X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

‘পাগলের দুনিয়া’

আমীন আল রশীদ
২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:০৭আপডেট : ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭, ১৩:০৯

আমীন আল রশীদ দুনিয়াটা যে কানার হাটবাজার, ফকির লালন সাঁই তা টের পেয়েছিলেন দুই শতাব্দী আগেই। বলেছিলেন– ‘এক কানা কয় আরেক কানারে, চলো এবার ভবপারে, নিজে কানা পথ চেনে না, পরকে ডাকে বারংবার, এসব দেখি কানার হাটবাজার।’
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণের পর তাকে ‘উন্মাদ’ বলে আখ্যা দিয়েছেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন। বলেন, ‘এর জন্য ট্রাম্পকে চরম মূল্য দিতে হবে’। এরপরই টুইট করেন ট্রাম্প। যেখানে তিনিও কিমকে ‘পাগল’ বলে আখ্যা দেন এবং বলেন, ‘এমন পরীক্ষায় তাকে ফেলা হবে, যা কিম কখনও দেখেননি।’
বস্তুত এ দুই ‘পাগলের’ কারণে পুরো বিশ্বই এখন অস্থির এবং আবারও একটি বড় ধরনের যুদ্ধের ঘনঘটা। সম্প্রতি উত্তর কোরিয়ার পূর্ব উপকূলের সবচেয়ে কাছ দিয়ে উড়ে গেছে‍ মার্কিন বোমারু বিমান। মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনের দাবি, উত্তর কোরিয়ার পরমাণু কর্মসূচির কারণে সৃষ্ট গুরুতর হুমকি মোকাবিলায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হাতে যে অনেক সামরিক পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে, তা দেখানোর জন্যই এই অভিযান।

এর আগে গত ৩ সেপ্টেম্বর নিজেদের ষষ্ঠ ও সবচেয়ে শক্তিশালী পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া।  এ বছর কয়েক ডজন ক্ষেপণাস্ত্রও উৎক্ষেপণ করে দেশটি। যুক্তরাষ্ট্রে পরমাণু হামলা চালানোর সক্ষমতা অর্জনে কাজ চালিয়ে যাওয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরে শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমার পরীক্ষা চালানোরও হুমকি দিয়েছে তারা। কিম ও ট্রাম্পের এই বাগযুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় দুই দেশকেই সতর্ক করে চীন বলেছে,পরিস্থিতিটা এখন যথেষ্ট ‘জটিল ও নাজুক’।
যদিও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র কখনোই উত্তর কোরিয়ায় হামলা চালাবে না।  তিনি বলেন, ‘উত্তর কোরিয়ায় মার্কিন হামলার আশঙ্কা নেই। এর কারণ হলো, আগে সন্দেহ করা হলেও এখন সারা বিশ্ব নিশ্চিতভাবে জানে যে, উত্তর কোরিয়ার কাছে পরমাণু বোমা রয়েছে।’ এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পৃথিবীর কোনও শক্তিধর রাষ্ট্রই এখন আর বড় ধরনের যুদ্ধে জড়ানোর ঝুঁকি নেবে না। কারণ তাতে একদিকে যেমন দু’পক্ষেরই জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হবে, তেমনি পরমাণু বা হাইড্রোজেন বোমার বিভীষিকা দেখতে চায় না কেউই। সুতরাং ‘জাতে মাতালরা’ তালে ঠিক থাকলেই বিশ্ববাসীর জন্য মঙ্গল।

তবে এই দু’জনের বাইরে আরও অনেক উন্মাদ ও উগ্রবাদী––যারা বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি, এই পৃথিবীর বুকে বীরদর্পে হেঁটে বেড়াচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে যে রোহিঙ্গা সংকটের ঘানি টানছে বাংলাদেশ, তার পেছনেও রয়েছে মিয়ানমারের উগ্র জাতীয়তাবাদ। সংখ্যাগুরু বৌদ্ধ ছাড়া অন্য কোনও সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী––তা সেটি মুসিলম, হিন্দু, খ্রিস্টান যাই হোক––তারা যে মিয়ানমারে নিরাপদ নয় তা এরইমধ্যে স্পষ্ট। আর এই জাতিগত নিধনে মূল ভূমিকা রাখে যে সেনাবাহিনী, ২০২০ সালের নির্বাচনে তারাই আবার আগের মতো ক্ষমতায় আসছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্ধ শতাব্দীর সামরিক শাসনের পরে ২০১৫ সালে মিয়ানমারে কথিত গণতন্ত্রের নেত্রী অং সান সু চি’র দল এনএলডি সরকার গঠন করলেও বস্তুত ক্ষমতার প্রাণভোমরা এখনও সেনাবাহিনীর হাতেই। আর সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা সংকটের পেছনে প্রধানত দায়ী যে বর্তমান সেনাপ্রধান, সেই মিন অং যে ২০২০ সালের জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের সমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্ট হতে চান, তা এরইমধ্যে স্পষ্ট। আর যদি সত্যিই এটি ঘটে, তাহলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আবার নতুন করে কী ভয়াবহ সংকট তৈরি হবে এবং এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য মিন অংয়ের সরকার কতটা ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে, তা কিছুটা হলেও আন্দাজ করা যায়।

জার্মানির সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থবার চ্যান্সেলর পদে অ্যাঙ্গেলা মেরকেল টিকে গেলেও এবার সেখানে চরম ডানপন্থীদের উত্থানও হয়েছে। তৃতীয় ‍বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে অলটারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি);  যারা মুসলিম ও শরণার্থীদের চরম বিরোধী। এএফডি মনে করে, মুসলিমরা জার্মান সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম নয়। ফলে বিশাল শরণার্থীর ভার নেওয়া এবং সহনশীল দেশ বলে পরিচিত জার্মানির ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপ্রকৃতি হয়তো বদলে যাবে। এর আগে  ২০১৫ ডেনমার্কে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের ক্ষমতা থেকে হটিয়ে দেয় মধ্য-ডানপন্থী জোট। যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সেও ডান বা কট্টরপন্থিদের উত্থান বিশ্বকে নাড়া দেয়। তাছাড়া সম্প্রতি লাতিন আমেরিকারদেশগুলোতে বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, যাতে অনেকে মনে করছেন যে, ওই অঞ্চলে বামপন্থীদের দিন বোধ হয় শেষ হতে যাচ্ছে।
তবে উগ্র ও চরমপন্থী দেখতে ইউরোপ বা লাতিন আমেরিকায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। বরং প্রতিবেশী ভারতেই গরু রক্ষার নামে যে উগ্রতা ও সহিংসতা হয়েছে, তা নজিরবিহীন; এমনকি গোরক্ষার নামে বাড়াবাড়ি বন্ধ করতে খোদ সুপ্রিম কোর্টকে নির্দেশ দিতে হয়েছে। শুধু নির্দেশই নয়, সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, প্রতিটি রাজ্যের প্রত্যেক জেলায় ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট পদমর্যাদার এক পুলিশ কর্মকর্তাকে এ দায়িত্বে নিযুক্ত করতে হবে। তার কাজই হবে গোরক্ষার নামে সব ধরনের বাড়াবাড়ি বন্ধ করা। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, উগ্রপন্থা কী ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশ বলে পরিচিত অহিংস নেতা মহাত্মা গান্ধীর জন্মভূমিতে। যদিও এটা ঠিক যে, মিয়ানমারও তাদের পূর্বপুরুষ গৌতম বুদ্ধের অহিংসা আর শান্তির বাণীর ধারেকাছেও এখন আর নেই। বরং এই সময়ের সবচেয়ে রেসিস্ট জাতিতে পরিণত হয়েছে।

এসব উগ্র জাতীয়তাবাদের ভিড়ে কথিত খেলাফত প্রতিষ্ঠার নামে আইএস-এর তাণ্ডব এবং দেশে দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের বিস্তারও বিশ্বশান্তির জন্য বড় হুমকি তৈরি করেছে। যদিও বলা হয় যে, বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের প্রান্তিকীকরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই এসব কট্টরপন্থি সংগঠনের জন্ম; কিন্তু এসব যুক্তিতে তাদের হত্যাকে বৈধতা দেওয়া বা তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশের সুযোগ নেই।
ফলে আগামীর পৃথিবী এই উন্মাদ, পাগল ও উগ্রপন্থীরা শাসন করবে নাকি শান্তি, সৌহার্দ্য আর সহনশীলতার জয় হবে—তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।

লেখক: সাংবাদিক

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
ওজন কমিয়ে সাকিব পুরো ফিট, সন্তুষ্ট সহকারী কোচ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ