X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘ভাবনার কেন্দ্রে আমি’

শেগুফতা শারমিন
১৭ অক্টোবর ২০১৭, ১৭:১১আপডেট : ১৭ অক্টোবর ২০১৭, ১৭:২৭

শেগুফতা শারমিন চালের দাম বাড়তি।
তাতে কী? আমি তো কিনে খেতে পারছি।
সন্ধ্যা থেকে লোডশেডিং।
তাতে কী? আমার বাসায়তো ২৪ ঘণ্টা জেনারেটর সার্ভিস।
শিক্ষা ব্যবস্থা তলানীতে।
তাতে কী? আমার বাচ্চারা তো ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ছে।

শিক্ষক রাজনীতি, লোভ এইসব কিছুতে শেষ হয়ে যাচ্ছে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো।

তাতে কী? আমার ছেলেমেয়েরা পড়ে বিদেশে।

হাসপাতালগুলোর দুরাবস্থা।

তাতে কী? মাউন্ট এলিজাবেথ, বামরুনগ্রাদ বা বেশি হলে লন্ডনে বা আমেরিকায়, নিদেনপক্ষে দিল্লি চেন্নাই আছে তো।

চারিদিকে যেন সেই মেরি এন্টোনিত। রুটি খেতে পারছো না তো কেক খাও! নিজেকে দিয়ে বিচার। নিজের মতো করে বিচার। চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে ‘আমি’।

বড় থেকে ছোট। ছোট থেকে বড়। সরকারি থেকে বেসরকারি। নেতা থেকে কর্মী। সবার মূল চিন্তায় আর কিছু নেই আমি ছাড়া। মনে করুন কোনও সরকারি দফতরে। জরুরি একটা বিষয়ে আলোচনা দরকার। যে আলোচনার সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে আছে কয়েক লাখ মানুষের ভালো থাকা মন্দ থাকা। সেই আলোচনাটা হবে তখন, যখন বাবুদের সময় হবে। মানে সকাল থেকে ওঠে বাচ্চার স্কুল, বাসার বাজার সেরে যখন অফিসে আসার সময় মিলবে, তখন হবে আলোচনা। সেই আলোচনায় আবার গুরুত্ব পাবে ব্যক্তি স্বার্থ। অথবা মনে করি, বেসরকারি সংস্থা। তবেতো তার নীতিমালা, নিয়ম-কানুন সবই হবে সংস্থা প্রধানের ব্যক্তি চাহিদা অনুযায়ী। তিনি যদি হন লেট রাইজার অফিস টাইম হবে ১০ টায়। যদি হন আর্লি রাইজার অফিস টাইম হবে ৮ টায়। যেই বসের পরিবারের টান নেই, সেই বস সন্ধ্যার পরও অফিসে থাকবেন। সবাই জানবে, বিরাট কাজ পাগল মানুষ তিনি।

এক সময় মানুষ করতো আদর্শের রাজনীতি। আদর্শ মুখ্য, ব্যক্তি গৌণ। আদর্শের ছাঁচে গড়া হাজারো হাজারো মানুষ, একই ভাবনার একই ঘরানার। এখন মানুষ করে ‘আমি’র রাজনীতি। আমি যা বলবো সেটাই ঠিক। আমার মতই মতো, আমার পথই পথ। নেতা যখন আমিগ্রস্ত। তখন পাতি নেতারা কেন বসে থাকবে? সুতরাং তারাও দ্রুত শিখে আমির আদর্শ। বছর ২৫ আগেও শিশুদের শেখানো হতো আপনার প্রশংসা। অথচ এখন চারিদিকে নিজের ঢোল নিজে বাজানোর প্রতিযোগিতা। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন এজেন্সি। নিজের প্রশংসা করছি, ঠিক আছে। ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন এজেন্সির দায় ভারও ব্যক্তির। কিন্তু সমস্যা হয়ে যায়, যখন ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা সমষ্টির ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়।

একেতো ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ এর সেই সুদূরপ্রসারী গণহত্যার ফলাফল দেখা যায় এখন। আমাদের দেশে কোনও সুচিন্তিত গঠনমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। নিদেনপক্ষে কোনও একক নীতিরীতি। যা অনুসরণ করে শহর থেকে গ্রাম, বড় সাহেব থেকে দিনমজুর সবাই একই মৌলিক ছাঁচে গড়ে উঠবে। ভালো-মন্দের পার্থক্য নির্ণয়ের কাঠামো হবে সুনির্দিষ্ট। সেই দেশে এখন লাখো লাখো মানুষের ব্যক্তিগত আমিত্ব। তার ওপর আছে অনলাইনভিত্তিক সহজ সামাজিক গণমাধ্যম। সুতরাং নিজের মেনিফেস্টো নিয়ে সবাই উদগ্রীব। ব্যক্তি ভাবছেন, আমি ভালো। আমার বুদ্ধি বিবেচনা ভালো, আমার সাজ পোশাক ভালো, আমার জীবনযাপন পদ্ধতি ভালো। সুতরাং ছড়িয়ে দেই। মানুষকে প্রলুব্ধ করি। ‘ওহে যে তুমি আমার মতো নও সে তুমি পিছিয়ে আছো। তোমার এই যে দুঃখ যাতনা। মাস শেষে টাকার অভাব, সংসারে অশান্তি। সব দূর হবে, শুধু আমাকে ফলো করো।’ ব্যস!  যেন নতুন তত্ত্ব। নতুন মন্ত্র। সেই বাপু নামক আম পাবলিকের সমস্যার মূল কোথায়, সেখানে খোঁজে কে? তার সমাধান আবিষ্কার করে কে? এত সময় কই আমিবাদীদের। সুতরাং আমিই সব, আমিই নায়ক থেকে মহানায়ক হওয়ার পথে। আমিতেই সব সমস্যার সমাধান!

এই আমিত্বের ভীড়ে খুব দ্রুত অপসৃয়মান আমাদের সামাজিক কাঠামো। আমিত্বের চাপে ক্লিষ্ট সংস্কৃতি। একেতো শেকড়ের রং জানা নেই। তার ওপর যার যা পছন্দ ছড়িয়ে দেওয়ার বাসনা। একদল দিতে থাকে। আরেকদল মরীচিকার মতো অনুসরণ করে। অর্ধেকপথ চোখ বন্ধ করে চলতে গিয়ে দেখা যায় মহান ‘আমি’ হঠাৎ বাঁক বদল করে ফেলেছেন। হুটোপুটিতে অনুসারীর দল তখন খুঁজে পায় না কোনদিকে যাবে। আবার দেখা যায় এক ‘আমি’র পিছে যেতে যেতে অনুসারীর দলের ভেতর হাজার ‘আমি’ জেগে ওঠে। তখন শুরু আমিতে আমিতে যুদ্ধ। যেই যুদ্ধে আরো পরিষ্কার হয়ে যায় সম্মুখের ভালোমন্দ লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য বরং একজনের চেয়ে আরেক জনের বেশি বড় ‘আমি’ হয়ে ওঠা!

মনে করুন, জন্মসূত্রে আপনি এই দেশের নাগরিক। দেশের প্রতি আপনার প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে, মমত্ব আছে। হয়তো এই অনুভূতি প্রকাশের ভঙ্গি আপনার একরকম। কিন্তু ততক্ষণ পর্যন্ত আপনার দেশপ্রেম, দেশপ্রেম না যতক্ষণ না তা কোন ‘আমি’ প্রদত্ত সংজ্ঞায় পড়ে। বা মনে করেন আপনি একধরনের পোশাক পড়ে স্বাচ্ছ্যন্দবোধ করেন। ব্যক্তির পোশাক ব্যক্তির রুচির ওপর নির্ভর করবে। কিন্তু আপনার রুচির সঙ্গে হয়তো কোনও ‘আমি’র রুচি মিলে না। সে তখন আবিষ্কার করবে আপনার জীবনের সব দুর্বলতার মূলে আপনার পোশাক। অতএব পোশাক পড়তে হবে ‘আমি’র মতো। ‘আমি’রাই সব বুঝে যায়। আমিরাই সব বলে দেয়। আমিরা ভুল না ঠিক সেই বিচার বিবেচনার জায়গায় নেই কেউ।

মোটকথা, ‘আমি’ যা বলবে তাই সই। বাকি সব ভুল সবই ভুল। এই ‘আমি’র রাজ্যে প্রতুলের গানের পিঁপড়ের মতো চারিদিকে দেখি কেবল ‘আমি’ ‘আমি’ আর ‘আমি’। কোথাও আমরা আর আমাদের খুঁজে পাই না।

লেখক: উন্নয়নকর্মী

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
শিশুকে পালাক্রমে ধর্ষণের অভিযোগে ৪ কিশোর সংশোধনাগারে
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
পাঞ্জাবের আশুতোষের ঝড়ও যথেষ্ট হলো না, মুম্বাইয়ের তৃতীয় জয়
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
কানের সমান্তরাল বিভাগে ঢাকার দুই নির্মাতার স্বল্পদৈর্ঘ্য
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
এআই প্রযুক্তিতে প্রথম বাংলা গানের অ্যালবাম
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ