X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

কুর্দিস্তানের গণভোট এবং স্বাধীনতা

আনিস আলমগীর
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৫:১০আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৬:৪৭

আনিস আলমগীর ইরানের উত্তরে যেখানে মোসুল ও আসিরীয় সভ্যতার ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাচীন নিনেভে নগরী আর তুরস্কের দক্ষিণ পূর্ব ইরাক সংলগ্ন অঞ্চল, ইরানের পশ্চিমে তাব্রিজের লাগোয়া অঞ্চল আর সিরিয়ার প্রাচীন আলেপ্পো নগরীর পূর্ব পাশের অঞ্চলটার নাম কুর্দিস্তান। কুর্দিরা এখানে বসবাস করে আসছে প্রাচীন কাল থেকে। তারা একই নৃগোষ্ঠী, নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ভাষার বন্ধনে আবদ্ধ। কুর্দিদের অধিকাংশই সুন্নি মুসলিম, তবে অন্য ধর্মের লোকও আছে।
কুর্দিদের এলাকাটা এখন আর একত্রিত এলাকা নয়। কিছু অংশ তুরস্ক, কিছু অংশ ইরাক, কিছু অংশ ইরান, কিছু অংশ সিরিয়া আর আর্মেনিয়ায় সঙ্গে।  কুর্দিস্তানটা এসব রাষ্ট্র ভাগ করে নিয়েছে। তাদের জনসংখ্যা আড়াই থেকে সাড়ে তিন কোটির মতো। মধ্যপ্রাচ্যে তারা চতুর্থ বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী, কিন্তু তারা কখনোই তাদের নিজেদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পায়নি।
হতভাগা এ জাতি খুবই বীরের জাতি হিসাবে বিশ্ব ইতিহাসে পরিচিত। ধর্মযুদ্ধের গাজী সালাউদ্দীন আইয়ুবী কুর্দিদেরই সন্তান। তিনি কুর্দিদের নিয়ে ধর্মযুদ্ধ করেছিলেন সম্মিলিত ইউরোপীয় বাহিনীর সঙ্গে। তারা বহু বছর যুদ্ধ করেছিলো গাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে কিন্তু যীশু খ্রিস্টের কবরটাও তাদের দখলে নিতে পারেনি।

কামাল আর্তাতুক মোসুল পর্যন্ত তুরস্কের অধিকারে রাখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু লীগ অব ন্যাশন কর্তৃক নিযুক্ত অছি ব্রিটেন মোসুল এলাকা তুরস্ককে প্রদান করতে সম্মত হয়নি। সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য তো তুরস্কেরই ছিল কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও তুরস্কের পরাজয়ের পর লীগ অব ন্যাশন ইরাক, ট্রান্স জর্দান আর ফিলিস্তিনের অছি নিযুক্ত করে ব্রিটেনকে। আর  সিরিয়ার অছি নিযুক্ত করে ফ্রান্সকে।

তুরস্ককেও ভাগাভাগি করে মিত্রশক্তির অংশীদারদের মাঝে বিলি বন্টনের কথা ছিল। কিন্তু আনাতোলিয়ার ইন্সপেক্টর জেনারেল ছিলেন কামাল পাশা। তিনি মিত্র শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বর্তমান অবস্থায় তুরস্ককে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে টিকিয়ে রেখেছিলেন। এ কারণে তুরস্কের লোক তাকে আর্তাতুক বলে। আর্তাতুক এর অর্থ হচ্ছে পিতা।

বসফরাস প্রণালীতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ইস্তাম্বুল রাশিয়াকে দেওয়ার কথা ছিল। বসফরাস প্রণালী কৃষ্ণ সাগরকে ভূমধ্যসাগরের সঙ্গে সংযোগ করেছে বহিঃবিশ্বে নৌ-পথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য রাশিয়ার কাছে বসফরাস প্রণালীই ভরসা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কামাল আর্তাতুক যখন তুরস্ক রাষ্ট্রটিকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করছিলেন তখন তিনি জাতিগত ভিন্নতা পরিহার করে একজাতির রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্ককে প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা চালান যে কারণে তিনি ১৪ লাখ তুর্কিকে গ্রীক থেকে আনাতোলিয়া নিয়ে আসেন এবং ৭ লক্ষ গ্রীককে আনাতোলিয়া থেকে গ্রীসে পৌঁছিয়ে দেন।

কামাল পাশা প্যান-তুর্নিজম বা প্যান-তুর্কিসম-এ বিশ্বাস করতেন কারণ তুর্কিরা জাতিতে তুরানী। কামাল পাশা নিজের মতবাদের বিপরীতে একটা কাজ করলেন। তিনি কুর্দিস্তানের বেশ কিছু জায়গা নবপ্রতিষ্ঠিত তুরস্কের সঙ্গে জুড়িয়ে দিলেন। অথচ কুর্দিরা কখনও তুরানী নন।

অবশ্য হেজাজ, ইরাক, কুর্দিস্তান, ট্রান্স জর্দান, ফিলিস্তিন ও সিরিয়া তুর্কি সম্রাজ্যের অধীনে ছিল শতাব্দীর পর শতাব্দী। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কুর্দি নেতা শেখ ছৈয়দ, ড. ফুয়াদ প্রমুখ কুর্দিস্তানের স্বাধীনতা লাভের জন্য সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন। যে অংশ জুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তুরস্কের সঙ্গে তার বিরোধিতা করায় শেখ সৈয়দ ড. ফুয়াদসহ বহু কুর্দি নেতাকে কামাল পাশা ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিলেন। তুরস্ক আত্মরক্ষার সংগ্রাম থেকে কিভাবে স্বাধীনতাকামী কুর্দি জাতিকে পদানত করার উদ্যোগ নিল তা এক আশ্চার্য ব্যাপার।

১৯২৯ সালে কুর্দিরা পুনরায় বিদ্রোহ করেছিলো। তাও কামাল পাশা দমন করেছিলো নির্মমভাবে। যে জাতি স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তার জন্য ন্যায্য মূল্য দিতেও প্রস্তুত তাকে কখনও চিরকাল দমন করা সম্ভব বলে ইতিহাস বলে না।

কুর্দিস্তান ওয়ার্কাস পার্টি (পিকেকে) দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে তুরস্কের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছে। ১৯৭৮ সালের আবদুল্লা ওচালান পিকেকে প্রতিষ্ঠা করেন। তার লক্ষ্য ছিল তুরস্কের কুর্দিদের জন্যএকটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। ছয় বছর পর সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হলে তাতে ৪০ হাজার লোক নিহত, এবং লক্ষ লক্ষ লোক গৃহচ্যুত হয়। তবে এখন পিকেকে স্বাধীনতার পরিবর্তে স্বায়ত্বশাসন চাইছে। তবে যুদ্ধবিরতি হলেও লড়াই পুরোপুরি থামেনি।

আবার কুর্দিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি (কেডিপি) ও প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন অব কুর্দিস্তান (পিইউকে) তুরস্কের সঙ্গে সহযোগিতা করে পিকেকে-কে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। পিকেকের জাতীয়তাবাদীরা মাক্সবাদী ঘরনার তারা অবাধ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। সাদ্দাম হোসেনের সময়ে ইরাকী কুর্দিরা কঠিন অত্যাচারের মধ্যে ছিল। সাদ্দাম কুর্দিস্তানে কেমিক্যাল অস্ত্রও নাকি ব্যবহার করেছিলেন। কুর্দিরা কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে স্থিত হয়েছিলো আমেরিকা যখন ইরাক দখল করে নেয়। আমেরিকা ইরাকের কুর্দি এলাকাকে নো ফ্লাই জোন ঘোষণা করে। সাদ্দামের পরে আমেরিকানেরা যখন ইরাকের সরকার গঠন করে তখন কুর্দি নেতা জালাল তালেবানীকে ইরাকের অন্তবর্তী প্রেসিডেন্ট করেছিলেন আর আইয়াদ আলাভীকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। পরবর্তীতে নুরি আল মালিকি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।

২০০৩ সালে সাদ্দামের পতনের পর ইরাকের তিনটি প্রদেশ– ইরবিল, ডোহুক ও সুলাইমানিয়ায় - কুর্দিরা আঞ্চলিক সরকার গঠন করে সর্বোচ্চ স্বায়ত্বশাসন ভোগ করছে। কুর্দিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টি ও প্যাট্রিয়টিক ইউনিয়ন অব কুর্দিস্তান এখন কুর্দিস্তানকে স্বায়ত্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। এখন কুর্দিস্তানে তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক ব্যবস্থা চলে। কুর্দিদের পররাষ্ট্রনীতিও তাদের নিজস্ব। ইরাকি কুর্দিস্তানের নিজস্ব পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, এবং সেনাবাহিনী আছে। সবচেয়ে বড় কথা, তাদের আছে তেল। তবে আশপাশের দেশে থাকা সব কুর্দিদের নিয়ে একটি দেশ গঠনের স্বপ্ন অনেক কুর্দিই দেখে থাকেন।

অবশ্য তুরস্ক ও ইরান কখনও কামনা করে না যে গণতন্ত্রপন্থী ইরাকের কুর্দিরা স্থিতিশীলতার মাঝে থাকুক। সুযোগ পেলেই তারা তাদেরকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করে। কুর্দিস্তানে স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোটের আগে তুরস্ক এবং ইরান সীমান্তে সামরিক মহড়া শুরু করেছে। তুরস্ক এবং ইরান এই গণভোটের তীব্র বিরোধী, কারণ এই দুই দেশের আশঙ্কা তাদের দেশের কুর্দি জনগোষ্ঠীর মধ্যে এর প্রভাব পড়বে।

কুর্দিস্তান পূর্ণ স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে আত্ম-প্রকাশ করতে পারলে তা হবে স্থলভূমি ধারা পরিবেষ্টিত দেশ। কোনও নৌবন্দর থাকবে না দেশটার। প্রয়োজনে তাকে ব্যবহার করতে হবে ইরাকের বসরা বন্দর যা কুর্দিস্তান থেকে বেশ দূরে। তবে তার ওপর দিয়ে টাইগ্রিস নদী প্রবাহিত হয়েছে।

কুর্দিস্তান খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ এলাকা। তুরস্কের একটা উপলব্ধি ২০০৩ সাল থেকে আমরা খুবই উৎসাহের সঙ্গে লক্ষ করছি যে তুরস্ক কুর্দি রাষ্ট্রকে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে গণ্য করছে এবং তারা বলছে যে কুর্দি রাষ্ট্রটি আঙ্কারার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ থাকবে। এবং রাষ্ট্রটি গ্যাস সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হবে। তুর্কিরা ইরাকের কুর্দিস্তানে গ্যাস পাইপ লাইন বসানোর ব্যাপারে আর্থিক সহায়তাও প্রদান করেছে।

গতকাল সোমবার ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭ ইরাকের কুর্দিস্তানে স্বাধীনতার বিষয়ে গণভোট হয়েছে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী হায়দার আল আবাদী বলেছেন তারা দ্বিতীয় কোনও ইসরায়েল রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হতে দেবেন না। আবাদী এ গণভোট ঠেকাতে পারেনি কিন্তু ভোটের রেজাল্ট নিয়ে কুর্দিদের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহী নয়। কুর্দিস্তানের আঞ্চলিক সরকার কর্তৃক পরিচালিত বিতর্কিত এই নির্বাচনকে ইরাক সরকার ইতিমধ্যে মেনে না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।  প্রধানমন্ত্রী আবাদী বলেছেন, এটা অসংবিধানিক।  

আজ মঙ্গলবার পর্যন্ত ফলাফলের যে পূর্বাভাস তাতে ‘হ্যাঁ’ ভোট অর্থাৎ কুর্দিস্তানের স্বাধীনতার পক্ষেই জনমত সুস্পষ্ট।  ৫০ লাখ ভোটারের প্রায় ৭৮ শতাংশ ভোট দিয়েছে। ইরাক ফলাফল প্রত্যাখ্যান করলেও কুর্দিদের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে দমন পীড়নে যেতে পারবে না কারণ আমেরিকা সেখানে নো ফ্লাই জোন করে রেখেছে।  কুর্দিদের প্রতি আমেরিকা সহানুভূতিশীল।  আমেরিকার সহানুভূতি পাওয়ার কারণে কুর্দিরা এ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছে।

ফলে বলা যায়, তুরস্ক এবং ইরান তাদের কুর্দিদের এ রাষ্ট্রে যোগদানের বিষয় নিজেরা প্রতিরোধ করতে পারলেও আবাদী ইরাকের কুর্দিদের প্রতিরোধ করতে পারবে না।  সিরিয়ার কুর্দিরাও শেষ পর্যন্ত এ রাষ্ট্রে যোগদানের সুযোগ পাবে বলে মনে হয়। এ রাষ্ট্রটির উত্থান হলে এবং পূর্ণ-স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে তার কর্মকাণ্ড আরম্ভ করলে এ অঞ্চল উতলা হয়ে উঠবে এবং ইরান ও তুরস্কের কুর্দিরাও তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে জোরধার করবে। শেষ পর্যন্ত যা ঠেকানো যাবে না।  গত ৮০ বছরের বেশি সময় ধরে কুর্দিরা তাদের স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঢেলে আসছে-  একদিন না একদিন তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবেই।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]              

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
দিন দিন নাবিকদের সঙ্গে কঠোর আচরণ করছে দস্যুরা
হলমার্কের দুর্নীতির এক মামলার রায় আজ
হলমার্কের দুর্নীতির এক মামলার রায় আজ
৫ ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল স্বাভা‌বিক
৫ ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল স্বাভা‌বিক
সুইডেনের বিপক্ষে পর্তুগাল দলে জায়গা হয়নি রোনালদোর
সুইডেনের বিপক্ষে পর্তুগাল দলে জায়গা হয়নি রোনালদোর
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ