X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

চীনা কমিউনিস্টদের কংগ্রেস এবং টাইট দড়ির ভবিষ্যৎ

আনিস আলমগীর
২৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:০৩আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:২৭

আনিস আলমগীর কার্ল মার্কস বলেছিলেন, পুরনো দার্শনিকেরা পৃথিবীটাকে শুধু ব্যাখ্যা করেছেন, আসলে দরকার তার আমূল পরিবর্তন। ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন, মাও সেতুং, হো চি মিন তার অনুসারী ছিলেন। তারা দীর্ঘদিন তাপস্যা করে বহু ত্যাগ স্বীকার করে তাদের স্ব-স্ব দেশে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছিলেন এবং মার্কসের দর্শন অনুসারে রাষ্ট্রও কায়েম করেছিলেন।
এ বছর মার্কসীয় দর্শনের প্রথম বিপ্লব “রুশ বিপ্লবের” শতবর্ষও পালন করা হচ্ছে। বাংলাদেশের কিছু বামেরাও এই উৎযাপনে শামিল হয়েছেন। কিন্তু এ দর্শনটা সোভিয়েত ইউনিয়নে কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। দীর্ঘ ৭০ বছর চর্চা করার পর গত শতকের নয় দশকে তারা এই দর্শনকে পরিত্যাগ করেছেন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতির বিধি ব্যবস্থায় ফিরে এসেছেন। সোভিয়েত রাশিয়াও ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। এখন পুরনো রাশিয়া রাষ্ট্রটিকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ আর কেউ নেবেন বলেও মনে হয় না। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে এখন কমিউনিস্ট পার্টির অস্তিত্বও নেই। রাশিয়ায় অবশ্য কমিউনিস্ট পার্টি বিরোধীদল হিসেবে এখনও অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। আগামী বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে একজন প্রার্থীও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা ঘোষণা দিয়েছে।

চীনে কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি সক্রিয়ভাবে উপস্থিত। সেখানে আর কোনও পার্টির অস্তিত্ব নেই। একবার ছাত্ররা আন্দোলনে নেমেছিলো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে। তখন দেং এর সময়, মাও পরলোকে। কিন্তু ট্যাংক চালিয়ে সব কিছুকে ধুলিসাৎ করে দিয়েছিলেন দেং জিয়াওপিংরা। দেং সংস্কারের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু মাও তাকে সংশোধনবাদী অখ্যায়িত করে দল থেকে বের করে দিয়েছিলেন। তার সমর্থকেরা ‘চার কুচক্রীর’ হাতে বহু নির্যাতনও ভোগ করেছেন। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় দেং টু শব্দটি পর্যন্ত করেননি, নিরবে তাস খেলে সময় কাটিয়েছেন।

মাও এর মৃত্যুর পর দেং পার্টিতে ফিরে আসেন এবং অর্থনৈতিক সংস্কারের কাজ শুরু করেন। তিনি সাংহাই সহ বিভিন্ন জায়গায় রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল গঠন করে বিদেশি পুঁজিকে চীনে আহ্বান করেন। আমেরিকার যে সব শিল্প মজুরির ভারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো সব কারখানা মালিকেরা চীনে কারখানা নিয়ে এসে পুনরায় চালু করেছিলেন। চীন হচ্ছে সস্তা শ্রমের দেশ। জাপান ও চীনে কারখানা স্থাপন করে সস্তা শ্রমের লোভে।

তাইওয়ান কিন্তু শিল্পে চীনের চেয়ে অগ্রগামী ছিল। দেং ঘোষণা দিলেন তাইওয়ানের উদ্যোক্তারা নিরাপদে শিল্প গড়ে তুলতে পারবে তাদের কারখানায় বা পুঁজিতে চীন হস্তক্ষেপ করবে না। তাইওয়ানের উদ্যোক্তারাও দলে দলে সাংহাইয়ের রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলে এসে শিল্প কারখানা গড়ে তুলেছিলো। দেং এই রফতানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চল গড়ে তুলে চীনের ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দেন এবং ব্যক্তি মালিকানা স্বীকার করে নেওয়ায় চীনেও বহু উদ্যোক্তা আত্মপ্রকাশ করে।

দেং পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় এমন গতি সঞ্চার করে দিলেন যে চীনেই বিলোনিয়ারের আত্মপ্রকাশ করা আরম্ভ করে। দেং এর পুঁজিবাদী ব্যবস্থার কারণে এখন চীন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। চীনে কমিউনিস্ট পার্টি ব্যবস্থা সচল রয়েছে। যদিও কমিউনিস্ট আদর্শের মৃত্যু হয়েছে চূড়ান্তভাবে।

কমিউনিস্টরা সর্বহারাদের একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিলো এবং তারাই এতদিন রাষ্ট্র পরিচালনা করতো। এখন এক নায়কতন্ত্র বহাল রয়েছে কিন্তু সর্বহারার নেতৃত্ব নেই। এখন সাধারণ পোষাক পরা মাও বা টায়ারের চপ্পল পায়ে হো চি মিনেরা আর সমাজতান্ত্রিক নেতৃত্বে নেই। এখন স্যুট টাই পরা বিলাসী সাহেবরা নেতৃত্বে সমাসীন। কমিউনিস্ট নাম ধারণ করে আছে শুধু রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে দলীয় একনায়কতন্ত্র অব্যাহত রাখার গরজে। ব্রিটিশরা যেমন বলে থাকেন আওয়ার কিং ইজ ডেড, লং লিভ আওয়ার কিং- ঠিক তেমনি।

চীনে কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস শুরু হয়েছে গত ১৬ আগস্ট থেকে। এটা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১৯তম কংগ্রেস। কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হচ্ছে বেইজিং এর গ্রেট হলে। কংগ্রেসের কারণে কোনও আড়ম্বর নেই বেইজিং শহরে। প্রতি পাঁচ বছর পর পর তারা এমন কংগ্রেসে মিলিত হয়ে গত পাঁচ বছরে যা করেছে তার পর্যালোচনা আর আগামী পাঁচ বছরে যা করবে তার পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকেন। নেতৃত্বও ঠিক করা হয় এ কংগ্রেসে।

এবারের কংগ্রেসে সারাদেশ থেকে ২ হাজার ২৮৭ জন ডেলিগেট জড়ো হয়েছেন। তারা চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ৮ কোটি ৯৪ লক্ষ ৪৭ হাজার সদস্যের প্রতিনিধি। কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রেট হলের প্রবেশ মুখে। তিন স্থানে তল্লাশি হয় খুবই নিখুঁতভাবে। ২৪৩ জন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রিসিডিয়াম সদস্য। তারা মঞ্চে সারিবদ্ধভাবে বসেন। তারাই হচ্ছেন কংগ্রেসের প্রিসাইডিং বডি। একক ব্যক্তি কংগ্রেসে সভাপতিত্ব করেন না। এদের মধ্যখানে বসেন দলের সাধারণ সম্পাদক ও রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

এবারও নিশ্চিত শি জিনপিং পার্টির সাধারণ সম্পাদক এবং রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হচ্ছেন। তার পিতাও কমিউনিস্ট পার্টির উচ্চস্তরের নেতা ছিলেন। সংশোধনবাদী হওয়ার অপরাধে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় জেলে ছিলেন। তখন শি জিনপিং নাকি পলাতক অবস্থায় কোনও এক গুহায় বসবাস করতেন; যদিওবা তখন তার বয়স ছিল কম।

শি জিনপিং এর ভাবমূর্তি খুবই উচ্চস্তরে। চীনারা মনে করেন তিনি মাও এবং দেং এর সমপর্যায়ের প্রতিভা সম্পন্ন নেতা। তিনি খুবই উচ্চাভিলাষী নেতা। উদ্বোধনী ভাষণে তিনি বলেছেন, চীন বিশ্বের অর্থনৈতিক ও সামরিক কেন্দ্র বিন্দু হবে। তিন ঘণ্টাব্যাপী গ্রেট হলে উদ্বোধনী ভাষণ দেন শি জিনপিং। তিনি বলেছেন, চীন নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। চীন যেভাবে অগ্রগতির শীর্ষে পৌঁছার পথ অবলম্বন করেছে তা অন্য জাতিরাও অনুসরণ করতে পারে। কিন্তু চীন অন্য কোনও দেশের আদর্শকে গ্রহণ করবে না।

জিনপিং বলেছেন, ২০৩৫ সালের মাঝে চীনের সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নের কাজ সম্পন্ন হবে। তথ্যায়নের গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতির কথাও তিনি বলেছেন। শি জিনপিং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের কথা বার বার উল্লেখ করেছেন। মঙ্গলবার ২৪ অক্টোবর কংগ্রেস শেষ হবে। শি জিনপিং এর পাঁচ বছর মেয়াদ উত্তীর্ণ হচ্ছে এবং নতুন করে পরবর্তী পাঁচ বছরের কর্মকাণ্ড শুরু হবে।

গত মেয়াদের শেষের দিকে এসে তিনি যে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’-এর মহাপরিকল্পনা নিয়েছেন তা এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ৬৫টি দেশের সঙ্গে চীনের সংযোগ স্থাপিত হবে। তখন সারাবিশ্ব চীনা পণ্যে সয়লার হবে। এরই মাঝে পুঁজির পাহাড় গড়েছে চীন। বর্তমানে তার রিজার্ভ হচ্ছে ৩ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার। তার অর্থই এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড ইনিশিয়েটিভকে সফলতার শীর্ষে নিয়ে যাবে।

তথ্যায়নে সারাবিশ্ব আমেরিকার দারস্থ। নৌ-বাহিনীতেও আমেরিকার স্থান শীর্ষে। ৩৮০টি রণতরী রয়েছে আমেরিকার। ২০৩৫ সালের মাঝে চীন সে ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে বলে মনে হয় না।

চীনের অভ্যন্তরে কোনও গোলযোগ যে নেই তাও নয়। এখন দুর্নীতির অভিযোগ এনে ১৩ লক্ষ লোককে জেলে আটক করে রাখা হয়েছে। এরা নাকি সবাই দুর্নীতিবাজ নন। সিংহভাগ নাকি শি জিনপিং এর বিরোধী লোক। আবার তিনটি প্রদেশে স্বাধীনতার দাবি উঠেছে। সোভিয়েতের অবস্থা যে হবে না তা কি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। টাইট দড়িইতো ছিড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected] 

 

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
তামাকপণ্যের দাম বাড়ানোর দাবি
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
ভারত সফর স্থগিত করলেন ইলন মাস্ক
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
বাঘ ছাড়া হবে জঙ্গলে, তাই শেষবার ভোট দিলেন বাসিন্দারা!
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে যশোর, জনশূন্য রাস্তাঘাট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ