X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১

মাকিদ হায়দারের ৭০তম জন্মদিন

দাউদ হায়দার
০১ অক্টোবর ২০১৭, ১৩:০১আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০১৭, ১৩:০৫

দাউদ হায়দার নিতান্তই কচি খুকি, হাত-পা নেড়ে, আধো-বুলিতে রবীন্দ্রনাথকে কী বলেছিল, বলতে চেয়েছিল, বোঝেননি। লেখে, ‘তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি’।
চন্ডীদাসের ‘খুড়োর যখন অল্প বয়স- বছর খানেক হবে/ উঠলো কেঁদে ‘গুংগা’ বলে ভীষণ অট্টরবে।/ আর তো সবাই ‘মামা’ ‘গাগা’ আবোল তাবোল বকে।/ খুড়োর মুখে ‘গুংগা’ শুনে চমকে গেলো লোকে’। (সুকুমার রায়)
একজনকে জানি, বয়স ৪০ পেরিয়েছে, দুই কন্যার জননী। তার ছোট কন্যা বড়োকে ‘আপা’ নয়, ‘পা’ সম্বোধন করেন। শিশু, আধো-বুলির বয়সে হয়তো ‘আ’ উচ্চারণে জড়তা ছিল, জড়তা কাটিয়ে, বড়ো হয়েও ছোটবেলার ভালোবাসার, আদুরে ডাকই প্রিয়।

রশীদ হায়দারের প্রথম কন্যা হেমা, হায়দার বংশে পয়লা, তাঁর সেজ চাচাকে ‘খোকনছেলে’ বলে ডাকেন। হেমা যখন আধো বুলির ওরই মামা, একমাত্র মামা, বলেছিলেন ওকে, ‘এই খোকন কী তোমার ছেলে? তোমার খোকনছেলের কাঁধেপিঠে-চড়ে সারাক্ষণ ঘুরে বেড়াও’? হেমার কানে ‘খোকনছেলে’ সেঁধে যায়। ওই যে সাঁধলো, ৬৭ বছরের বুড়োকে ‘খোকনছেলে’ বলেন। হেমার জ্ঞাতিগুষ্টির সম্বোধন ‘খোকনছেলে’। হোক তা চাচাতো, ফুফাতো ভাইবোন।

বাংলার পারিবারিক নাম ও সম্বোধন, আদর, ভালোবাসা, প্রিয়তায় যে-সাংস্কৃতিক ঘরানা, মূলে সামাজিকতাও। এই সমাজের আদল ঘরোয়া, পারস্পরিক স্নেহবন্ধনে আপন। এখানে হিন্দু মুসলিম প্রশ্ন নেই। বঙ্কিম হয়ে যায় ‘বঙ্কু’। নজরুল ‘নজ্যে’।

রহিমা খাতুন- মোহাম্মদ হাকিমউদ্দীন শেখের প্রথম ছেলে জিয়া হায়দায়, ডাকনাম রোউফ। দ্বিতীয় ছেলে রশীদ হায়দার, ডাকনাম দুলাল। তৃ্তীয় ছেলে মাকিদ হায়দায় ডাকনাম রোকন।

‘বড়োভাই’, ‘রোউফভাই’, ‘মেজভাই’, ‘দুলালভাই’, ‘সেজভাই’, ‘রোকনভাই’ না বলে কেন ‘সোনাভাই’ (জিয়া হায়দার), ‘দাদুভাই’ (রশীদ হায়দার), ‘লোয়াভাই’ (মাকিদ হায়দার) বলি ছোটরা কেন? ব্যাখ্যা আছে।

কথিত, বালক বেলায় জমিদারপুত্র রোউফের (জিয়া হায়দার) গলায় সোনার মালা (চেইন) থাকতো। সোনার মালা দেখে রোউফের অনুজা ঝরনা নাকি ‘সোনাভাই’ বলতেন। সেই থেকে অনুজঅনুজার সম্বোধন সোনাভাই। দুলাল (রশীদ হায়দার) কেন ‘দাদুভাই’? ঝরনা আপার কথা– ‘দুলালের স্বভাব গাম্ভীর্যে ‘দাদু-দাদু’ ভাবছিল’। হয়ে গেলেন ‘দাদুভাই’। রোকনের(মাকিদ হায়দার)বেলায় কী?– আবার ঝরনা আমার কথা, ‘দাঁত গজানোর পরেই, লোহা পেলে, তা পেরেক হোক, চাকু হোক, হাতুড়ি হোক, কামড়াতো’।

লোহার কেচ্ছা থেকে ‘লোয়াভাই’, ছোটদের কাছে।

মাকিদ ওরফে রোকন তথা লোয়া ভাইয়ের ৭০ তম জন্মদিন হয়ে গেলো, ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ সালে ভূমিষ্ঠ, পাবনার দোহারপাড়া, রহিমা খাতুন- মোহাম্মদ হাকিমউদ্দীন শেখের ৬(ছয়)নম্বর সন্তান।

চেহারাসুরতে মন্দ নন মাকিদ, বাংলাদেশের সিনেমায় নাচনকুঁদন করতে পারতেন, একজন পরিচালক অফারও করেছিলেন, ‘ঢালিউডে’র চৌহদ্দিতে যাননি। ইচ্ছে ছিল পেলে বা মারাদোনা হওয়ার, বরাতে জোর ছিল না ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনা শহরে রেশনের দোকান দিয়েছিলেন, রেশনের চাল-চিনি-তেল মুক্তিযোদ্ধাদের সাপ্লাই দিতেন গোপনে, যুদ্ধশেষে, স্বাধীনতার পরে ব্যবসায়ী হতে পারতেন, সব ছেড়েছুড়ে কবিতাই আরাধ্য। গল্পও লিখেছেন, বইও আছে, পাঠকপ্রিয়, কিন্তু ‘কবি’ উপাধিই পছন্দ।

মাকিদ হায়দার কেন নিজের কিসসা তথা আত্মজীবনী লেখেন না, অজানা। অসাধারণ তাঁর অতীতকথা। কৈশরে, গোঁফ গজানোর আগে, যৌবনের খামচানির শুরুর আগে ভয়ানক একরোখা, দুষ্টকুলের শিরোমনি, মারপিটে মস্তান, রাতবিরেতে পাড়া-টে টে, ৪০ হাত সুপুরি গাছ থেকে পড়ে হাড্ডিগুড্ডি ভাঙে না, অজ্ঞানও নয়, দিব্যি সুস্থ, খোকনকে এক থাপ্পর মেরে বললেন, ‘গা একটু ব্যথা করতেছে, যা ডাব পাড়ে (পেড়ে) লিয়ে আয়’।

বাপ তাঁকে ত্যজপুত্র করার হুমকি দেন, আদালতেও যান, বাপকে বলেন, ‘করে দেখুক, ঠ্যালা বুঝবিনি। বাড়ি পোড়ায়ে দেবো’। বাপের বোধহয় ত্যজপুত্র করার শখ মিটে যায়।

মাকিদ তার আত্মজীবনী লিখবে। অনুজ লিখতে পারে না। মাকিদ বড়ো চাকরি করেছেন, আম্লা-টামলা গোছের কাছে, সরকারি চাকরি, অথচ মেজাজ কবির। ‘কাব্যমন’ই তার জীবনচরিত।

মাকিদের কবিতা নিয়ে সমালোচকদল বেশি কথা কন না। মাকিদ অবশ্য ধারও ধারেন না। লেখেন ফ্রি ভার্স। ফ্রি ভার্স বলতে সঠিক যা বোঝায়, তাও নয়। বিদেশি ফ্রি ভার্স লেখক, বাংলার সমর সেন বা অরুন মিত্রের অনুসারী নন, একেবারেই নিজস্বতা, শব্দ-ছন্দের কারিকুরি, মারপ্যাঁচ নিয়েও মাথা খামচান না, ওর লেখা স্বতঃস্ফূর্ত, বিপত্তি অনেকের। কিন্তু মানতেই হবে, আর পাঁচজন ভিন্ন, আলাদা। এখানেই তিনি একক।

দেশসমাজ-পারিপার্শ্বিক মাকিদের কবিতায়, গদ্যের আদলে, গল্পের কথকতায় যে বয়ান, সঘন রাজনীতিমাখা। নিজের ডাকনাম রোকনকে ‘রোকনালি’ চিহ্নিত করে কখনও ব্যঙ্গ কখনও তীব্র শ্লেষে দেশের চলমান পরিস্থিতি, মলিনতার চিত্র আঁকেন, সময়কালকে প্রকাশ, বিস্তার করেন। এই প্রকাশ, বিস্তারে দেশমাটির জলহাওয়া সংলগ্ন। ভয়ঙ্কর উত্তেজনা নেই কবিতায়, অথচ বোধের গভীর, বলা ভালো, চিত্তবিক্ষোভের উৎক্ষেপণ। কিছু কবিতায় অভিজ্ঞতার টানাপোড়েনের রোমাঞ্চর লক্ষনও নানাবিন্যাসে রেখাঙ্কিত। চিত্র-রেখা, বিচিত্রতর বৃত্তান্তের সম্মিলনই তার কবিতা।

কবিকে ৭০ জন্মদিনে শুভেচ্ছা।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আগামী সপ্তাহে থাইল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী
আগামী সপ্তাহে থাইল্যান্ড যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণ: ২ আসামির স্বীকারোক্তি
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণ: ২ আসামির স্বীকারোক্তি
‘সাংগ্রাই জলোৎসব’ যেন পাহাড়ে এক মিলন মেলা
‘সাংগ্রাই জলোৎসব’ যেন পাহাড়ে এক মিলন মেলা
পাঁচ উপায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
বাজেট ২০২৪-২৫পাঁচ উপায়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ