X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

‘সুন্দরী-ব্যবসা’ ও একজন নয়া ‘অবতার’

চিররঞ্জন সরকার
০৬ অক্টোবর ২০১৭, ২১:৫৭আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০১৭, ১২:৩৪

চিররঞ্জন সরকার অবতার ঠিক ঈশ্বর নন, ঈশ্বরের প্রতিনিধি! সমাজে অধর্ম, অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন বেড়ে গেলে অবতারের আবির্ভাব ঘটে। এই অবতাররা সমাজে শান্তি-স্থিতি-শৃঙ্খলা ও ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যান। এ পৃথিবীতে যুগে যুগে হাতেগোনা মাত্র কয়েকজন অবতারের আবির্ভাব ঘটেছে। কোনও অবতারের সাক্ষাৎ পাওয়া যে কোনও মানুষের পরম সৌভাগ্যের ব্যাপার। একজন অবতারের জন্য মানুষকে বহু যুগ বা শতাব্দী পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

এখন অবশ্য যুগ পাল্টেছে! পুরনো কায়দার পুরনো বৈশিষ্ট্যের অবতার এখন আর দেখা যায় না। তবে নতুন রূপের নতুন চরিত্রের অবতার অবশ্য এই ঘোর কলিকালেও বিরল নয়! একালে সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ, দখলদার, ভুঁইফোড় নেতা, কালো টাকার মালিক, নানা ফিকিরে হঠাৎ বড়লোক হয়ে ওঠা কিছু ফাটকাবাজ, ক্ষমতাসীন মহলের আশীর্বাদপুষ্ট ধান্দাবাজরাই অবতারের ভূমিকায়। একালের অবতাররা যেমন আকস্মিকভাবেই আবির্ভূত হন, তেমনি আকস্মিকভাবেই হারিয়ে যান। কখন যে কে অবতার হিসেবে আবির্ভূত হবেন তা আগে ভাগেই বলা যায় না। অনেকেই আছেন, যারা রাতারাতি অবতার বনে যান। টোকাই থেকে বিরাট ক্ষমতাবান, জননন্দিত মহানায়ক। জিরো থেকে হিরো। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে এ যুগের অবতারদের আবির্ভাব ও প্রতিষ্ঠা বেশি। তবে এর বাইরেও কিছু ‘বিস্ময়কর অবতার’ আছেন। তাদের অর্থবিত্ত, প্রভাব, ক্ষমতা, দাপট সনাতন অবতারদের চেয়েও অনেক বেশি। এসব অবতারের শক্তিতে বলীয়ান হয়েই একালে রাজনৈতিক দলগুলো টিকে থাকে।

এর আগে আমরা ‘জাতীয়তাবাদী’ জমানায় অবতার হিসেবে দেখেছিলাম লুৎফুজ্জামান বাবর, গিয়াসউদ্দিন আল মামুন প্রমুখকে। বর্তমানে জাতীয় পর্যায়ে তো বটেই আঞ্চলিক পর্যায়েও বহু অবতারের সাক্ষাৎ মিলছে। আমরা দেখেছি নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামি নূর হোসেনকে। দেখেছি বগুড়ার তুফান সরকারকে। জিরো থেকে সুপার হিরো হওয়ার দৃষ্টান্ত হচ্ছেন এসব অবতার। সম্প্রতি এক নয়া অবতারের সাক্ষাৎ পাওয়া গেছে। তিনি আবার অন্য জগতের অবতার। তিনি সিনেমা-সঙ্গীত-সুন্দরীদের নিয়ে কায়কার করেন। শো-বিজ জগতের যাবতীয় হার্টথ্রব-সুপারস্টাররা তার ইশারায় বাংলাদেশে চলে আসেন। নাচেন। গান। তিনি সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য না হয়েও অনেক পাওয়ারফুল। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি তার পকেটে। তিনি তলে বিকশিত হচ্ছিলেন অনেকদিন ধরেই। এবার তিনি প্রকাশিত হলেন ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতা’ নামক এক ‘মহা-তামাশা’র আয়োজন করে। এই মহামান্য অবতার বাহাদুরের নাম স্বপন চৌধুরী। প্রখ্যাত এই ব্যক্তি এখন সুবিখ্যাত একজন ‘সাংস্কৃতিক সংগঠক’ হিসেবে অনেকের কাছেই পরিচিতি পেয়েছেন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-৫ আসন থেকে অংশ গ্রহণ করবেন বলেও গুজব আছে!

ড্রিমল্যান্ড নামে একটি ব্যান্ড দলের ভোকাল হিসেবে এই অবতার মহামহিমের যাত্রা শুরু। তিনি তৎকালীন বিটিভির ব্যান্ড শোগুলোতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। এই সূত্র ধরেই নানা জনের সঙ্গে সাক্ষাৎ, পরিচয়। আর এই পরিচয়-সাক্ষাৎ পুঁজি করেই এগিয়ে যাওয়া এগিয়ে চলা। ১৯৯২ সালে তিনি ‘অন্তর শোবিজ’ নামক ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। সংস্থাটির তিনি চেয়ারম্যান। অনেক হোমরা-চোমরা ব্যক্তিও নাকি তার সঙ্গে রয়েছেন। এই ক্ষমতাবানদের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় তিনি শুরু করেন ‘সংস্কৃতি-ব্যবসা’। ‘সংস্কৃতি-ব্যবসা’র অংশ হিসেবে ভারতীয় বিভিন্ন শিল্পী ও অভিনেতাকে বাংলাদেশে এনে শো করে টাকা বানানোর লাইন বেছে নেন। এ কাজে তিনি সফলও হন। বলিউড বাদশা শাহরুখ খান লাইভ ইন ঢাকা, আদনান সামি, বোম্বে ভাইকিংস, নচিকেতা লাইভ ইন ঢাকা, মোহিত চোহান, অ্যাম্প পেস্ট, শ্রেয়া ঘোষাল, শান লাইভ ছাড়াও নয় অবতার স্বপন চৌধুরী প্রায় ২০০ সঙ্গীত তারকার সমন্বয়ে ‘বাংলায় গাইবে বিশ্ব’ আয়োজন করে চমক সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন।

‘সংস্কৃতি-ব্যবসা’র পর তিনি এবার তিনি ‘সুন্দরী-ব্যবসা’য় নাম লেখান। অন্তর শোবিজের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতা। এই আয়োজন নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক ও কেলেঙ্কারি। প্রতিযোগিতার শীর্ষ ১০ প্রতিযোগীর মধ্যে জান্নাতুল সুমাইয়া হিমিকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আয়োজকরা জানান, তিনি হয়েছেন দ্বিতীয় রানারআপ! পরে জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। বিচারকদের তালিকায় নাকি তার নামই ছিল না।

বিচারকরা যাকে প্রথম নির্বাচিত করেছিলেন, আয়োজকরা তাকে দ্বিতীয় ঘোষণা করতে বাধ্য করেন উপস্থাপিকাকে। বিয়ের তথ্য গোপনের জন্য জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের খেতাব বাতিল করে আবার ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ মুকুট পরানো হয় প্রতিযোগিতার প্রথম রানার আপ জেসিয়া ইসলামকে। প্রতিযোগিতা থেকে বাদ অজ্ঞাত কারণে বাদ পড়েছেন দ্বিতীয় রানার জান্নাতুল সুমাইয়া হিমিও। এরপর দ্বিতীয় রানার আপ ঘোষণা করা হয় চমককে। চমকেরও বিয়ে হয়েছে বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে রসালো আলোচনা!

বিচারকদের রায় তোয়াক্কা না করে আয়োজকরা নিজেদের পছন্দে সুন্দরী নির্বাচন করেছেন। একজন স্বপন চৌধুরীর একক ইচ্ছায় সব কিছু ঘটেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে পুরোপুরি অস্বচ্ছ, বিতর্ক ও কেলেঙ্কারিতে মোড়া এমন এক ‘লাভেলো মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার গ্র্যান্ড ফিনালের বিচারক ছিলেন জুয়েল আইচ, শম্পা রেজা, বিবি রাসেল, চঞ্চল মাহমুদ, রুবাবা দৌলা ও সোনিয়া বশির কবিরের মতো দেশ বরেণ্য ব্যক্তিরা। এত কিছুর পরও যারা নীরবতা পালনের ব্রত বেছে নিয়েছেন! শুধুমাত্র শম্পা রেজা এবং চঞ্চল মাহমুদকেই গণমাধ্যমে এই বিষয়ে কথা বলতে দেখা যাচ্ছে। বাকিরা নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করে চলেছেন।

একটি লোক ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতার নামে একটি প্রহসনের আয়োজন করেছেন, সেখানে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন মেয়েকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা ধরনের রসালো আলাপ-আলোচনা হচ্ছে, কে কার সঙ্গে প্রেম করেছেন, কার কয় বার বিয়ে হয়েছে, কে ‘দেহপসারিনী’ এসব নিয়ে নানা গালগল্প ছাপা হচ্ছে। কিছু মেয়ের জীবনের একান্ত ব্যক্তিগত ঘটনাগুলোকে নিয়ে এমন রসালো আলোচনা চালানোর সুযোগ করে দিয়েছেন এই তথাকথিত ‘সুন্দরী প্রতিযোগিতা’র আয়োজকরা। এর জন্য কী সমাজে তাদের কোনও জবাবদিহির দরকার নেই? জান্নাতুল নাঈম এভ্রিলের কান্নার কি কোনও দামই থাকবে না?

একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এই সব সুন্দরী প্রতিযোগিতা স্রেফ একটি ‘নিকৃষ্ট ব্যবসা’। এই ব্যবসার পণ্য হয়ে থাকেন তথাকথিত সুন্দরী নারীরা। ইঞ্চির মাপে যেখানে সৌন্দর্য পরিমাপ করা হয়, নারীর প্রতি এর চেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে? মিস ওয়ার্ল্ড বা মিস ইউনিভার্সের মতো সৌন্দর্য প্রতিযোগিতাতে নারীদের ৩৬-২৪-৩৬ এই ফিগারকেই আদর্শ ধরা হয়। এর বাইরে সবাই অসুন্দরী! কী সাংঘাতিক তত্ত্ব!

কিছু মানুষ লোভ আর লাভের নেশায় নারীকে পণ্য বানাবে, ইচ্ছে মতো সুন্দরী বানাবে, আবার ইচ্ছে হলে ছুঁড়েও ফেলবে, আর আমরা চুপচাপ দর্শক হিসেবে দেখবো, কেউ বা বিকৃত আনন্দ নেব, সেটা কি কোনও সভ্য মানুষের সমাজে কাম্য হতে পারে? অনেকে একে ‘চয়েস’, ‘সাফল্য’, ‘ক্ষমতায়ন’ হিসেবে দেখার বা দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এতে কোথায় সম্মান, কোথায় মর্যাদা, কোথায় ভালোবাসা? মনে রাখা দরকার যে মানুষের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন সম্মান, মর্যাদা ও ভালোবাসা। এটা আধ্যাত্মিক বা স্পিরিচুয়াল নিড। মূল্য পাওয়া এবং মূল্য দেওয়া। কিন্তু সেই জায়গায় কোনও ‘মিস ওয়ার্ল্ড বাংলাদেশ’ প্রতিযোগিতা আয়োজনকারী অবতারের কোনও ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। অবতাররা তালে আছেন কিভাবে নারীকে পণ্য বানানো যায়, টুপাইস কামানো যায়। এটা করতে গিয়ে কোন নারী হেয় হলো, কে কতটা অপমানিত হলো, এতে তাদের কিছুই যায়-আসে না!

সমাজে নয়া অবতার বা নয়া পাঁঠাদের দৌরাত্ম্য দেখে দেখে নিজেকে নিয়ত বিপন্ন মনে হচ্ছে। জাগছে আত্মঘৃণা। এটা শুভবুদ্ধিসম্পন্ন অনেক মানুষেরই সম্মিলিত অনুভূতি। নীতি-নৈতিকতাহীন জয়ীদের অট্টহাসি আমাদের মর্মে এসে আছড়ে পড়ছে এবং সামগ্রিক ব্যর্থতার দায় আমাদের ঘাড়ে ভূতের মতো চেপে বসছে। ফলে ‘পাঁঠা’দের প্রতি আমরাও ক্রমশ নমনীয় হয়ে উঠছি। পাঁঠারা আরও বড় আসনে অধিষ্ঠিত হচ্ছে!

এই ব্যর্থতা আমরা ঢাকবো কিভাবে?

লেখক: কলামিস্ট

আপ-এপিএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
কৃষিজমির উপরিভাগ কাটার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
কৃষিজমির উপরিভাগ কাটার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
বিএসএফের ছোড়া ৩০টি ছররা গুলি লাগলো বাংলাদেশি যুবকের শরীরে
বিএসএফের ছোড়া ৩০টি ছররা গুলি লাগলো বাংলাদেশি যুবকের শরীরে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ