X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

মতবিরোধের দেশে

লীনা পারভীন
১৬ অক্টোবর ২০১৭, ১৭:৩৫আপডেট : ১৬ অক্টোবর ২০১৭, ১৭:৩৭

লীনা পারভীন মতবিরোধ, বিরোধিতা, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব—এ সবের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। তবে আমাদের দেশে দ্বন্দ্ব রূপ নেয় বিরোধিতায়, শেষ হয় শত্রুতায়। সেটা ক্রমেই রাজনীতির মাঠ থেকে ব্যক্তিপর্যায়ে প্রবাহিত হয়।
রাজনৈতিক মতবিরোধ থাকতেই পারে, কোনও দলের কৌশলের বিরোধিতা করা যেতেই পারে। সেটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হবে। কিন্তু পৃথিবীতে এমন কোনও দেশ কি আছে, যেখানে দলের সমালোচনা-বিরোধিতা করতে গিয়ে দেশের সঙ্গে বেঈমানির পর্যায়ে চলে যায়?
একটি দেশের রাজনৈতিক দল গঠিত হয় সে দেশের স্বাধীনতা, স্বার্বভৌমত্বকে স্বীকার করেই। বলা হয়, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। আমাদের এখানে দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি সবসময়েই বড় বলে প্রমাণিত।
আমাদের দেশে যেকোনও বিষয় নিয়েই বিতর্কের সূত্রপাত হয়। চাই আর না চাই, কোনও বিষয়েই যেন আমরা জাতিগতভাবে এক জায়গায় আসতে পারি না। ইতিহাসের নির্ধারিত ও মীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়েও আমরা তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়ে যাই অবলীলায়। বিতর্ক করি জাতির পিতা নিয়ে, কে স্বাধীনতাবিরোধী, কে বিরোধী নয়, এমন পরিষ্কার বিষয় নিয়েও চলে তুমুল বিতর্ক। স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক টেনে আনার পাশাপাশি চলে দেশের সংবিধানকে চ্যালেঞ্জ করে বিতর্ক। ১৯৭১ সালের যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমাদের এই দেশটা স্বাধীন হলো, সেই ইতিহাসকেও করা হচ্ছে বিকৃত। কী আশ্চর্য ঘটনা! একটা স্বাধীন দেশে বসবাস করে স্বাধীনতার বিরোধিতা করে রাজনীতি করে যাচ্ছে। দেশের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র করে চলেছে।

রাজনীতির মাঠে আমাদের প্রধান দু’টি দলের মাঝে একটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ, অন্যটি বিএনপি। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা এ দেশেরই একজন রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি নিজেকে কখনও স্বাধীনতার ঘোষক দাবি না করলেও তার দল করে আসছে বহু বছর ধরেই। তবে তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্রের বিষয়টিও। বলা হয়, সিনিয়র অফিসার হিসেবে তিনি সবকিছু জানতেন কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেননি।

যাই হোক, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে এ দেশের রাজনীতির গতিপথ বদলে গেলো। বিএনপি তিন বার ক্ষমতায় থাকলেও তাদের সব কাজ নিয়ে রয়েছে নেতিবাচক ইতিহাস। দেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক দল হলেও বিএনপির কর্মকাণ্ড কখনোই বিতর্কের বাইরে থাকেনি। তাদের বিরুদ্ধে বার বার এসেছে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ। এমনকি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রেরও অভিযোগ রয়েছে বিএনপির বিরুদ্ধে।  দলটি স্বাধীনতাবিরোধী চক্র জামায়াতের সঙ্গে আপস করে ক্ষমতায় যেতে চাইছে এখনও। ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত চক্রের আগুন সন্ত্রাসের কাহিনি কেউ চাইলেও ভুলে যেতে পারবে না। সব সাধারণ মানুষের জীবন গিয়েছিল সেদিন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল দেশের সম্পদ। রেললাইন উপড়ে ফেলা, ট্রেনে-বাসে আগুন দেওয়া, গাছ কেটে রাস্তা অবরোধ করা, পুলিশের ওপর হামলা, হত্যা—এ সবের মাধ্যমে ক্ষতি কার হয়েছিল? উত্তর একটাই, সেটা হচ্ছে আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা দেশ ও জনগণের ক্ষতি করেছে।

এদিকে আওয়ামীবিরোধিতায় পিছিয়ে নেই দেশের কিছু বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলও। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে যারা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের বিরোধী, এখন তারাই শেখ হাসিনার বিরোধী।

এরা আসলে কী চায়?  বিষয়টা আমাদের মতো আমজনতার কাছে মোটেও পরিষ্কার নয়। বিএনপির তো এমন অবস্থা যে, আওয়ামী লীগ যদি বলে উত্তর তাহলে যেকোনোভাবেই তাদের বলতে হবে দক্ষিণ। এই আওয়ামীবিরোধিতা করতে গিয়ে তারা কার কার সঙ্গে আপস করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে রাজনীতি করছে, সে বিষয়টি পুরোটাই উপেক্ষা করছে।

খুব দূরের ইতিহাসে যাওয়া লাগে না। উদাহরণ পাওয়া যায় তাদের সাম্প্রতিক অনেক কাজের মাঝে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে তাদের জাতীয়তাবাদী উদ্বেগের চেয়ে শেখ হাসিনাবিরোধী ইস্যুটাই লক্ষণীয়। এই বিষয়টির দিকে খেয়াল করলেই বোঝা যাবে বিএনপি কতটা দেশের জন্য রাজনীতি করে আর কতটা নিজেদের ক্ষমতার জন্য। বিরোধিতা করতে গিয়ে তারা ভুলে যায়, কোনটা জাতীয় ইস্যু, কোনটা দলীয় ইস্যু। রোহিঙ্গা ইস্যুটি কখনোই আওয়ামী লীগের ইস্যু নয়, এটি পুরোটাই বাংলাদেশের সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানে যখন সরকার আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে, তখন বিএনপি ব্যস্ত আছে পেছন  সরকারের খুঁত বের করার কাজে।

আমাদের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা-সক্ষমতার বিষয়টি কী হবে, এ সব নিয়ে তাদের কোনও রাজনৈতিক বিশ্লেষণ চোখে পড়েনি। অথচ এই দলটি তিন বার রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন ও  হাসিনার ৬ দফাকেও তারা সমালোচনা করতে থাকলো।

পিছিয়ে নেই আমাদের নাগরিক সমাজও। সিভিল সোসাইটির বিজ্ঞজনেরাও যখন সমালোচনা করেন, তখন সরকারের নীতির গঠনমূলক সমালোচনার চেয়ে বিরোধিতাটাই নজরে আসে বেশি। বিরোধিতা করুন, তবে আসল সমস্যা ও সমাধান চিহ্নিত করুন। কিন্তু তাদের বিরোধিতায় থাকে সরকারের সব কিছু। ভালো কাজেরও বিরোধিতা করতে হবে তাদের! এতে করে দেশের ভেতর-বাইরে একদল গোষ্ঠী ক্রমাগত জনগণের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

২.

প্রতিবেশী বন্ধুরা একে একে চেহারা পাল্টাতে শুরু করেছে, আমরা এর সমালোচনা করছি বটে।  তবে সেটা তারা কেন করছে? তাদের দেশের স্বার্থেই। কিন্তু আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো থেকে শুরু করে সুশীল সমাজ কেউ কি নিজ দেশের স্বার্থরক্ষার কথা জোর দিয়ে বলেন? সরকারবিরোধী বা আওয়ামী লীগবিরোধী বা শেখ হাসিনার বিরোধী রাজনীতি করতে গিয়ে অনেকে যে দেশবিরোধী হয়ে যাচ্ছে, তাতে কেউই নজর দিচ্ছেন না। আমরা মুখে ঐক্য চাইলেও কাজে অনৈক্যের সবচেয়ে বড় উদাহরণ দিয়ে যাচ্ছি।

এ সব বিতর্ক করতে গিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছি, রাষ্ট্রের মূল কাঠামোগুলোকে। আজকে বিতর্কিত হয়ে পড়ছে আমাদের বিচার-ব্যবস্থা, শাসন-ব্যবস্থা, আইন-ব্যবস্থা। এসব বিতর্ককে উস্কে দিতে পিছিয়ে নেই আমাদের সরকার দলীয় লোকেরাও। মন্ত্রী-এমপিদের ছন্নছাড়া কথাবার্তা সরকারের জন্য যেমন বিপদ টেনে আনছে, তেমনি প্রশ্নের মুখে ফেলছে দেশের গণতান্ত্রিক শাসন-ব্যবস্থাকেও। আইনের শাসন এখন দূরের এক বিষয়। সব বিতর্ক সবসময় ভালো ফল বয়ে নিয়ে আসে না।

তাই মনে হচ্ছে, নিজেদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব যা-ই থাকুক না কেন, দেশের প্রশ্নে, জাতীয় স্বার্থে সময়ের প্রয়োজনে আমরা সবাই এক হয়ে কাজ করতে পারি, এ যেন আমাদের জনগণের কাছে  স্বপ্নই হয়ে থাকবে চিরকাল।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
লোকসভা নির্বাচন: মণিপুরে ভোটকেন্দ্রে সংঘর্ষ
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
ওঠানামা করছে মুরগির দাম, বাড়ছে সবজির
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
শিশু হাসপাতালের আগুন নিয়ন্ত্রণে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ