজ
হলমার্কের দুর্নীতির এক মামলার রায় আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ