X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রোহিঙ্গারা তাহলে বাংলাদেশেই থাকছে?

আমীন আল রশীদ
২২ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:৫৩আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:৫৯

আমীন আল রশীদ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা কি তাহলে বাংলাদেশেই থাকছে? তাদের ফেরত পাঠানো আদৌ সম্ভব হবে কিনা, এ প্রশ্ন উঠতেই পারে। কারণ রাখাইনে নিপীড়ত এই জনগোষ্ঠীর লোক এখনও দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকছে এবং তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে।
মানবিক কারণে এটি জরুরি হলেও, শেষমেষ বাংলাদেশ এই মানবিকতার ভিকটিম হয় কিনা, তা নিয়েও শঙ্কিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে যে কূটনৈতিক তৎপরতা এবং মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োজন, তা এখনও দৃশ্যমান নয়। ফলে মিয়ানমার যদি শেষমেষ এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে ফেরত না নেয়, তাহলে তারা বাংলাদেশেই থাকবে এবং এদেরকে ক্যাম্পে রাখা হলেও তা কক্সবাজারের স্থানীয় জনসাধারণ এবং পরিবেশ-প্রকৃতির ওপর কী ভীষণ প্রভাব ফেলবে, তা এরইমধ্যে টের পাওয়া যাচ্ছে।
১২ অক্টোবর একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গাদের আবাস তৈরির জন্য এরইমধ্যে উখিয়া-টেকনাফ এলাকায় ১২শ একর পাহাড় ও বন ধ্বংস হয়েছে। তাছাড়া রোহিঙ্গারা প্রতিদিন জ্বালানি হিসেবে কমপেক্ষ ৫ লাখ কেজি বাঁশ ও কাঠ পোড়াচ্ছে। এর ফলে শুধু বন উজাড়ই নয়, ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, রোহিঙ্গারা যে এলাকায় আবাস গড়ে তুলেছে, সেটি বন্য হাতির বিচরণস্থল। ফলে এরইমধ্যে বন্য হাতির আক্রমণে বেশ কিছু রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। ভবিষ্যতে এই ঘটনা আরও ঘটবে, তাতে সন্দেহ নেই।

স্থানীয়দের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের কারণে ওই এলাকার জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গেছে। রোহিঙ্গা আশ্রিত ক্যাম্পগুলোর সঙ্গেই স্থানীয় মানুষের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘরবাড়ি ও চাষযোগ্য জমি। যার অনেক কিছুই এরইমধ্যে চলে গেছে রোহিঙ্গাদের দখলে। 

রোহিঙ্গাদের জন্য ওই এলাকায় গড়ে উঠছে মসজিদ-মাদ্রাসা। অর্থাৎ বাংলাদেশ মানবিকতার খাতিরে এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিলেও তার ‘খেসারত’ দিতে হচ্ছে উখিয়া-টেকনাফের মানুষকে।

যখনই রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন হয়েছে, তখনই তারা সহায়-সম্বল ফেলে, যে যতটুকু পারে তাই নিয়ে নাফ নদী পার হয়ে বাংলাদেশে চলে আসে। সীমান্তে অপেক্ষার পর বিজিবির গ্রিন সিগন্যাল পেলে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। অনেকে চোরাপথে ঢুকে যায়। তবে এবারের ঘটনাটি অতীতের যেকোনও সময়ের রেকর্ড ছাড়িয়েছে।

রোহিঙ্গারা যখনই নির্যাতনের শিকার হয়, তারা নানা কারণেই বাংলাদেশকেই নিরাপদ মনে করে। প্রথমত তারা বিশ্বাস করে, এখানে কোনোমতে ঢুকতে পারলে তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা নেই। দ্বিতীয়ত এখানের সরকার ও জনগণ তাদের আর যাইহোক, মানবিক সহায়তাটুকু দেবে। তৃতীয়ত তারা ভাবে, যেহেতু রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটা আন্তর্জাতিক জনমত আছে, যেহেতু জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের নির্মমতার বিষয়ে ওয়াকিবহাল এবং এখানে বিদেশি সহায়তা আছে, তাই প্রাণ নিয়ে এই ভূখণ্ডে আসতে পারলে কিছু বিদেশি সহায়তাও পাওয়া যাবে। তারা মনে করে, রাখাইনে নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে থাকার চেয়ে বাংলাদেশের ক্যাম্পও অনেক বেশি সম্মানের এবং নিরাপদ।

এখন সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশ সীমিত সম্পদের দেশ এবং বিপুল জনগোষ্ঠীর চাপে জর্জরিত। বেকারত্ব এখনও একটি বড় সমস্যা। অর্থনীতি শক্তিশালী নয়। ফলে লাখ লাখ রোহিঙ্গা এদেশে ঢুকে পড়ায় এর সরাসরি চাপ পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে দিতে চায় মিয়ানমার।’ খোদ অর্থমন্ত্রীর তরফে যখন এরকম বক্তব্য আসে, সেটি চিন্তার কারণ বটে!

দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি সংবেদনশীল বিভিন্ন রাষ্ট্র যেমন যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইরান এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে নানাভাবে সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। তুরস্কের উপপ্রধানমন্ত্রী রিসেপ আকদাজ জানিয়েছেন, তার দেশ রোহিঙ্গাদের আবাসন ও স্বাস্থ্যখাতে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করতে চায়। বাংলাদেশ সরকার জায়গা নির্দিষ্ট করলে তারা নির্মাণকাজ শুরু করবে। ইরানের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী ড. সাইয়েন মোহাম্মেদ আইয়াজি জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার জন্য তারা ক্যাম্প এলাকায় একটি হাসপাতাল নির্মাণ করবেন। এজন্য জমি পেতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলেও জানানি তিনি। তবে ইরান বাংলাদেশ থেকে কিছু রোহিঙ্গাকে সাময়িকভাবে আশ্রয় দেবে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তার কাছ থেকে আশানুরূপ কোনও জবাব মেলেনি।

১৯ অক্টোবর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিদার নওয়ার্ট গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সহায়তায় মিয়ানমার ও বাংলাদেশকে এ পর্যন্ত ১০ কোটি ৪০ লাখ ডলার অর্থসহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় কোনও পদক্ষেপ মার্কিন প্রশাসন নেবে কিনা, তার সুস্পষ্ট কোনও জবাব দেননি তিনি। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য এ মুহূর্তে মানবিক সহায়তাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। দেখা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মহল রোহিঙ্গাদের সহায়তায় টাকা-পয়সা এবং বাংলাদেশে অবকাঠামো নির্মাণ করার কথা বললেও এই সংকট সমাধানের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফিরিয়ে নেওয়া বা তাদের অভিবাসনের দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। বরং সেই চাপটি বাংলাদেশকেই নিতে হচ্ছে। 

আর এই চাপের অবশ্যম্ভাবি পরিণতি উখিয়া-টেকনাফে সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয়। লাখ লাখ রোহিঙ্গার আবসনের কারণে বনভূমি ধ্বংসই শুধু নয়, এত মানুষের মলমূত্রও পরিবেশ বিপর্যয়ের বড় কারণ হয়ে দেখা দেবে। এদেরকে ভাসানচরে স্থানান্তরের যে চিন্তা সরকার করছে, সেই জায়গাটিও বাংলাদেশের। অর্থাৎ রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর চেয়ে এখন বরং বাংলাদেশে তাদের পুনর্বাসনই যেন মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠছে। এদের সহায়তায় বিভিন্ন দেশ অর্থ সহায়তা দিলেও সেটি বাংলাদেশের প্রাণ-প্রকৃতি আর সমাজজীবনে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তার ক্ষতিপূরণ কিভাবে সম্ভব হবে?

পালিয়ে আসা লাখ লাখ রোহিঙ্গার মধ্যে একটা বড় অংশই যুব-তরুণ। একসময়ের সক্ষম এই মানুষের এখন বেকার। তারা কতদিন বেকার থাকবেন? বাংলাদেশের লাখ লাখ যুব-তরুণই যেখানে বেকার, সেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর এই যুব-তরুণদের কী ধরনের কাজে নিয়েজিত করা সম্ভব? যদি সম্ভব না হয় তাহলে তারা কী করবেন? কোনও চরমপন্থী গোষ্ঠী যদি তাদের বাগিয়ে নেয় বা নেওয়ার চেষ্টা করে, সেই প্রক্রিয়া থামানোর কী অস্ত্র বা মন্ত্র আমাদের জানা আছে?

সম্প্রতি জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ৪০ হাজার শিশু মানবেতর পরিস্থিতিতে রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি সপ্তাহে ১২ হাজার শিশু শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে। ক্ষুধা ও সহিংসতা থেকে পালিয়ে আসা বেশিরভাগ শিশুই এখনও মানসিকভাবে বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ইউনিসেফ তাদের বিশুদ্ধ পানি ও টয়লেটের ব্যবস্থা করেছে এটা ঠিক। কিন্তু তাদের দায়িত্ব কি তারা নেবে? বাস্তবতা হলো, মিয়ানমারের যে মানসিকতা এবং আচরণ––তাতে শেষ অবধি এই শিশুদের শৈশবও হয়তো ঘুরপাক খাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে অনিশ্চয়তার বৃত্তে।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক।

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৩০ মামলার বিচার শেষের অপেক্ষা
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
উপজেলা নির্বাচন: ওসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
মেলায় জাদু খেলার নামে ‘অশ্লীল নৃত্য’, নারীসহ ৫ জন কারাগারে
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ