X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১

এভ্রিলের জয়-পরাজয়

লীনা পারভীন
০৫ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:৪৪আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:৪৯

লীনা পারভীন জান্নাতুল নাঈম এভ্রিল। এই নামটি এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সহ নানা মিডিয়ায় সবচেয়ে আলোচিত। ইতিমধ্যেই আমরা জেনে গেছি তার এই জনপ্রিয়তার কারণ। যদিও মেয়েটি এর আগেও ‘জনপ্রিয়’ ছিল তবে সেটা ছিল অন্য এক পরিচয়ে। বাংলাদেশের প্রথম দ্রুতগতির নারী বাইকার। সেই ভিডিওটির মাধ্যমেই প্রথম আলোচনায় আসে মেয়েটি। অবশ্য  আলোচনার মতই বিষয় ছিল। বাংলাদেশের মতো একটি পশ্চাৎপদ সামাজিক বাস্তবতায় যেখানে এখনও নারীকে প্যান্ট শার্ট পড়া অবস্থায় দেখলেই লোকে কটু কথা বলে সেখানে চট্টগ্রামের একটি গ্রাম থেকে ওঠে আসা সাধারণ মেয়ে কেমন করে রাস্তাকে জয় করে নিলো সেটা অবশ্যই একটি আলোচ্য বিষয় বা অনুকরণীয়ও বটে।
সেই একই মেয়ে আবারও আলোচনায়, তবে এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে। প্রথমবারের মতো আয়োজিত হওয়া মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতার বাংলাদেশ পর্বে ২৫ হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে এই এভ্রিল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে যে আর কিছুদিন পরেই চীনে অনুষ্ঠিতব্য মিস ওয়ার্ল্ড প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে বাংলাদেশের হয়ে। সবই ঠিক ছিল কিন্তু ফলাফল ঘোষণার পর থেকেই চলছে নানা বিতর্ক। অভিযোগ উঠলো ফলাফলে বিচারকদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়নি। আয়োজকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এভ্রিলকে জয়ী করা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে একজন বিচারক গণমাধ্যমে দাবি করেন, প্রথম তিনজনের তালিকায় ছিল না এভ্রিলের নাম। শুরু হলো পক্ষ-বিপক্ষ, আলোচনা-সমালোচনা। পরে আবার জানা গেলো এভ্রিল বিবাহিত ছিলেন। দুই মাস সংসার করে বাবার বাড়িতে এসে সে পালিয়ে ঢাকায় চলে আসে নিজেকে প্রতিষ্ঠার জন্য। তবে গুরুতর অভিযোগ হচ্ছে– এভ্রিলে তার বিয়ে এবং ডিভোর্সের বিষয়টি গোপন করে প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।  

শুরু হলো আরেক নতুন অধ্যায়ের আলোচনা। একটি পক্ষ বলতে শুরু করলো মেয়েটি সংগ্রাম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে বলেই বিয়ের বিষয়টি লুকিয়েছে। তাছাড়া এভ্রিলের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী যেহেতু ১৬ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিলো– তারমানে সেটা বাল্যবিবাহের মধ্যে পড়ে এবং বাল্যবিবাহ বাংলাদেশে আইনসিদ্ধ নয়। কথায় অবশ্যই যুক্তি আছে। বাল্যবিবাহ যদি হয়েই থাকে তাহলে সেটি তার পিতামাতার অন্যায় কাজ বলেই মানতে হবে। যিনি বিয়ে করেছেন তিনিও একই অপরাধে অপরাধী। বাল্যবিবাহের শিকার হওয়া একটি মেয়ে নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চেয়েছে এতে অন্যায়ের কিছু নাই। বরং তার সংগ্রামকে সমর্থন জানানোটাই সবার দায়িত্ব।

কিন্তু বিষয়টা কি আর তেমন আছে? এভ্রিলে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার জন্য যে পথকে বেছে নিয়েছে সেটি ছিল ভুল পথ, তথ্য গোপন করা মানে সে অসততার আশ্রয় নিয়েছে।  আমরা যারা আজকে এভ্রিলের কাহিনিকে একজন সংগ্রামী ও অবহেলিত নারীর সফল হওয়ার লড়াইয়ের গল্প বলে বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছি তাদের কেউ কি একবারের জন্যও ভেবে দেখেছি– যে পথে এভ্রিল নিজেকে সফল করতে চেয়েছে সে পথটিই কি একজন নারীর জন্য সম্মানের একমাত্র পথ?

আমরা কে না জানি যে সুন্দরী প্রতিযোগিতা মানেই সেখানে যোগ্যতার মাপকাঠি কী কী? অংশগ্রহণের নিয়মগুলো সবই আদিম ও বর্বর ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। কেবলমাত্র বাহ্যিক শারীরিক সৌন্দর্যকে কেন্দ্র করে যেখানে নারীকে যোগ্য বা অযোগ্য হিসাবে বিচার করা হয় সেটি কি কখনও সম্মানের পথ হতে পারে?

একদিকে আমরা নারীর সমান অধিকারের কথা বলছি, নারীর প্রতি ভোগ বিলাসের দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টানোর লড়াইয়ে নারীদেরকে শামিলের আহবান জানাচ্ছি। নারীকে পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য শক্তি অর্জনের পথ দেখাতে চাইছি আবার অন্যদিকে পুরুষতান্ত্রিকতার চরম প্রকাশ যেখানে ঘটে, যেখানে একজন নারীকে কেবল দেখা হয় একটি পণ্য হিসাবে, হাটের পশুর মতো যেখানে মাপা হয় তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের সাইজ– সেই সুন্দরী প্রতিযোগীতায় বিজয়ী হওয়ার জন্য যখন কেউ মিথ্যার আশ্রয় নেয় আমরা সেই মিথ্যাকে মিথ্যা না বলে তার লড়াইয়ের নাম দিয়ে কেন তাকে ‘সুন্দরী’ করা হবে না সেটা নিয়ে তর্ক করি। বুঝতে চাই না এখানে এভ্রিল কোনও বিষয় না। বিষয় হচ্ছে যে পথে সে সফল হতে চেয়েছে সেই পথটি কি সঠিক?

এভ্রিল বলেছে সে নিজে যেহেতু বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে তাই সে চায় না আর কোনও নারীর ভাগ্য যেন এমন না হতে পারে। আমি তার এই বাসনাকে অবশ্যই সম্মান করি। তবে তার বেছে নেওয়া পথকে নয়। বাল্যবিবাহ কেন, কোনও প্রকার নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে হবে কিন্তু সুন্দরী প্রতিযোগিতার মতো একটি ‘জঘন্য পুরুষতান্ত্রিক’ ব্যবস্থার তৈরি করা পথে নয়। আমি যদি একজন সত্যিকারের নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সৈনিক হয়ে থাকি তাহলে আমাদের উচিত হবে আর কোনও মেয়ে যেন নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার এই ভুল পথকে একমাত্র উপায় বলে বেছে না নেয়। বরং উৎসাহিত করবো এ ধরনের ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই করে অন্যদেরকে সচেতন করার কাজে।

এভ্রিল আমাদের প্রচলিত সমাজের একটি উদাহরণ। এমন হাজারো লক্ষ এভ্রিল রয়েছে সমাজে যারা প্রতিনিয়ত নানাভাবে নিগ্রহের শিকার হচ্ছে। কয়জনের খবর রাখি আমরা? কেউ কেউ বলছেন এখানে নারীবাদের কিছু নেই। প্রশ্ন হচ্ছে কেন নাই? এভ্রিল নারী না হলে কি সে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারতো? এখানে সবার সহানুভূতির কারণ সে একজন নারী এবং যে সমাজের প্রচলিত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার শিকার হয়ে আজকে চোখের পানি ফেলছে।

এভ্রিলের মতো আরও অনেক নারী আছে যারা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার স্বপ্ন দেখে যাচ্ছে। এভ্রিল পেরেছে অন্য অনেকেই পারে না। আমাদেরকে কথা বলতে হবে এমন একটি ব্যবস্থার জন্য যেখানে আর কোনও এভ্রিলের স্বপ্ন এমন করে কান্নায় রূপ না নেয়। নিজের শরীরের সৌন্দর্যকে আশ্রয় করে নয়, কর্ম ও বুদ্ধির গুণে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাবে নারী তেমন প্রতিযোগিতার কথা বলতে হবে। এভ্রিলের ভেতর স্বপ্ন এমনি এমনি তৈরি হয়নি। এটা তৈরি করেছে আমাদের সমাজ, এই পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় যা কিছুর বিনিময়ে মুনাফা অর্জন করা যায় তার সবকিছুই পণ্য বলে বিবেচিত। সেখানে একজন নারীও সমাজের চোখে পণ্যের বাইরে কিছু নয়। তেমনি ইদানিং পণ্যের তালিকার যুক্ত হয়েছে পুরুষেরাও। এই যে মডেলিং, সিনেমা, নাটক, সুন্দর/সুন্দরী প্রতিযোগিতা সবকিছুই সেই পণ্য মানসিকতার অংশ।

এখন প্রশ্ন করতে পারেন, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থাতো এখনই পাল্টে যাচ্ছে না তাহলে কি যারা এইসব প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে চায় তারা নেবে না? উত্তর হচ্ছে- সেটা ব্যক্তির পছন্দের বিষয়। একজন ব্যক্তি নিজে যদি মনে করে সে নিজে পণ্য হয়েই প্রতিষ্ঠা চায়, খ্যাতি, নাম-যশ চায় তাহলে তাকে সেই পথের নিয়ম-কানুন মেনেই চলতে হয়। সেখানেও যাবেন আবার সেখানকার নিয়মকে তোয়াক্কা না করে, অন্যের ভাগ্যকে ঠকিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যায়ের আশ্রয় নেবেন তা কেমন করে হয়? কারণ একজন প্রতিযোগী সব নিয়ম-কানুন জেনেবুঝেই সেই দুনিয়ায় নাম লেখায়। তবে আমরা যারা সমাজ সচেতন মানুষ। যারা চাই নারীকে ভোগ্য পণ্য হিসাবে নয় তাকে একজন স্বতন্ত্র মানুষ হিসাবে দেখা হবে যেখানে কর্ম দক্ষতা, মেধা ও প্রজ্ঞাই হবে মাপকাঠি তাদেরকে অবশ্যই কথা বলতে হবে এইসব সুন্দরী প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে। কথা বলতে হবে যারা এভ্রিলদের মধ্যে এইসব শর্টকাট উপায়ে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা জাগায়। কথা বলতে হবে যে ব্যবস্থা এভ্রিলদেরকে মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করতে শিখায় তার বিরুদ্ধে।

সমাজের অন্যান্য এভ্রিলদেরকে শেখাতে হবে, জীবনে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে আগে নিজের যোগ্যতাকে দাঁড় করাতে হবে। গায়ের রঙ, বুকের উচ্চতা, হিপের সাইজ ইত্যাদি কখনোই তার যোগ্যতার পরিমাপক হতে পারে না। সৌন্দর্য পাল্টে নয় বরং জন্মগত কাঠামোকে রেখেই প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করার মানসিকতা রাখতে হবে। বাল্যবিবাহকে অস্বীকার করা তার অপরাধ নয় কিন্তু সেটাকে লুকিয়ে রাখাটা অসততার পরিচয়। সে নিজে বাল্যবিয়ে করেনি তাহলে সেটা প্রকাশে তার লজ্জা কোথায়?

এভ্রিল উদাহরণ হতে পারতো লক্ষ এভ্রিলের জন্য– যদি সে বিয়ের কথা লুকিয়ে প্রতিষ্ঠা নয় বরং সেটাকে একটা অন্যায় হিসাবে ধরে নিয়ে বাল্যবিবাহ কেন এবং কেমন করে নারীর জন্য অবমাননাকর ও কেন সেটাকে বন্ধ করা উচিত সে বিষয়ে কথা বলতো। এমন উদাহরণ কি নেই? এইতো গত এপ্রিলের ঘটনা– যেখানে ঝিনাইদহের রত্না খাতুন নামের একজন কিশোরী পড়াশুনা করতে চায় বলে ইউএনও’র কাছে গিয়ে তাকে বাল্যবিবাহ থেকে উদ্ধারের জন্য সাহায্য চেয়েছে এবং বাবা-মা জোর করে বিয়ে দিতে চাইলেও মেয়েটির সাহসীকতায় সে বিয়েটি আটকেও যায় প্রশাসনের সহায়তায়।

এভ্রিল ও রত্নার মধ্যে আমার কাছে আদর্শ রত্না কিন্তু আমরা তাদের জন্য লড়ি না। তাকে আইডল মানতে চাই না বা বানাতে চাই না। প্রশ্ন থেকে যায় কেন? আমরা যতদিন রত্না ও এভ্রিলের মধ্যে পার্থক্য করতে না শিখবো ততদিন আরও অনেক এভ্রিল বিভ্রান্তির পথে পা বাড়াবে আর সমাজের পঙ্কিল রাস্তায় আটকে গিয়ে এভাবেই স্বপ্নের কবর খুড়ে কেঁদে যাবে। লাভের খাতায় জমা হবে জিরো।

আবেগের চেয়ে যুক্তিকে কখনও কখনও সামনে আনতে হয়। নারীর মুক্তি ইস্যুতে আবেগের স্থান দেওয়ার আগেই যুক্তিকে বুঝতে হবে। এভ্রিল নিজে তৈরি হয়নি। তাকে তৈরি করেছে আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। এখানে কোনও মায়ার খেলা নাই। এভ্রিল কেন জয়ী হলো না সেটা নিয়ে তর্ক নয় বরং এভ্রিলদেরকে এমন স্বপ্ন দেখা থেকে বিরত রাখাটাই সামাজিক দায়িত্ব বলে আমার মনে হয়।

আমরা চাই এভ্রিল নিজেই যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারুক তার কোথায় ভুল ছিল? কেন সে তার স্বপ্নের পথে বাধা পেলো? সুন্দরী হওয়া ছাড়াও সে জয়ী হতে পারে সেটাই প্রমাণ করার জন্য আরও প্রত্যয় নিয়ে এগুবে।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৪০ শতাংশে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে’
‘নবায়নযোগ্য জ্বালানি ৪০ শতাংশে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে’
পুরনো লাইনআপে ফিরছে ‘ব্ল্যাক’!
পুরনো লাইনআপে ফিরছে ‘ব্ল্যাক’!
মধুমতি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তাসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দুদকের
মধুমতি ব্যাংকের সাবেক কর্মকর্তাসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দুদকের
আইসিটি খাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
আইসিটি খাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ