X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

একটি চিঠি ও বিবিধ সংশয়

আমীন আল রশীদ
০৭ অক্টোবর ২০১৭, ১২:৪৩আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:১১

আমীন আল রশীদ এই ইন্টারনেটের যুগেও––যখন মানুষ চিঠি লেখা বলতে গেলে ছেড়েই দিয়েছে, তখন একটি চিঠি নিয়ে কী তুলকালাম কাণ্ডই না ঘটছে! কী আছে ওই চিঠিতে… চিঠিতে যিনি সই করেছেন, সেটি আসলেই তার কিনা, এত গুরুত্বপূর্ণ চিঠিতে এতগুলো বানান ভুল কেন ইত্যাদি ইত্যাদি…। মানুষের কৌতূহল আর সংশয়ের যেন শেষ নেই। কারণ চিঠিটা কোনও সাধারণ নাগরিকের নয়। এটি খোদ প্রধান বিচারপতির, যা কিনা তিনি লিখেছেন মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে।
একজন বিচারক অসুস্থ হয়েছেন অথবা অসুস্থ বোধ করছেন এবং তিনি আপাতত কাজ করতে সক্ষম নন বলে ছুটি নিয়েছেন––এটা ঘটনা হিসেবে অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তারপরও এ নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে এ কারণে যে, সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতি অসুস্থতার কারণে রাষ্ট্রপতির কাছে ছুটির আবেদন করেছেন। যখন প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে সংসদে এবং সংসদের বাইরে বিষোদ্গার হচ্ছে––তখন এই আকস্মিক ছুটি কিছু প্রশ্নেরও জন্ম দিচ্ছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, রাষ্ট্রপতির কাছে লেখা ছুটি বিষয়ক চিঠিতে প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, তিনি ক্যান্সার ও নানাবিধ রোগে আক্রান্ত। সেগুলো সম্পূর্ণ সারেনি। তাই বিশ্রামের প্রয়োজন। এমনকি ২ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো ওই চিঠি সচিবালয়ে ৪ অক্টোবর আইনমন্ত্রী মহোদয় সাংবাদিকদের কৌতূহল নিবারণের জন্য নিজেই পড়ে শুনিয়েছেন এবং চিঠিটি দেখিয়েছেনও; যা মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় ফেসবুকে এবং শুরু হয় চুলচেরা বিশ্লেষণ।
বাস্তবতা হলো, সংবিধানের ৯৭ অুনচ্ছেদ ‍অনুযায়ী কোনও বিচারপতি অসুস্থতার কারণে ছুটিতে যেতে চাইলে সেজন্য রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠি লেখা বা আবেদন জানানোর কোনও প্রয়োজন নেই। ৯৭ অনু্চ্ছেদে বলা আছে: প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে প্রধান বিচারপতি তাঁর দায়িত্বপালনে অসমর্থ বলে রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হলে ক্ষেত্রমত অন্য কোনো ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করবেন।
এখানে অসুস্থতাজনিত কারণে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লেখা বা ছুটির আবেদন জানানোর কোনও বিষয় নেই। বরং রাষ্ট্রপতি চাইলেই তাকে ছুটিতে পাঠাতে পারেন এবং সেইমতো আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম বিচারক আব্দুল ওয়াহহাব মিঞাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির কাছে চিঠির প্রশ্ন আসে যদি তিনি পদত্যাগ করতে চান এবং সেটি ৯৬ অনুচ্ছেদে পরিষ্কার বলা আছে। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ নয়, বরং এক মাসের ছুটিতে গেছেন।
দ্বিতীয়ত সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র হলেন রেজিস্ট্রার জেনারেল। প্রধান বিচারপতি যদি অসুস্থতার কারণে ছুটিতে যেতে চান, সেটি রেজিস্ট্রারের মাধ্যমেই জাতি জানবে। কিন্তু প্রধান বিচারপতির ছুটি চাওয়া, মঞ্জুর হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে কথা বলছেন আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল।
আরেকটি প্রশ্ন উঠছে যে, বেশ কয়েক বছর আগেই প্রধান বিচারপতি সিনহার ক্যান্সার ধরা পড়ে। সম্প্রতি তিনি বেশ কিছুদিন দেশের বাইরেও বেরিয়ে এসেছেন। তার শারীরিক অবস্থার অবনতির কোনও খবর পাওয়া যায়নি। শারদীয় দুর্গা পূজা উপলক্ষে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতেও হাসিখুশি ছিলেন। সবশেষ ৫ অক্টোবর বিকেলে যখন তিনি লক্ষ্মীপূজা উপলক্ষে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যান, তখনও সুস্থ ও স্বাভাবিক ছিলেন। হঠাৎ করে তিনি কী এমন অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে তাকে একমাসের ছুটিতে যেতে হলো? যদি ক্যান্সারের প্রভাব খুব বেশি হয় তাহলে তাকে তো হাসপাতালে ভর্তি করার কথা। এসব প্রশ্ন ফেসবুকে ঘুরপাক খাচ্ছে।
যদিও সরকার বলছে যে, প্রধান বিচারপতির ছুটিতে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা এবং একটি পক্ষ এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে চায়। বিএনপি বা অন্য বিরোধী পক্ষের এ নিয়ে রাজনৈতিক স্বার্থ থাকতেই পারে। কিন্তু এটাকে  সাধারণীকরণের সুযোগ নেই। কারণ বেশ কিছুদিন বিদেশে ছুটি কাটিয়ে কাজে যোগদানের ঠিক আগের দিন আকস্মিকভাবে প্রধান বিচারপতি সিনহার এই ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টি নানা কারণেই প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং রাষ্ট্রের যেকোনও নাগরিকেরই এই প্রশ্ন তোলার অধিকার রয়েছে। কেননা এর সঙ্গে দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নটি খুব সিরিয়াসভাবে জড়িত।
আওয়ামী লীগ নেতা ড. আব্দুর রাজ্জাক একটি টেলিভিশন চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে তিনি হয়তো একটা মানসিক চাপ অনুভব করছেন, তিনি হয়তো এটা উপলব্ধি করতে পারছেন যে তিনি ভুল করেছেন, সেই অনুশোচনা থেকে প্রধান বিচারপতি ছুটিতে গেছেন’। ক্ষমতাসীন দলের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের এই বক্তব্যের মধ্যে পুরো বিষয়টা পরিষ্কার।
তবে এই ঘটনায় প্রধান বিচারপতি নিজে কতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হলেন, তা হয়তো ইতিহাস নির্ধারণ করবে। কেননা আগামী পয়লা ফেব্রুয়ারি তার ৬৭ বছর পূর্ণ হবে। ফলে সংবিধান অনুযায়ী ওইদিন তার পদের মেয়াদ শেষ হবে। সুতরাং তিনি এক মাসের ছুটি শেষে আবার কাজে ফিরবেন কিনা, নাকি পয়লা ফেব্রুয়ারির আগে আরও কোনও ঘটনা ঘটবে, এই ছুটির মেয়াদ বাড়তে থাকবে কিনা, তা এখনই বলা মুশকিল। যদিও আইনমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা আশা করি এবং প্রার্থনা করি যে, তিনি (প্রধান বিচারপতি) এক মাস পরে আবার কাজ শুরু করবেন’।
তারপরও এই ঘটনা সরকার, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ভাবমূর্তি কিছুটা হলেও ক্ষুণ্ন করবে। দেশে এবং দেশের বাইরে নেতিবাচক বার্তা যাবে। যদি প্রধান বিচারপতি সিনহা আসলেই অসুস্থতার কারণে ছুটি নিয়ে থাকেন, তাও এই মুহূর্তে অনেকের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। কারণ তাকে নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে এবং খোদ সংসদ সদস্যরা তার পদত্যাগ দাবি করছেন। ফলে অনেকেই তার এই ছুটিতে যাওয়াটাকে ‘ভদ্রোচিত’ বা ‘নিরব অপসারণ’ বলে অভিহিত করছেন।
মনে রাখা দরকার, বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল নাকি সংসদের হাতে থাকবে––সেই প্রশ্ন সম্পর্কিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগ যে পূর্ণাঙ্গ রায় দিয়েছেন, সেখানে দেশের বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং একটি রাষ্ট্র গঠনের চ্যালেঞ্জসহ নানাবিধ বিষয় নিয়ে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। তারপরেই তার বিষোদ্গার শুরু হয়।
তবে আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ দল, যাদের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাদের আমলে একজন প্রধান বিচারপতির ছুটি ও অন্যান্য ইস্যু নিয়ে যেসব বিতর্ক হচ্ছে––তা খুবই দুঃখজনক এবং দেশের সাংবিধানিক ইতিহাসে এটি একটি ‘ব্যাড ইন্টট্যান্স’ হয়েই থাকবে, বিচার বিভাগে যার প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারি।
রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা যে নির্বাহী বিভাগের হাতেই এবং কাগজে-কলমে বিচার বিভাগকে স্বাধীন বলা হলেও এটা যে আসলে ‘সেপারেশন’ বা নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হওয়া ছাড়া কিছু নয়; বরং সংবিধানের ৯৪ অনুচ্ছেদ (এই সংবিধানের বিধানাবলি সাপেক্ষে প্রধান বিচারপতি ও অন্যান্য বিচারক বিচারকার্যে স্বাধীন থাকবেন) থেকে যে আমরা এখনও ঢের দূরে–– প্রধান বিচারপতি সিনহার আকস্মিক ‘‍ছুটি’ সেই নির্মম বাস্তবতাই যেন আমাদের আরও একবার মনে করিয়ে দিলো।
লেখক: সাংবাদিক

 

এসএএস/টিএন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
পার্বত্য তিন উপজেলার ভোট স্থগিত
কৃষিজমির উপরিভাগ কাটার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
কৃষিজমির উপরিভাগ কাটার ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
রাজধানীর শ্যামবাজার ঘাটে লঞ্চে আগুন
বিএসএফের ছোড়া ৩০টি ছররা গুলি লাগলো বাংলাদেশি যুবকের শরীরে
বিএসএফের ছোড়া ৩০টি ছররা গুলি লাগলো বাংলাদেশি যুবকের শরীরে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ