X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

বৃষ্টিবন্ধু?

আহসান কবির
২৩ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:৫৫আপডেট : ২৩ অক্টোবর ২০১৭, ১৬:০৩

আহসান কবির বৃষ্টিকে বলি বন্ধু আমার, বন্ধু তুমি যে তারও
বৃষ্টিতে ভেজা প্রথম দেখার স্মৃতিটাই বেশি গাঢ়
কেন ভেঙে গেলো ভালোবাসাবাসি তুমুল বৃষ্টিতেই?
শাহবাগে এলে মনে হয় শুধু কে যেন এখানে নেই!
বৃষ্টিতে ভালোবাসা যেমন গাঢ় হতে পারে, তেমনি সেই বৃষ্টিতেই ভেঙে যেতে পারে ভালোবাসাবাসির দেয়ালে ঘেরা ঘর! বৃষ্টিতে মানুষ যেমন বেশি রোমান্টিক, রোমাজনিত কারণে যেমন বাড়তে পারে জনসংখ্যা; তেমনি হতে পারে ভূমিধস, মরে যেতে পারে শত শত মানুষ। তারপরও বৃষ্টি এলেই নাকি মনে হয়, কে যেন নেই। মনে হয় গান— ঝর ঝর ঝর ঝর ঝরিছে/তোমাকে আমার মনে পড়েছে। মনে পড়ে প্রিয় সব রাস্তার কথাও। বৃষ্টিতে চিরচেনা রাস্তাগুলো নদী হয়ে যায়। তখনও মনে পড়ে গান— আমার একটা রাস্তা ছিল জানলো না তো কেউ (আসল গান: আমার একটা নদী ছিল জানলো না তো কেউ)! একদা যেসব নদীকে মারমুখো কিংবা ভাঙনপ্রবণ বলে মনে হতো, সেইসব নদীর কোনও কোনোটা হারিয়ে যায়। আর সামান্য বৃষ্টিতে প্রিয় রাস্তাগুলো হয়ে যায় নদী। জানি না নদীর নৌকা বা ছোট ছোট লঞ্চ একদিন সত্যি সত্যি রাস্তায় স্থায়ী হয়ে যাবে কিনা!

আসলে বৃষ্টি কেন হয়? পৃথিবীর সেরা ১০ বৃষ্টিবহুল স্থানের ভেতর কি বাংলাদেশ আছে? নাকি সামান্য বৃষ্টিতে যেসব শহর ডুবে যায় তার ভেতরে ঢাকাই প্রথম? আসলে মাধ্যাকর্ষণের টানে গাছ থেকে শুধু আপেলই পড়ে না, বৃষ্টিও পড়ে। বায়ুমণ্ডলে জলীয়বাষ্প জমলে আমরা বলি আকাশে মেঘ করেছে। বাষ্পকণা ভারি হয়ে গেলে বাতাস ও মাধ্যার্ষণের টানে সেটা নেমে আসে ভূমণ্ডলে, যাকে আমরা বৃষ্টি বলি। বৃষ্টি শুধু কালিদাস বা রবীন্দ্রনাথের মতো মানুষকে কবিই করে না, এই পৃথিবীর মানুষের সুপেয় পানির সবচেয়ে বড় উৎস এই বৃষ্টি। এই পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জলবিদ্যুৎ তৈরি, গাছ-গাছালির বেঁচে থাকা, নদীর স্বাভাবিকতা বজায় কিংবা কৃষি ও সেচের জন্য বৃষ্টির খুব বেশি প্রয়োজন।

বৃষ্টিবহুল প্রথম ১৫ বা ২০ দেশের ভেতরেও ঢাকা নেই! তবু কত জল থৈ থৈ করে রাস্তায়। আর প্রয়োজনের সময় জল থাকে না নদীতে! বৃষ্টি মাপা হয় মিলিমিটারে। আবহাওয়া অফিসের মাপ অনুযায়ী হালকা মাঝারি কিংবা ভারি হয়ে থাকে বৃষ্টিপাত। এক মিলিমিটার বৃষ্টি মানে হালকা, চার মিলিমিটার হলেও মাঝারি। চারের বেশি আর ১৬ মিলির কম হলেই সেটা ভারি। ৫০ মিলি পর্যন্ত অতি ভারি। এর বেশি হলে সেটা চরম বৃষ্টিপাত! তবে ‘দূরত্ব যতই হোক কাছে থাকুন’ কথাটা বাংলাদেশের জন্য খাটে না। ২০ কিলোমিটারের কম দূরত্বে থাকলেও বাংলাদেশ রেকর্ড করতে পারেনি। রেকর্ড করেছে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি। সেটা এখন দ্বিতীয় বৃষ্টিবহুল জায়গা। মেঘালয়ের মাওনসিরাম গ্রামকে এখন পৃথিবীর আর্দ্রতম স্থান বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

বৃষ্টির সাথে খিচুড়ির সম্পর্ক ছিল কিনা জানি না, কিন্তু এখন হয়েছে। তেমনি মাদকের সঙ্গে কি বৃষ্টির কোনও সম্পর্ক আছে? সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিবহুল স্থান কিন্তু মাদকের স্বর্গরাজ্য হিসেবে খ্যাত কলম্বিয়ার ললর। ললর বা চকো শহরে একটানা ২০ দিন পর্যন্ত বৃষ্টি হওয়ার রেকর্ড রয়েছে। এছাড়া আমেরিকার হাওয়াইয়ের মাউন্ট ওয়ালিয়ানো, অস্ট্রেলিয়ার মাউন্ট বেল্লেন্দেনকের, কানাডার লেক হেন্ডারসনও বৃষ্টিপাতের জন্য বিখ্যাত। পাহাড় বা লেক বৃষ্টির জন্য সম্ভবত আনন্দতম জায়গা। মেঘালয়ের মতো মাউন্ট ওয়ালিয়ানো ও বেল্লেন্দেনকের যেমন পাহাড়ঘেরা এলাকা, তেমনি ক্যামেরুনের দিবংসা, নিউজিল্যান্ডের সিলফোর্ডসাউন্ড, পাপুয়া নিউগিনির কিরতি, লাইবেরিয়ার মনরোভিয়াতেও প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়; পাহাড়েরও কমতি নেই এসব এলাকায়। সম্ভবত এ কারণেই কবিতায় আছে— পাহাড়ের কাছে এলে মনে হয় একাকী দাঁড়িয়ে থাকি/পাহাড় স্নান করবে বলেই বৃষ্টি তোমাকে ডাকি!

তবে মানুষের বসবাস শুরু হওয়ার পর একফোটাও বৃষ্টি হয়নি— এমন জায়গাও পৃথিবীতে আছে। জায়গাটা চিলির আটাকামা মরুভূমি। এই মরুভূমির মানুষেরা বৃষ্টিবিলাস কী, সেটা সম্ভবত অনুভব করতে পারে না। জানি না ওখানকার রবীন্দ্রনাথ কিংবা কালিদাসরা বৃষ্টি নিয়ে কখনও কবিতা লিখেছেন কিনা! বৃষ্টি নিয়ে কবিতা লেখার নাকি বিবিধ কারণ রয়েছে। মহাদেব সাহা যে কারণটি লিখেছেন, সেটা খুব মজার— কাগজ আবিষ্কারের আগে মানুষ কবিতা লিখে রেখেছে আকাশে। সেই ভালোবাসার কবিতা এই বৃষ্টি, এই ভরা বর্ষা। ইশ! যত বৃষ্টি, তত কবিতা! তবে কবিতা যেমন নকল করা যায়, তেমনি নকল বা কৃত্রিম বৃষ্টিও আছে। কৃত্রিম ডিম তৈরির মতো কৃত্রিম বৃষ্টিতেও এগিয়ে আছে চীন। বিশাল চীনের নদ-নদীর পানি চীন বাড়িয়ে নিয়েছে বাঁধ ও কৃত্রিম বৃষ্টির মাধ্যমে। কৃত্রিমভাবে জলীয়বাষ্প তৈরি করে তাদের বৃষ্টিপাত ঘটানোর কারণে মাঝে মাঝেই খেপে যায় ভারত ও ইরান। তাদের অভিযোগ, চীন নাকি এই দুই দেশের জলীয়বাষ্প অবৈধভাবে নিজ দেশের দিকে টেনে নিয়ে যায়।

তবে ভিনসেন্ট শায়েফারকে বলা হয় বৃষ্টিবন্ধু। তিনিই প্রথম কৃত্রিম মেঘ তৈরি করেছিলেন, বৃষ্টিকে নিজের মতো করে এনেছিলেন পৃথিবীতে। ভিনসেন্ট শায়েফার ড্রাই আইস বা জমাটবাধা কার্বন-ডাই-অক্সাইডের টুকরো দিয়ে কৃত্রিম মেঘ বানাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার পথ ধরেই একসময় আবিষ্কৃত হয়েছিল রেইন মেশিন। এই রেইন মেশিন চেনে সিনেমার নায়িকাকে। বাংলা বা হিন্দি ফিল্মের নায়িকারা যখন বৃষ্টিতে নাচে, তখনই রেইন মেশিনের দরকার হয়। যদিও স্বাভাবিক বৃষ্টির মতো ঝরে না রেইন মেশিনের বৃষ্টি, তবুও নায়িকার নাচের কমতি থাকে না।

বৃষ্টির নাচ নাকি পুরোটাই কমার্শিয়াল! তবে কমার্শিয়াল না, প্রকৃতির প্রতিশোধ। প্রকৃতির ওপর আমরা যে নির্মম আচরণ করেছি প্রকৃতি এখন সেসব আমাদের কড়ায় গণ্ডায় ফেরত দিচ্ছে! আমরা নিচু অঞ্চল বলে কিছু রাখিনি। বাসস্থানের চাহিদার জন্য ভরাট করেছি নিচু অঞ্চল কিংবা খাল। নদী শাসন করে, নদীকে গলা টিপে মেরে আমাদের কেউ কেউ নদীও দখল করেছে। আর তাই নদী-খাল আর নিম্নাঞ্চলে ঠাঁই না পেয়ে একটু বেশি বৃষ্টি হলেই রাজধানীসহ অনেক শহরের পথেঘাটে চলে আসে বৃষ্টির জল। গত কয়েকবছর ধরে বৃষ্টি মানেই যেন শহরজুড়ে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, নিমেষেই শহরটা হয়ে যায় জলাবদ্ধতার আধার। বৃষ্টি মানেই রাস্তায় জ্যাম। অফিস কিংবা স্কুলে যাওয়ার পথে চূড়ান্ত ভোগান্তি। পর্যাপ্ত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এ দেশে কখনও যেমন ছিল না, তেমন নেই যাত্রী ছাউনি।

আরও কিছু বৃষ্টিময় লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, যা আগে তেমন ছিল না। এখন বৃষ্টি মানেই পাহাড় ধস; পাহাড় ধসের মতো ভবন ধস, ফলাফল মানুষের প্রাণহানি। বৃষ্টি মানেই পরিবহন সমস্যা। বাজারে তরিতরকারি মাছ আর মাংসের দাম বাড়তি। বৃষ্টির অন্য নাম কি তাহলে ভোগান্তি কিংবা নিম্ন আয়ের মানুষের কান্না?

কান্না লুকোনোর জায়গা কি বৃষ্টি? চার্লি চ্যাপলিন বলতেন, কান্না লুকোতে চাইলে ভেজা উচিত বৃষ্টিতে! কেউ টের পাবে না সেই কান্না। পৃথিবীর বিখ্যাত এক মজার মানুষ বৃষ্টি নিয়ে কী অদ্ভুত কথাই না বলেছেন। হুমায়ূন আহমেদ বৃষ্টি এলেই বন্ধুদের কথা মনে করতেন। তার লেখায় আছে, ‘মনে পড়ে তাদের, যাদের সঙ্গ আজ আমায় প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ করে দেয়।’ বৃষ্টির নাকি রঙ আছে, আছে বেদনাও। আছে নাকি বৃষ্টির ঘ্রাণ। জানি না কারা কারা এই বৃষ্টির ঘ্রাণ পায়! জানি না কারা আসলে বৃষ্টিবন্ধু হতে পারে! নাকি বৃষ্টিবন্ধুরা থাকে শুধু কবিতায়?

এখনও সে একলা নদী বৃষ্টি পারাপার

রঙধনু আর বৃষ্টি তারে কেউ দিলো না ধার

মেঘ পোড়াতে নদীর এখন আগুন আয়োজন

বৃষ্টি চেয়ে একলা নদী কাঁদলো আজীবন

বৃষ্টিবন্ধু তোমার দেখি পাখির মত মন!

বিশেষ দ্রষ্টব্য: বাড়ির মালিক তার মালীকে ডেকে বললো, নয়ন যা তো, বাগানে পানি দিয়ে আয়। নয়নের উত্তর, স্যার আজ তো বৃষ্টি হচ্ছে। মালিক, তাতে কী? ছাতা নিয়া যা!

লেখক: রম্যলেখক

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৫ এপ্রিল, ২০২৪)
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ