X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

আমরা মানুষের মতো কিন্তু কতটা মানবিক?

প্রভাষ আমিন
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:০৩আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:১১

প্রভাষ আমিন ভিডিওটি আমি দেখেছি, একাধিকবার দেখেছি। আসলে পেশাগত কারণে দেখতে বাধ্য হয়েছি। এখন মনে হচ্ছে ভিডিওটি দেখা উচিত হয়নি আমার। না দেখলেই ভালো হতো। ভিডিওটি আমার মাথায় ঢুকে গেছে। সত্যি বলতে আমি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে গেছি। সাগর নামের যে ছেলেটিকে ইলেকট্রিক পোলে বেঁধে পেটানো হচ্ছে, তার বয়স ১৬, একদম আমার ছেলে প্রসূনের বয়সী। লম্বায়ও প্রসূনের সমানই হবে। আমি প্রসূনকে বুকে আগলে রাখি, ভালো স্কুলে পড়াই, ভালো খাওয়ানোর চেষ্টা করি। কিন্তু দরিদ্র পরিবারের সন্তান সাগরের স্কুলে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। সংসারে বাবাকে সাহায্য করতে এ বয়সেই তাকে কাজে নামতে হয়েছিল। সাগর আসলে টোকাই ছিল। বিভিন্ন পরিত্যক্ত জিনিস কুড়িয়ে বিক্রি করতো। সাগরের বাবা শিপন মিয়াও প্রসাধন সামগ্রী ফেরি করে বিক্রি করে। শিপন মিয়া জানিয়েছেন, সোমবার ভোর রাতে সাগর ভ্যান নিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়ে। তার কিছুক্ষণ পরই ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের পাশে ‘গাউছিয়া হ্যাচারি’র পানি তোলার পাম্প চুরির অভিযোগে তাকে আটক করা হয়। অভিযোগটা আসলে চুরিরও নয়। কারণ পাম্পটি চুরি হয়নি। সাগর নাকি সেটার যন্ত্রপাতি খোলার চেষ্টা করছিল। তারপর একটি ইলেকট্রিক পোলের সঙ্গে হাত পেছনের দিকে বেঁধে তাকে বেধড়ক পেটানো হয়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ইজিবাইকে করে হাসপাতালে নেওয়ার পথে সাগর মারা যায়। পরে ফিরিয়ে এনে তার মরদেহ একটি কাশবনে ফেলে রাখা হয়। পুলিশ ঘটনার ৩০ ঘণ্টা পর সেই কাশবন থেকে সাগরের লাশ উদ্ধার করে।

যদি এমন হতো, হঠাৎ রাগের মাথায় কারও বেমক্কা চরে মরে গেছে সাগর, তাহলেও না হয় মনকে বোঝাতে পারতাম। কিন্তু সাগরকে খুব ঠাণ্ডা মাথায় বেশ কয়েকজন মিলে পিটিয়েছে এবং সেটা প্রকাশ্যে। কেউ একজন সেই মারের দৃশ্য ভিডিও করেছে। ভিডিওতে দেখা যায়, আশপাশের অনেকেই গোল হয়ে দাঁড়িয়ে তাকে মারার দৃশ্য দেখছে। যেন সার্কাস হচ্ছে। মারের চোটে তার পরণের প্যান্ট খুলে গিয়েছিল। একজন প্যান্ট তুলে দিতে গেলে আরেকজন বাধা দিয়ে সাগরকে বলে, এই শুয়রের বাচ্চা প্যান্ট তোল। আরেকজনকে বলতে শোনা যায়, বুঝবা আজকে চুরির মজা। মারের চোটে অসহায় সাগর মাথা ফেলে দেয়। আরেকজন নির্দেশ দেয়, এই মাথা তোল। অনেক কষ্টে সাগর মাথা তোলে। এইখানে এসে আমার বিশ্ব আটকে যায়। মাথা তোলে সাগর নয়, যেন আমার ছেলে প্রসূন। আমার মাথা আউলা ঝাউলা হয়ে যায়। আমি একজন ছাপোষা সাংবাদিক। দেশের প্রচলিত সব আইন মেনে চলা মানুষ। কিন্তু মাথা তোলার পর সাগরের অসহায় চাহনি দেখে আমার সব ভালোত্বের আবরণ ভেঙে ফেলতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে ছুটে গিয়ে সাগরের খুনিদের খুন করে ফেলি। যারা পিটিয়েছে তাদের নয়, ইচ্ছা করে যারা গোল হয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল, তাদেরও একইভাবে পেটাই। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, দর্শক সারিতে বেশ কয়েকজন নারীকেও দেখা যায়। আমি জানি নারীরা যেমন কোমল, প্রয়োজনে তেমনি ভয়ঙ্কর। বিশেষ করে সন্তানকে বাঁচাতে একজন মা পারে না, এমন কোনও কাজ নেই। সেই দর্শক নারীরাও কারো না কারো মা, সাগরও কারো না কারো সন্তান। এই নারীদের সামনে কিভাবে সম্ভব হলো, আরেকজনের সন্তানকে এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা? সত্যি এই প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। আমরা কি সম্মিলিতভাবে অমানুষ হয়ে গেছি?

এটি কিন্তু এভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলার প্রথম ঘটনা নয়। বরং চোর ধরতে পারলে তাকে পিটিয়ে হাতের সুখ নেওয়ার একটা পুরনো অসুখ যেন মিশে আছে আমাদের রক্তে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মরে যায়। সবাই এটাকে স্বাভাবিকভাবেই নেয়। পুলিশও খুব ঝামেলা করে না। ‘গণপিটুনিতে নিহত’ বড় জোর পত্রিকার ভেতরের পাতার সিঙ্গেল কলাম আইটেম। কিন্তু ইদানিং মোবাইল ফোনে ভিডিও অপশন এসে আমাদের রক্তে মিশে যাওয়া সেই গোপন অসুখটি প্রকাশ করে দিয়েছে। ২০১৫ সালের ৮ জুলাই সিলেটে সাগরের মতই বেঁধে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল রাজনকে। সেই ঘটনারও ভিডিও ফাঁস হওয়াতেই তোলপাড়। ভিডিও প্রকাশ না হলে রাজন হত্যার ঘটনাও পত্রিকার ভেতরের পাতার সিঙ্গেল কলাম হয়ে হারিয়ে যেতো। কিন্তু সামাজিক মাধ্যম সিলেটের আঞ্চলিক ঘটনাকে জাতীয় ঘটনা বানিয়ে ফেলে। শুধু বাংলাদেশ ঘৃণার ঢেউ ছড়িয়ে পড়ে দেশের বাইরেও। রাজন হত্যার মূল আসামী কামরুল সৌদি আরব পালিয়েও পার পায়নি। সেখানকার প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাকে ধরে দেশে ফেরত পাঠায়। বিচারও হয়েছে দ্রুত। কামরুলসহ চারজনের মৃত্যুদণ্ড এবং ৭ জনের ৭ বছর করে কারাদণ্ড দেয়।

রাজনের ঘটনার সময় যেমন, সাগরের সময়ও অনেকে এই ধরনের নির্মমতার ভিডিও প্রচারের নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। আমি বুঝি আমার মতো দুর্বল হৃদয়ের অনেক মানুষ আছেন, যারা এই ভিডিও সহ্য করতে পারেন না। কিন্তু আবার এটাও বুঝি, ভিডিও না থাকলে এই ঘটনার সংবাদ মূল্য কমে যাবে হাজার গুণ। সারাদেশের মানুষের মধ্যে আলোড়ন তুলবে না এই ঘটনা। এমনকি ভিডিও না থাকলে এত দ্রুত রাজন হত্যার বিচার হতো না। এখন আমরা সাগর হত্যাকারীদেরও বিচার চাই। সাগরকে হত্যার জন্য যাদের নাম এসেছে, তারা হলো হ্যাচারির মালিক আক্কাস মিয়া, তার ভাই জুয়েল মিয়া, সহযোগী কাইয়ুম, নুরুজ্জামান, হাবিবুর রহমা্ন ও রিয়াজুল। এই লেখা পর্যন্ত রিয়াজুল ছাড়া আর কাউকে ধরতে পারোন পুলিশ। আমরা অবিলম্বে সকল আসামির গ্রেফতার এবং সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। তবে শুধু শাস্তি হলেই এ ধরনের ঘটনা বন্ধ হবে না। তাহলে রাজনের পর সাগরকেও একই পরিণতি বরণ করতে হতো না। সবাই মিলে ভাবতে হবে, স্বীকার করতে হবে আমাদের ভেতরের অসুখটার কথা। সুযোগ পেলেই আইন হাতে তুলে নেওয়ার, আইন ভাঙার, মানুষকে পেটানোর পৈশাচিক আানন্দ থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। নইলে মানবিক জাতি হিসেবে আমাদের যে আত্মপ্রসাদ তা ধুলায় মিশে যাবে।

টেকনাফ-কক্সবাজারে চলছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে গত এক মাসে সাড়ে ৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে চলে এসেছে। বাংলাদেশের মানুষ দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে মানবিকতার উজ্জ্বল উদাহরণ। কিন্তু একটা অসহায় রোহিঙ্গা শিশু আমাদের মন যতটা কাঁদায় অসহায় সাগরের আর্তি তেন কাঁদায় না কেন?

যারা ঠাণ্ডা মাথায় সাগরকে মেরেছে, যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন; তারা দেখতে মানুষের মতো বটে, কিন্তু কাউকেই আমার পুরো মানুষ মনে হয়নি। কোনও মানুষের পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়। পশুও অপ্রয়োজনে কেবল হাতের সুখ মেটানোর জন্য এতটা নিষ্ঠুর হতে পারে না। খালি দেখতে মানুষের মতো হলেই হবে না। আমাদের চাই মানবিকতার জাগরণ।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
[email protected]

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে 'দেরি করে আসায়' ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
কুষ্টিয়ায় ৩ হাজার গাছ কাটার সিদ্ধান্ত স্থগিত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
ট্রাকের চাপায় অটোরিকশার ২ যাত্রী নিহত
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
শেষ দিকে বৃথা গেলো চেষ্টা, ৪ রানে হেরেছে পাকিস্তান 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ