X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বাংলাদেশ সীমান্ত উন্মুক্ত

কাজী নাবিল আহমেদ
২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ২৩:৪৩আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০১৮, ১৯:২৫

কাজী নাবিল আহমেদ বার্মার সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী শিবির পরিদর্শনে কয়েকদিন আগে আমি কক্সবাজার সফর করেছি। সেখানে আমি স্পষ্টতই হাজার হাজার হতাশ মানুষের দেখা পেয়েছি। এদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে অসহায়ভাবে তারা বসেছিল। লাইনের পর লাইন দিয়ে মানুষ সামান্য খাবার বা ওষুধের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করছে। দূরে আরও ঘর তৈরির জন্য পাহাড়ের  কর্দমাক্ত ঢালু পরিষ্কার করা হচ্ছে।
রোহিঙ্গাদের ওপর খুন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগের গল্পগুলো যন্ত্রণাদায়ক। আক্রান্তদের অনেকে স্বীকার করেছেন, নিপীড়কদের মধ্যে তাদের প্রতিবেশীরাও ছিল। প্রথম দিকে শরণার্থীদের দেখে এবং তাদের বেপরোয়া কাহিনী শোনার পর বিস্মিত হলাম যে, কিভাবে কোনও বিশ্বনেতা এমন দুঃখজনক ঘটনা অস্বীকার করতে পারেন।
মাত্র তিন সপ্তাহে বার্মা থেকে আনুমানিক চার লাখ ২১ হাজার রোহিঙ্গা স্রোতের মতো বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সশস্ত্র বাহিনী এবং মিলিশিয়ারা তাদের ওপর নৃশংস হামলা চালিয়েছে; যা ছিল পরিকল্পিত। রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর দাবি, ২৬ আগস্ট বার্মিজ সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞের অপারেশন শুরু হওয়ার পর এ পর্যন্ত হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। দুই দেশের মধ্যকার নাফ নদীর তীরে ভেসে এসেছে বহু মরদেহ।

বার্মার দাবি, তাদের নিরাপত্তা বাহিনী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ)-এর হামলার জবাব দিচ্ছে। ২৫ আগস্টের ওই হামলায় নিরাপত্তা বাহিনীর ১১ সদস্য নিহত হন। তবে ওই এলাকায় বাইরের কারও প্রবেশের অনুমতি না দেওয়ায় এসব দাবির সত্যতা নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা যায়নি। এমনকি যদি বার্মিজ সরকারের বিবরণও সত্য হয়; তাহলেও একটি বিদ্রোহী গ্রুপের এক রাতের হামলার প্রতিক্রিয়ায় শত শত মানুষকে খুন করা এবং হাজার হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করা অগ্রহণযোগ্য।

এটা উল্লেখযোগ্য যে, রোহিঙ্গারা দশকের পর দশক ধরে নির্যাতন সহ্য করলেও এআরএসএ  একটি সাম্প্রতিক উপাদান। সামগ্রিকভাবে এই সম্প্রদায় পুরোপুরিভাবে ইসলামের একটি মধ্যমপন্থী ধারার অনুশীলন বা চর্চা করে।

কিন্তু আজ রোহিঙ্গাদের ওপর যে সহিংসতা ও অবিচারের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে; তা ভয়াবহ মাত্রায় পুরো অঞ্চলজুড়ে প্রতিক্রিয়া নিশ্চিত করতে পেরেছে। ১৯৮২ সালে নাগরিকত্ব ছিনতাইয়ের মাধ্যমে বার্মা তাদের রাষ্ট্রহীন, নিঃস্ব মানুষে পরিণত করে। এমন একটি যুগ যখন  কাল্পনিক বা অতিরঞ্জিত অভিযোগও প্রায়ই মৌলবাদের একটা ফ্যাক্টর হয়ে ওঠে; তখন উগ্র চরমপন্থীদের বিরুদ্ধে বার্মার লড়াইয়ের মিথ্যা দাবি ভবিষ্যতের জন্য একটি ঝুঁকি হয়ে উঠছে।

বার্মা এটাও দাবি করে যে, রোহিঙ্গারা "বাঙালি" এবং এর ফলে তারা বাংলাদেশের অন্তর্গত। অথচ এর জোরালো নথিপত্র রয়েছে যে, রোহিঙ্গারা বার্মার রাখাইন রাজ্যে শত শত বছর ধরে বসবাস করে আসছে। যখন এটি একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল, তারও আগে থেকে। তারা ১৭৯৯ সালের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রতিবেদনগুলো হাজির করছে। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে রোহিঙ্গারা বহুবার পার্লামেন্টে প্রতিনিধিত্ব করেছে। এমনকি রোহিঙ্গারা যদি জাতিগতভাবে বাঙালি হয়ও, তার ওপর ভিত্তি করে পুরো জনগোষ্ঠীকে তাড়িয়ে দেওয়া যায় না।

জাতীয়তাবাদী অনুভূতি জাগিয়ে তোলার মাধ্যম হিসেবে সেনাবাহিনীর জেনারেলরা অতীতে এই রোহিঙ্গা মুসলিমদের সাধারণ শত্রু হিসেবে ব্যবহার করেছেন। গত কয়েক বছর ধরে তারা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের মন জয় করতে এই কৌশল পুনরুজ্জীবিত করেন; যারা ২০০৭ সালের তথাকথিত সেফরন বিপ্লবের সময় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন।

রাশিয়া ও চীন এখন বার্মার পাশে দাঁড়িয়েছে। তারা বলছে, শরণার্থী সংকট দেশটির "অভ্যন্তরীণ বিষয়"। ভারতও প্রাথমিকভাবে বার্মিজ নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। যদিও দিল্লি তার প্রাথমিক অবস্থান পরিবর্তন করেছে এবং সংযম প্রদর্শন ও পরিপক্কতা দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে।

মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যদিও ভয়ানক, তবে সেটা আসলে তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু যখন লাখ লাখ শরণার্থী একটি প্রতিবেশী দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তখন আর এটি শুধু "অভ্যন্তরীণ" ব্যাপার থাকে না।

শরণার্থীদের বিশাল স্রোতের জন্য বাংলাদেশ তার সীমান্ত খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দেশের অনুভূতি তুলে ধরে বলেছেন, “১৬ কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে, আরও সাত লাখ মানুষকেও খাওয়াতে পারবো।”

কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের একটি বিশাল জনসংখ্যাকে আশ্রয় দিয়েছে। আমরা সব সময় শরণার্থীদের ব্যাপারে এতটা অতিথিপরায়ণ ছিলাম না। কিন্তু সর্বশেষ ভয়াবহ মাত্রার দৃশ্যমান অবিচার আমাদের মনোভাবে বিশাল  সমুদ্রের মতো  পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশে অনেকেই রোহিঙ্গাদের দুর্দশায় আমাদের ১৯৭১ সালের সংকটকালীন সময়ের কথা স্মরণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এক কোটি বাংলাদেশি ভারতে আশ্রয় নেন।

বাস্তববাদী রাজনীতির দুনিয়ায় কিছু পরাশক্তি হয়তো বাংলাদেশের তুলনায় মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ককে অধিক মূল্যায়ন করতে পারে। মিয়ানমার সরকার মানবতার বিরুদ্ধে যে অপরাধ করছে, তারা হয়তো সেটি এড়িয়ে যেতে পারে। কিন্তু মিয়ানমারের কর্মকাণ্ড ভবিষ্যতের জন্য অনেক বেশি অসন্তোষের বীজ বপন করছে। এটা শুধু নৈতিকভাবেই নয় বরং আঞ্চলিক কৌশলগত স্বার্থেও দাবি করার সময় এসেছে যে, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

লেখক:  পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি সদস্য

/এমপি/এপিএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
পায়ুপথে ৭০ লাখ টাকা সোনা নিয়ে ভারতে যাচ্ছিল পাচারকারী
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
বিশ্বকাপের আগে আয়ারল্যান্ডে টি-টোয়েন্টি খেলবে পাকিস্তান
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
গাজায় ত্রাণ পৌঁছাতে ইসরায়েলকে ক্রসিং খুলে দেওয়ার নির্দেশ জাতিসংঘের
হৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালহৃদরোগ বিভাগে ছারপোকার রাজত্ব, হাসপাতাল পরিচালক দুষছেন রোগীদের
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ