X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

এরা কি ‘নষ্ট’ প্রজন্ম?

শান্তনু চৌধুরী
২০ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:০৮আপডেট : ২০ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:১৪



শান্তনু চৌধুরী আমরা যারা নব্বইয়ের দশকে বড় হয়েছি, মানে কিশোর বয়স থেকে তরুণ বয়সের দিকে যাচ্ছিলাম, সময়টা ছিল এমন, খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হতো। স্কুল, প্রাইভেট পড়া, বিকেলে খেলাধুলো শেষে সন্ধ্যার ছায়া নামার আগে আগেই বাড়িতে ফিরে পড়তে বসা। জোরে জোরে বা কোরাস করে পড়াও সে সময়ে একটা রেওয়াজ ছিল বটে। এখন শহর তো দূর অস্ত, গ্রামের ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও সেই প্রবণতা নেই বললেই চলে। মুরব্বিরা বলেন, ‘এখনকার ছেলে-মেয়ে তো’! পরিবার-পরিজন নিয়ে, স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটানোর মতো সময় এখন যেন নেই। প্রতিদিন প্রতিক্ষণে সবার সঙ্গে দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে কিন্তু সেই আন্তরিকতা নেই। কারণ সেই স্পর্শ নেই। স্পর্শ নেই মানে নির্ভরতা নেই। অনুভূতিহীন যেন এই সময়। কারণ এই প্রজন্ম স্মার্টফোন প্রজন্ম। যাকে বলা হচ্ছে, ‘আইজেন’। দ্য আটলান্টিকের এক প্রতিবেদনে এ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর স্মার্টফোনের প্রভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে।
বাংলা ট্রিবিউনসহ বেশ কয়েকটি সংবাদমাধ্যম এ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। ২০১২ সাল থেকে তরুণদের আচরণ ও মানসিক অবস্থার হঠাৎ পরিবর্তন আসে। ১৯৮২ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে জন্ম নেওয়া প্রজন্মকে গবেষকরা বলছেন, মিলেনিয়াল প্রজন্ম। ২০১২ সাল থেকে প্রজন্মের আচরণে প্রভাব পড়ার কারণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, ২০০৭ সাল থেকে ২০০৯ সালের বৈশ্বিক মন্দা মিলেনিয়াল প্রজন্মের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্য যাদের জন্ম, তাদের ‘আইজেন’ বলা যায়। এ প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে স্মার্টফোন ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে সম্বল করে। তাদের আচরণ ও আবেগের ধরন আগের চেয়ে আলাদা। হাইস্কুলে যাওয়ার আগেই তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অ্যাকাউন্ট তৈরি হয়েছে। ২০০৭ সালে আইফোন যখন প্রথম বাজারে আসে, তখন আইজেন প্রজন্ম একেবারেই শিশু ছিল। ২০১০ সালে যখন আইপ্যাড আসে, কেউ হয়তো হাইস্কুলের পথে। ২০১৭ সালে পাঁচ হাজার তরুণকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতি চার জনের তিন জনের কাছে আইফোন আছে।
এবার বিষয়টি যদি আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করি তবে কী দেখি? স্মার্টফোন এখন ঘরে ঘরে। আমাদের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেড়েছে, কমেছে স্মার্টফোনের দামও। এছাড়া রয়েছে সহজে স্মার্টফোন পাওয়ার নানা অফারও। গ্রামের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পরিবারের কেউ না কেউ দেশের বাইরে থাকছে। তারা যখন বিদেশ থেকে আসার আগে বা সেখান থেকে কী পাঠাবেন, জানতে চান প্রিয় প্রজন্মমের কাছে। প্রথমেই যেটি চাওয়া, সেটি স্মার্টফোন। এর ফলে তরুণ-তরুণীদের জীবনধারায় এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ফলে বদলে যাচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ ও মানসিক স্বাস্থ্যের ধরনও। সেটি কিভাবে? এই যে সাম্প্রতিক আলোচিত ব্লু-হোয়েল গেমের কথাই বলি। যেটি বন্ধে কঠোর হচ্ছে সরকার। নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে হাইকোর্ট থেকেও। কারণ এখনকার তরুণরা আত্মহত্যাকেও অ্যাডভেঞ্চার মনে করে। এই প্রবণতা এসেছে হতাশাবোধ থেকে। তাদের কাছে এখন হয়তো সামাজিক বন্ধনগুলো আগের মতো না থাকায় পরস্পরের প্রতি মমত্ব, জীবনের প্রতি দায়বোধ বা কর্তব্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে যেটি হচ্ছে কাছের মানুষকে তারা হয়তো আপন করতে পারছে না। কিন্তু অচেনা এক মানুষ যার সঙ্গে সরাসরি পরিচয় নেই, তাকেই ভাবছে আপন মানুষ। স্কুলের বন্ধু, পাশের বাসার কেউ বা একই পরিবারে থাকে এমন সদস্যের চেয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ভাইবার বা হোয়াটস অ্যাপে থাকা একজনের সঙ্গে নিজের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে ফেলছে সহজে। যার করুণ পরিণতিও ব্লু-হোয়েল গেমের মতো কত কিছু দিয়ে যে দিতে হচ্ছে ইয়ত্তা নেই। গবেষণাও বলছে, এই প্রজন্মই বেশি ভোগে মানসিক সমস্যা ও বিষণ্নতায়। সে কারণে বাড়ে আত্মহত্যার প্রবণতাও। কারণ তারা ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা ও চমক চায়। এ প্রসঙ্গে হোলি আর্টিজানে হামলাকারী তরুণদের কথাও উদাহরণ হিসেবে দেওয়া যেতে পারে। যারা নষ্ট প্রজন্মের প্রতিনিধিও বটে!
কেন এমন হচ্ছে? তা কিছুটা আলোচনা হয়েছে। আরও বিশদভাবে বলতে গেলে, এখনকার তরুণদের দৃষ্টিভঙ্গি ও জগৎ আলাদা হয়ে গেছে। তারা এখন সময় কাটায় সাইবার জগতে, পাশাপাশি বসেও ব্যস্ত মুঠোফোন নিয়ে। সামনাসামনি কথা বলার চেয়ে স্মার্টফোনে কথা বা চ্যাটে বেশি ব্যস্ত তারা। রাতের পর পর তারা জেগে থাকে ইন্টারনেটে। সেখানকার রঙিন দুনিয়ায় ঘোরাঘুরি আর ক্লাসে এসে ঘুমানো। কমে এসেছে ঘুমও। পেয়ে বসছে অবসাদ। একটা সময় ছিল বাসা থেকে ল্যান্ডফোনে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা কতই না কষ্টসাধ্য ছিল বা শপিং মল-এ ঘুরতে যাওয়া। কিন্তু এখনকার কিশোর-কিশোরীরা বন্ধুর সঙ্গে শপিং মলে ঘুরে বেড়ায় ইচ্ছে মতো। অনেকে শপিং করাকে শখ মনে করে। অনেকে হয়তো পরিবার-পরিজন নিয়ে গেলেও নিজে ব্যস্ত থাকে স্মার্টফোনে। একই ছাদের নিচে মা-বাবার সঙ্গে থেকেও মা-বাবার কাছ থেকে এখনকার প্রজন্ম যেন অনেকটাই দূরে। মা-বাবার সঙ্গে তারা কথা বলে কম। উত্তর দেয় সংক্ষিপ্ত। পরিবারের সদস্যদের দিকে মনযোগ থাকে কম। তারা বিছানায় শুয়ে-বসে মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখে। আশপাশে তাকানোর সময় নেই যেন।
তাই বলে কি এই প্রজন্ম সত্যিকারের নষ্ট প্রজন্ম? তা তো বলা যাবে না। দেশ-বিদেশে আমাদের কিশোর-কিশোরীরাই, তরুণ-তরুণীরাই স্বাক্ষর রেখে চলেছে দক্ষতার। ময়মনসিংহের কিশোরীরা বাংলাদেশের নারী ফুটবলকে নিয়ে গেছে অনন্য উচ্চতায়। মোস্তাফিজ, সৌম্য বা তাসকিনের মতো তরুণ ক্রিকেটাররাই আমাদের গর্ব। গণিত অলিম্পিয়াড, স্যাটেলাইট নির্মাণসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তরুণরা অবদান রেখে চলছে। তাহলে অবসাদে ভোগে কারা। যারা অনিশ্চয়তায় রয়েছে। এক্ষেত্রে সবার আগে ভূমিকা রাখতে হবে পরিবার তথা বাবা-মাকে। স্মার্টফোনের যুগে স্মার্টফোন ব্যবহার করতে না দেওয়া সমাধান নয়। কিন্তু সেটা একটা নির্দিষ্ট বয়সের পর। এরপর নজর রাখা, সে কী করছে তার দিকে। বন্ধুর মতো মিশতে চেষ্টা করা। যেন অন্তর্জালের পাশাপাশি আশেপাশের মানুষগুলোর কাছ থেকেও কোনও নোংরা প্রস্তাবে পা ফসকে না যায়। সাফল্যের গল্প শোনানো। জীবনের কোনও ধাপেই ব্যর্থ হলে সেটাকে ব্যর্থতা না ভেবে সাফ্যলের পথে এগিয়ে যাওয়ার সিঁড়ি বলেই মনে করিয়ে দেওয়া। ভালো কাজে উৎসাহ দেওয়া। যদিও ঢাকা শহরে মাঠ নেই, তবু ইন্টারনেট গেমের প্রতি আসক্তি কমিয়ে খেলাধুলোর প্রতি আসক্তি বাড়ানো। অন্তত দাবার মতো বুদ্ধিভিত্তিক খেলাগুলোর প্রতি। যারা শহুরে পরিবেশে মানুষ তারা যেন মাঝে মাঝে গ্রামে গিয়ে ছেলে মেয়েদের শেকড়ের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কিশোর-কিশোরীদের যতটা সম্ভব স্মার্টফোন থেকে দূরে রাখতে হবে। তা না হলে তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। যদি মুঠোফোন দিতেও হয়, তাহলে চেষ্টা করা ফিচার ফোন দিতে। স্মার্টফোন ব্যবহার করলে মাঝে মাঝে চেক করা কোন অ্যাপসগুলো সে ব্যবহার করছে। এতে যদি রাগারাগি করে তবে বুঝতে হবে সমস্যা গভীরে। খেয়াল রাখতে হবে রাতে তারা যাতে ঠিকমতো ঘুমায়। এসব কিছুর দায়িত্ব অভিভাবকের। ছেলে গেমস খেলছে সেটাতে খুশি না হয়ে বরং পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলার ওপর জোর দিতে হবে। বিভিন্ন মেলায় নিয়ে যাওয়া। বিশ্ব সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এখনকার প্রজন্ম বই পড়তে চান কম। যারা পড়েন তারাও বেশিরভাগ দরকারে তাও আবার নেট থেকে। একাডেমিক প্রয়োজনে বই নেট থেকে পড়তেই পারে কিন্তু জীবনের সত্যকে জানার জন্য, পড়ার আনন্দের জন্য যে পাঠ সেটা পড়তে হবে ছাপানো বইয়েই। এটা আমার মত। না হলে যে আবেগ অনুভূতিহীন প্রজন্ম সৃষ্টি হচ্ছে এরাই যখন পৃথিবীর প্রতিনিধিত্ব করবে তখন পুরো পৃথিবীটাই হয়ে পড়বে আবেগশূন্য। মানুষের প্রতি থাকবে না মমত্ববোধ, স্নেহ, প্রেম, ভালোবাসা। রোবটের দুনিয়া থেকে এর বেশি পার্থক্য থাকবে না। এসব থেকে ফেরাতে হলে উদ্যোগ নিতে হবে এখনই। নইলে সৃষ্টি হবে নষ্ট প্রজন্ম। যে প্রজন্ম ব্লু-হোয়েলের মতো গেম খেলবে। অন্যের প্ররোচনায় মানুষ হত্যা করতে দ্বিধা করবে না।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

 

/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ