X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

মহামতি গৌতম বুদ্ধ বেঁচে থাকলে লজ্জায়-ঘৃণায় আত্মহত্যা করতেন!

চিররঞ্জন সরকার
১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৪০আপডেট : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:৪১

চিররঞ্জন সরকার আক্রান্ত-ভীত-সন্ত্রস্ত দুর্গত রোহিঙ্গারা আপাতত সবাই ‘জঙ্গি’, অন্তত মিয়ানমার সরকারের কথা শুনলে তেমনটাই মনে হয়। প্রশ্ন হলো, প্রায় দশ লাখ মানুষ সদলবলে একসঙ্গে জঙ্গি হয়ে গেল? রোহিঙ্গাদের বাস যেখানে, সেই মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে, গত ২৫ আগস্ট থেকে ফের শুরু হয়েছে তাণ্ডব। যাকে বলে কচুকাটা, তা-ই চলছে। বুড়ো, জোয়ান, নারী, শিশু— কেউ বাদ পড়ছে না। মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে প্রায় পৌনে তিন লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশ এবং অন্যান্য জায়গায় আস্তানা খুঁজছেন! এরা সবাই জঙ্গি? এই বাচ্চা, বুড়ো, জোয়ান, নারী, সবাই? সব রোহিঙ্গা? আরও রটানো হচ্ছে, ওরা নিজেরাই নিজেদের বাড়ি ঘরে আগুন দিয়েছে! কী ভয়ঙ্কর মিথ্যাচার!
মিয়ানমার সরকার বলছে, এই তাণ্ডব তো রোহিঙ্গা জঙ্গিরাই শুরু করেছে! ২৫ আগস্ট আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামের একটি জঙ্গি দলের আক্রমনে প্রাণ হারায় বেশ কিছু পুলিশকর্মী, এবং তার পর থেকেই শুরু হয় সামরিক অভিযান। কিন্তু প্রশ্ন হলো, একটা জঙ্গি বাহিনীর কিছু লোকের হিংস্র আক্রমণের জন্য কেন একটা গোটা সম্প্রদায়কে জঙ্গি তকমা এঁটে দেওয়া হবে? কেন তাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হবে?

সামান্য অজুহাতে যেভাবে এই উদ্বাস্তুদের জঙ্গি হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, তার পেছনে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক স্বার্থ অনুমান করা সম্ভব। অপরিসীম দুর্ভাগ্যের বিষয় যে এত বড় একটি মানবাধিকার সংকট এত দ্রুত ধর্মপরিচিতির ভিত্তিতে আলোচিত হতে শুরু করেছে, এবং কূটনীতির দাবার চাল আপাতত ধর্মরাজনীতির ভাষায় চালিত হচ্ছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ছাড়া এশিয়ার কোনও দেশ বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো সহানুভূতি দেখায়নি, এমন কী প্রতিবেশী রাষ্ট্রকে সামান্য পরোক্ষ ভর্ৎসনা করতেও তারা রাজি নয়। বাস্তবিক, মিয়ানমারের গৃহহীন ধর্ষিত লুণ্ঠিত রোহিঙ্গারা এখন বিশ্বের সবচেয়ে বন্ধুহীন উদ্বাস্তু!

উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত মিয়ানমারের প্রধানমন্ত্রী উ নু-র গণতান্ত্রিক সরকার রোহিঙ্গাদের পূর্ণ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, পরবর্তী সামরিক রাষ্ট্র তাদের নাগরিকত্ব অস্বীকার করে। স্বাধীনতার পরে সারা দেশ জুড়ে শুরু হয় বর্মীয় সংখ্যাগুরুদের বিরুদ্ধে নানা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহ। রোহিঙ্গারা আরাকানে নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র দাবি করেন, যেমন করেন মিয়ানমারের নানাপ্রান্তে অবস্থিত কাচিন, চিন ইত্যাদি গোষ্ঠির মানুষ। ১৯৭৪ সালে সামরিক রাষ্ট্রের নতুন আইন, ইমার্জেন্সি সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব হরণ করে। ১৯৭৮-এ সমস্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন দমনে শুরু হয় অপারেশন নাগা মিন। প্রচণ্ড অত্যাচার ও নিপীড়নের শিকার হয়ে দুই লাখ রোহিঙ্গা মানুষ নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম প্রদেশে আশ্রয় খুঁজতে আসেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ-এর অনুমান, খাবারের অভাবে সে সময় অন্তত ১২ হাজার মানুষ মারা যান। ১৯৮২-র সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে মিয়ানমারে বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করে। এর পরে বারে বারে আঘাত নেমে এসেছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপরে। ১৯৯০ ও সাম্প্রতিক ২০১২-র জাতিবাদী দাঙ্গা প্রকাণ্ড ইসলাম বিদ্বেষী এক কাণ্ডে পরিণত হয়। ২০১২-র রোহিঙ্গা বিদ্বেষী দাঙ্গায় ছাড় পাননি কামান মুসলমান বা অন্যান্য মুসলমান গোষ্ঠিরাও, যাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি আছে। রোহিঙ্গা বিদ্বেষের সূত্রপাত ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় থেকেই। আর এখন মিয়ানমারে তৈরি হয়েছে এমন এক ইসলাম বিদ্বেষী হাওয়া যে, নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী সু কি অবধি রোহিঙ্গা শব্দটি উচ্চারণ করেন না, উল্টে বলেন, রাখাইন প্রদেশে যে মুসলমানরা থাকেন তারা বহিরাগত!

টিভিতে কিংবা পত্রপত্রিকায় রোহিঙ্গা সংক্রান্ত খবরগুলো আর দেখতে পারি না। খবরগুলো পড়ে বা প্রতিবেদন ও ছবিগুলো দেখতে দেখতে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে! কী অসহায় অবস্থায় পড়ে ভিটে-মাটি ছেড়ে মানুষগুলো অনিশ্চয়তার ঘোর অন্ধকারের উদ্দেশে পা বাড়িয়েছে তাই দেখানো হচ্ছে। কখনও অবোধ শিশুর কাতর দৃষ্টি, কখনও নাফ নদীর জলে ভেসে আসা কিশোরীর লাশ! কখনও বনপোড়া হরিণীর মতো প্রাণভয়ে পালানো মায়েদের ভয়ার্ত চাহনি! কোলে-কাঁখের অবোধ শিশুদের প্রায় সবাই ন্যাংটো। বয়স্ক নারী-পুরুষদের হা৬তে-মাথায় ঘর ছাড়ার আগে যা কিছু জুটেছে সেটুকুই সম্বল। কারও হাতে বালতি, কারও হাতে মাদুর, কারওবা মাথায় পোটলা। মিয়ানমারের রাখাইন ছেড়ে নাফ নদী পেরিয়ে তারা চলে আসছে বাংলাদেশের জমিতে। প্রাণ মুঠোয় করে। একটু আশ্রয়ের খোঁজে। চোখে-মুখে তাদের এক পৃথিবী আতঙ্ক!

মাত্র দু’সপ্তাহ। তার মধ্যেই প্রায় দুই লাখ মানুষ ভিড় জমিয়েছে বাংলাদেশে। জাতিসংঘের হিসেবে এই সংখ্যা তিন লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে। অসংখ্য নৌকো ডুবছে সমুদ্রে। নাফ নদীতে। ভেসে উঠছে শিশুদের লাশ। যারা ভাগ্যবান, বাংলাদেশের মাটিতে খোলা আকাশের নীচে এক পেট খিদে ও একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে তারা অপেক্ষায়। সামান্য তফাতে বাংলাদেশের সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী বিজিবি-র সশস্ত্র উপস্থিতি। রোহিঙ্গাদের দুরাবস্থা দেখে মন ভিজে গেলেও আদেশ পালনে তারা বাধ্য। চোখ ঝাঁপসা তাদেরও। একদিকে কর্তব্য, অন্যদিকে বিপন্ন মানবতা। সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব যতো শক্তই হোক, তারাও তো মানুষ। তাইতো তারা অনিচ্ছায় ‘হাঁস-মুরগী তাড়ানো’র মতো করে একটু ‘হূশ হুশ’ করে বটে! কিন্তু তাতে প্রশ্রয়ের আর্তনাদই প্রকাশিত হয়। আসলে এই চরম অত্যাচারিত জর্জরিত এই মানুষগুলোর ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার উপায় তাদেরও অজানা।

উদ্বাস্তু এই মানুষেরা আজ নামগোত্রহীন। তাদের পরিচয় একটাই। তারা রোহিঙ্গা। বাংলাদেশের টিভি-রেডিও-খবরের কাগজগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলেই ইদানিং এই অসহায়তা মনকে গ্রাস করছে। অথচ মানবিক চরিত্রকে পায়ের নিচে ফেলে মিয়ানমারের সরকারি কর্তৃপক্ষ বলছে, রোহিঙ্গারা সন্ত্রাসবাদী। রাখাইন প্রদেশের প্রায় দশ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমান নাকি সবাই অবৈধ, অবাঞ্ছিত এবং অনুপ্রবেশকারী! ভারতের কর্তৃপক্ষও মিয়ানমারের ক্ষমতাসীনদের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছে। শক হুন পাঠান মোগল যে ভারতবর্ষের দেহে লীন হয়েছে, সেটাই তো সনাতন ভারতীয় চরিত্র! যে-অনুভব ‘দিবে আর নিবে মেলাবে মিলিবে’-র বাণী ছড়িয়ে দিয়েছে! সেই ভারত বিবেককে বিসর্জন দিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ আর সাম্প্রদায়িকতাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে আজ হতভাগ্য রোহিঙ্গাদের জন্য দরজা বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে!

তারা মুসলমান। তারা হতদরিদ্র। তারা সন্ত্রাসবাদী ও মৌলবাদীদের জন্য নরম মাটি। অতএব তারা অবাঞ্ছিত। তাদের বিদেয় করাটাই তাই একমাত্র জাতীয় কর্তব্য! কূটনীতির কূটকচালির ছবিটাও মনে ভেসে ওঠে। চীন মিয়ানমার নামক এই দেশটাকে মাথায় তুলে রেখেছে। তাদের সামরিক শাসকেরা মানবাধিকার ধুলোয় মিশিয়ে দিলেও চীনের কাছে তারা চোখের মণি হয়েই থেকেছে। রাজনীতি, কূটনীতি ও রাষ্ট্রনীতি এমনই নিষ্ঠুর। মিয়ানমারে ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ প্রচুর। মোদির ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি মাঠে মারা যাবে মিয়ানমার মুখ ফেরালে। যে-রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গারা উৎখাত হচ্ছে, সেখানেই বন্দর ও রাস্তা তৈরির কাজ করছে ভারত। মানবিকতার চোখে ভারতকে তাই ঠুলি পরে থাকছে! স্বামী বিবেকানন্দের ‘জীবে প্রেম করে যেই জন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’ এই বাণী আজ ভারতীয় কর্তাব্যক্তিদের উপহাস করছে!

কিন্তু সব দেশই তো ভারত নয়! কেন চুপ মুসলমান দুনিয়া? কেন সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রচ্যের দেশগুলো নিশ্চুপ? অন্যান্য মানবতাবাদী দেশগুলো কেন উত্তাল হয়ে উঠছে না? লাখ লাখ রোহিঙ্গার চাপ বাংলাদেশের পক্ষে নেওয়া কতটা সম্ভব সে কথা কেন কেউ বুঝতে চাইছে না? কেন সেভাবে সক্রিয় নয় জাতিসংঘ?

অসহায়তার পোর্ট্রেইট হয়ে ওঠা রোহিঙ্গাদের দুর্দশার ছবি ও কাহিনি পড়তে পড়তে বারবার ভেসে উঠছে অং সান সু কির মুখটা। মানবাধিকার রক্ষার নিরলস আন্দোলন তাকে গৃহবন্দি করে রেখেছিল। এই আন্দোলন ও আপসহীন চরিত্রই তাকে নোবেল পুরস্কার এনে দিয়েছে। সামরিক শাসকেরাও তার অধীনে গণতান্ত্রিক আবহকে মেনে নিয়েছে। আজকের সরকার চলছে তারই নির্দেশে। অথচ কী আশ্চর্য, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের দাবি, ভোটাধিকারের দাবি, তাদের বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা, তাদের বিরুদ্ধে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের ঘৃণ্য অত্যাচার বন্ধে তিনিও মুখে কুলুপ এঁটে বসে রয়েছেন! শুধু তাই নয়, চরম আশ্চর্য এটাই, সেনা প্রশাসকদের সঙ্গে এত বছরের লড়াইয়ের পর ক্ষমতায় এসে সু কিও সেই সেনাবাহিনীর তাবেদার হয়ে দেশ শাসন করছেন! অক্সফোর্ড গ্রাজুয়েট একটা মানুষ এতটা মনুষ্যত্বহীন হতে পারে?

যারা জীবন নিয়ে বাংলাদেশে এসেছেন, তাদের কেউ কেউ বলছেন, প্রয়োজনে আমাদের নাফ নদীর জলে চুবিয়ে মারো। তবু আমাদের ফেরত পাঠিও না। চোখের সামনে মা-বোনেদের ধর্ষণ, হত্যা, ঘর জ্বালানো, উৎখাত হওয়ার চেয়ে নাফ নদীর জলে ডুবে মরা ভালো! রোহিঙ্গাদের অত্যাচারিত জীবনের ছবি দেখে, তাদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবতে ভাবতে, মানবিকতার ধ্বজাধারীদের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে করতে বিশ্বের অভিভাবকদের চোখ ওলটানো রূপ দেখতে দেখতে মনে আসছে একটি ছবি! ছবিটি গৌতম বুদ্ধের। সেই কবে গৌতম বুদ্ধ পৃথিবীকে শান্তির বাণী শুনিয়েছিলেন! অথচ মিয়ানমারের বৌদ্ধরা তাকে লজ্জা ছাড়া আর কিছু দিতে পারল না! ধ্যানস্থ এই মানুষটি বেঁচে থাকলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির উপর সংঘটিত মিয়ানমারের বৌদ্ধধর্মাবলম্বী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বর্বরতা দেখলে লজ্জায়-ঘৃণায় নিশ্চিত আত্মহত্যা করতেন!

লেখক: কলামিস্ট

এফএএন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ