X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

দুর্গতিনাশ হবে কি?

শান্তনু চৌধুরী
২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:৪১আপডেট : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৭:৪২

শান্তনু চৌধুরী ঢাকেতে কাঠির বাড়ি, শরতে পূজার গন্ধ। শিউলি ফুলের চাদর বিছানো পথ, ভোরে হালকা ঠাণ্ডা। সব মিলিয়ে একটা উৎসবের আমেজ। মহালয়ায় দেবীপক্ষের আবাহনের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে মূলত শারদীয় দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতা। বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র উদাত্ত কণ্ঠে আহ্বান করেছেন, ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে বেজে উঠেছে আলোকমঞ্জির, ধরণীর বহিরাকাশে অন্তরিত মেঘমালা, প্রকৃতির অন্তরাকাশে জাগরিত; জ্যোতির্ময়ী জগৎমাতার আগমনী বার্তা, আনন্দময়ী মহামায়ার পদধ্বনি, অসীম ছন্দে বেজে ওঠে, রূপলোক ও রসলোকে আনে নবভাবনা ধুলার সঞ্জীবন, তাই আনন্দিতা শ্যামলী মাতৃকার চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ীতে আবাহন’। সনাতন ধর্ম মতে, এবার দেবীর আগমন নৌকায় আর গমন ঘোড়ায়। পৌরণিক শাস্ত্রমতে, এতে ঝড়, অতিবৃষ্টির শঙ্কার পাশাপাশি রয়েছে শস্যবৃদ্ধির সম্ভাবনা। আবার ঘোড়ায় গমন মানে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতাও বাড়বে। দুর্গাকে বলা হয় দুর্গতিনাশিনী। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে দেশের মানুষের দুর্গতি কমার কোনও কারণ নেই বরং বাড়বে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সামান্য কথোপকথন হয়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তিনি (ট্রাম্প) শুধু জিজ্ঞেস করেছিলেন, বাংলাদেশ কেমন আছে? আমি বলেছিলাম, ভালো, তবে আমাদের একমাত্র সমস্যা মিয়ানমার থেকে আসা শরণার্থীরা। কিন্তু শরণার্থীদের নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করেননি’। শেখ হাসিনা মন্তব্য করেন, ‘শরণার্থীদের বিষয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান পরিষ্কার। সেজন্য রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিষয়ে ট্রাম্পের সহায়তা চাওয়া কোনও কাজ হবে না। আমেরিকা ঘোষণা করেছে যে তারা শরণার্থীদের গ্রহণ করবে না। আমি তার কাছ থেকে কী আশা করতে পারি?’ আমাদের প্রধানমন্ত্রীর এই প্রত্যয়দৃপ্ত বক্তব্য সবমহলে প্রশংসিত হয়েছে। সবাই সাধুবাদ জানিয়েছেন। আল জাজিরা এই বক্তব্য নিয়ে প্রমো করেছে। এটিও বিশ্বনেতা হিসেবে শেখ হাসিনাকে গৌরবোজ্জ্বল করেছে। অবশ্য এর দু’দিন পরই ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের পাশে থাকার ঘোষণা দিয়েছে ও ত্রাণসামগ্রী পাঠাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ থেকে আরও ত্রাণসামগ্রী আসছে। কিন্তু এভাবে কতদিন। এতে দুর্গতিনাশ হচ্ছে কী? আমরা হয়তো গর্ব করে বলছি, ষোলো কোটি মানুষকে খাওয়াতে পারলে আরও দশ লাখ মানুষকে খাওয়াতে পারব। কিন্তু সমস্যার কথা বলছি না। ২৩ সেপ্টেম্বর থেকে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণ ও পুনর্বাসনের দায়িত্ব সেনাবাহিনী নেওয়ার পর শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু এর আগেই দেশের বিভিন্নস্থানে ছড়িয়ে পড়তে যাওয়া রোহিঙ্গাদের আটকের খবর এসেছে। অনেকে হয়তো ফাঁক-ফোকর গলে বেরিয়ে গেছে। পাহাড়ের পর পাহাড় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। এসব ক্ষতি আর কখনও পূরণ হবে না বলে ইতোমধ্যে পরিবেশবিদরা মত দিয়েছেন।

সবচেয়ে বড় কথা যে দেশটি এই সংকটের জন্য দায়ী সেই দেশের নেত্রী অং সান সু চি নিজের ভাষণে মিথ্যাচার করেছেন। তিনি এমনভাবে কথা বলেছেন, যেন সেদেশের রাখাইন রাজ্যে কোনও ঘটনাই ঘটেনি। কিন্তু গুগল ম্যাপ দিয়ে অ্যামেনেস্টি, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন গণমাধ্যম সহিংসতার সচিত্র প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন। বাংলা ট্রিবিউনের প্রতিনিধি দুই ঘণ্টা থেকে তুলে এনেছেন ধ্বংসযজ্ঞের চিত্র। কিন্তু জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সু চি বলেছেন, সেপ্টেম্বর মাসের পাঁচ তারিখের পর থেকে রাখাইনে কোনও অভিযান চালানো হয়নি। বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়েও তিনি যে কথা বলেছেন, সেখানেও সত্য গোপনের চেষ্টা রয়েছে। তিনি বলেছেন, বৈধ নাগরিকত্ব প্রমাণ করে মিয়ানমার নাগরিকদের ফেরত নেওয়া হবে। কিন্তু প্রকৃত কথা হচ্ছে, সে দেশের সরকার রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে কোনও কাগজপত্র দেয়নি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে যোগ দিয়েছিলেন সে দেশের ভাইস প্রেসিডেন্ট হেনরি ভ্যান থায়ো।  রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে দেশটির রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা অং সান সু চি’র বক্তব্যের প্রতিধ্বনি করেছেন তিনি। জাতিসংঘ ভাষণে রোহিঙ্গাদেরকে তিনি ‘মুসলিম’ হিসেবে তুলে ধরেন। সু চি’র মতো করেই দাবি করেন, বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার বাংলাদেশে পালিয়ে আসার কারণ সম্পর্কে তিনি অজ্ঞাত। বাংলাদেশের দুর্গতির আরও কারণ হলো প্রতিবেশী শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো তার পাশে নেই। বিশেষ করে ভারত, চীন ও রাশিয়া। তারা নিজেদের স্বার্থেই মিয়ানমারের পক্ষ নিয়েছে। তবে বাংলাদেশকে ত্রাণ দিয়ে সহায়তা করছে। ভারত সেদেশে যাতে রোহিঙ্গা ঢুকতে না পারে সে জন্য মরিচের গুঁড়া ও স্ট্যান্ড গ্রেনেড ছুড়ছে। দেশের স্বার্থে তা তারা করতেই পারে। কিন্তু আমরা অতি উদারতা দেখিয়ে যা করলাম, তার দুর্গতি সহজেই কাটবে বলে মনে হয় না। জাতিসংঘে মহাসচিব ছাড়া অন্য কোনও রাষ্ট্র খুব জোরালোভাবে বাংলাদেশকে সমর্থন করছে, তেমনটি মনে হয় না। যারা করছে, তারা তলে তলে মিয়ানমারের সঙ্গেও সম্পর্ক বজায় রাখছে। এর কারণ অবশ্য স্পষ্ট। মিয়ানমারও রোহিঙ্গাদের ‘মুসলিম সন্ত্রাসী’ আখ্যা দিয়ে ফায়দা তুলেছে। কারণ পৃথিবীতে তালেবান, আল-কায়দার মতো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর কারণে মুসলমানদের নানা হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে। হয়তো বাংলাদেশে যারা পালিয়ে এসেছে এদের মধ্যে সন্ত্রাসী নেই, কিন্তু সৃষ্টি হতে কতোক্ষণ। স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা এই শঙ্কা করছেন যে, বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিরাপত্তার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে তাদের অভাবও দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে সন্ত্রাসী বানানোর অপতৎপরতা চালানো হতে পারে, এমনিতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে উগ্রপন্থার ভাব দীর্ঘকাল ধরেই। দুর্গতি আরও রয়েছে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মুসলিমদের মধ্যে অন্তত ১৬ হাজার নারী অন্তঃসত্ত্বা। বাস্তব সংখ্যা আরও বেশি। তারা জন্ম নেবে বাংলাদেশে।

একেকটি রোহিঙ্গা পরিবারে সন্তানের সংখ্যা শুনে আঁতকে উঠতে হয়। এরা হয়তো আদিকালের সেই প্রবাদটি বিশ্বাস করে বসে আছে, ‘পেট দিয়েছেন যিনি, অন্ন দেবেন তিনি’। ইতোমধ্যে দেখা গেছে বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে জন্মনিরোধক যেসব সামগ্রী রোহিঙ্গাদের দেওয়া হয়েছে, তা রাস্তায় পড়ে আছে। কেউ ব্যবহারই করছে না। অবশ্য রোহিঙ্গা নিয়ে দুর্গতির জন্য মিডিয়াও কম দায়ী নয়। অতিমাত্রায় মানবিক হয়ে উঠছে কোনও কোনও সংবাদমাধ্যম। তারা যা বলছে, তা আমরা মস্তিষ্ক দিয়ে বিচার না করে হৃদয় দিয়ে বিচার করা শুরু করেছি। সংবাদমাধ্যম বলছে, নারী অন্তঃসত্ত্বা হলে নাকি সেনারা ধর্ষণ করে না। কিন্তু কথা হচ্ছে সেটা তো বিবাহিতদের ক্ষেত্রে। অবিবাহিত নারীদের তাহলে কী হচ্ছে? কোনও কুমারী মায়ের খবর তো জানা হলো না। অনেকে বলছে, সেনাবাহিনী ছুরি দিয়ে গলা কাটছে। এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। সেনাবাহিনী গুলি করে। হয়তো স্থানীয় মগরা (যেমনটি আমাদের রাজাকার ছিল) ছুরি চালাতে পারে। সংবাদমাধ্যম এসব খবর আবেগ মিশিয়ে প্রচার করছে। কিন্তু দুর্গতির শেষ হবে না, রোহিঙ্গারা যদি বাংলাদেশেই থেকে যায় এবং সমস্যার সমাধান না হয়। যেমনটি আগে থাকা রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয়রা সবসময় আতঙ্কে ছিলেন। তিন পার্বত্য জেলায় মিলিয়ে জনসংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এখন যে হারে রোহিঙ্গা বাড়ছে, এক সময় না তারা নিজেরাই সংখ্যাগুরু হয়ে স্বাধীনতার দাবি করে বসে! মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গারা বাঙালি হলেও মিয়ানমারের বাঙালি, মুসলমান হলেও মিয়ানমারের মুসলমান, সন্ত্রাসী হলেও মিয়ানমারেরই সন্ত্রাসী। এদের নিয়ে দুর্গতি আরও উস্কে দিচ্ছে দেশের এক শ্রেণির অতি আবেগী মানুষ। তাদের নানা ইশারা-ইঙ্গিতের কারণে ইতোমধ্যে বৌদ্ধরা ত্রাণ দিচ্ছে, মানববন্ধন করেছে। মিয়ানমারের প্রতি নিন্দা জানিয়েছে। এর মধ্যে ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও কাজ করছে। আবার এক শ্রেণির সন্ত্রাসীর জন্য সবচেয়ে সহজকাজ হিন্দুদের আক্রমণ করা। ইতোমধ্যে প্রতিমা ভাঙচুরের অনেক ঘটনা ঘটেছে। সাম্প্রদায়িকতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় নিজস্ব দায়বোধ থেকে সংবাদমাধ্যম এসব প্রচার করে না। কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঠিকই জানান দেয়। এর মধ্যে  ২২ সেপ্টেম্বর ফরিদপুরের মধুখালীতে হিন্দুদের ছয়টিসহ বিভিন্ন ধরনের সাতটি স্থাপনায় আগুন দেওয়ার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে এসেছে।

বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সমস্যা এখন বড় দুর্গতি। এছাড়া সম্প্রতি দুর্গতি হিসেবে যোগ হয়েছে চালের দাম বৃদ্ধি। যদিও বলা হচ্ছে, দু’তিন টাকা কমেছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এত বেড়েছে যে, দু’তিন টাকার কমলে সাধারণ মানুষের কোনও সুফল আসে না। হাওরের বন্যাদুর্গতের দুর্গতি কমেনি। দেশের বিভিন্নস্থানে বন্যার ফলে রাস্তাঘাটে যে দুর্গতির সৃষ্টি হয়েছে, তা মেরামতে নাকি প্রায় দু’শ কোটি টাকা লাগবে। হাওরে ছিল না ঈদের আনন্দ, নেই পূজারও। চট্টগ্রামের পাহাড় ধসের ক্ষত এখনও শুকায়নি। এছাড়া সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের কোন্দল তো এখনও থামছে না। সব মিলিয়ে দুর্গতি যে সহসা নাশ হচ্ছে না তা বলাই বাহুল্য। কারণ আগামীতে নির্বাচন। সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, সরকারবিরোধী চক্র ততই সক্রিয় হবে। এরইমধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সব মিলিয়ে আগামীতে আরও যে যে দুর্গতি আসছে, সেটা মোকাবিলায় এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিআই-এম ইন্ডিয়া জোট নয়, বিজেপির এজেন্ট: মমতা
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
‘আমাদের জন্য যারা বেইমান, ভারতের তারা বন্ধু’
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
টানেলে অপারেশনাল কাজে গেলে টোল দিতে হবে না জরুরি যানবাহনকে
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি, সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি, সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ