X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

কেন ডাকসু নির্বাচন দরকার?

লীনা পারভীন
২৭ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:৪০আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০১৭, ১৫:১৬

লীনা পারভীন বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস মানে সৃষ্টির ইতিহাস। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা, প্রতিটা আন্দোলন-সংগ্রামের পেছনেই রয়েছে ছাত্রদের গৌরবজ্জ্বল ভূমিকা। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এই অঞ্চলের মাটির সঙ্গে মিশে আছে। সূর্য সেন, প্রীতিলতা, ইলা মিত্রদের উত্তরসূরীদের ত্যাগের ফসল আজকের স্বাধীন বাংলাদেশ। যখনই আমাদের দেশ মাতৃকার ওপর আঘাত এসেছে তখনই এদেশের ছাত্র সমাজ বুক চিতিয়ে এগিয়ে গিয়েছে দেশকে শত্রুমুক্ত করতে। ১৯৫২ থেকে ১৯৭১, পরবর্তীতে ১৯৯০ সে কথাই প্রমাণ করে।
১৯৭৫ সালে জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে শুরু হলো গভীর চক্রান্তের রাজনীতি। মেজর জিয়া এবং স্বৈরাচার এরশাদ দেশ পরিচালনায় দায়িত্ব নিয়ে চেষ্টা করেছিলো ছাত্র সমাজকে বিপথে পরিচালিত করে তাদের প্রতিবাদী চরিত্রকে বদলে দিতে। কিন্তু সে চেষ্টাও খুব বেশি সফল করতে পারেনি।
ছাত্র রাজনীতির প্রধান লক্ষ্য ছাত্রদের অধিকার নিয়ে লড়াই করা হলেও এই ভূখণ্ডের ছাত্র রাজনীতি কেবল ছাত্র ইস্যুতেই থেমে থাকেনি। প্রতিটা জাতীয় ইস্যুতে তাদের রয়েছে সক্রিয় ভূমিকা। জাতীয় রাজনীতিও তাই সমৃদ্ধ হয়েছে ছাত্রদের মাধ্যমে। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় যারাই এসেছে তাদের প্রত্যেকেই নির্ভরশীল ছিল ছাত্র সমাজের ওপর। তাই প্রতিটা রাজনৈতিক দলেরই সহযোগী সংগঠন হিসাবে গড়ে উঠেছে ছাত্রসংগঠন।

আমাদের দেশে যতগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ইতিহাস লিখতে গেলে সবার আগে আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস মানে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস, ভাষার ইতিহাস, স্বৈরাচার শাসকের কবল থেকে মুক্তির ইতিহাস।

ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে বিভক্তি থাকলেও জাতীয় কোনও ইস্যুতে সাধারণ ছাত্ররা সবসময়ই জোটবদ্ধভাবে আন্দোলন করেছে। এক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা রাখে ছাত্র সংসদ। আদর্শগত পার্থক্য থাকলেও দেশের ইস্যুতে ছাত্র সমাজ সবসময়ই এক ছিল এবং আছে। জাতীয় নেতৃত্ব তৈরিতে ছাত্র সংসদগুলোর ভূমিকা এখনও পর্যন্ত কেউ অস্বীকার করতে পারেনি।

আজকে আমাদের দেশে যে নেতৃত্বের শূন্যতা চলছে, রাজনীতিতে যে দুর্বৃত্তায়ন চলছে তার পেছনে অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে ছাত্রদের রাজনৈতিক অবস্থানের অভাব। ক্যাম্পাসগুলোতে নেই ছাত্রদের কোনও রাজনৈতিক শিক্ষার সুযোগ, নেই সাংগঠনিক আন্দোলন। যারা আছে তাদের বেশিরভাগই নামকাওয়াস্তে আছে, সংখ্যাগরিষ্ঠদের কণ্ঠকে জয় করতে পারছে না। বড়দলগুলো ব্যস্ত আছে ব্যক্তিগত এজেন্ডা অর্জনে। এই সুযোগে স্থান করে নিচ্ছে অপরাজনীতি, অপসংস্কৃতি।

সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সরকার ভবিষ্যত নেতা তৈরি, ছাত্রদের মাঝে ছোটবেলা থেকেই রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরি এবং সবার মাঝে গণতান্ত্রিক চেতনাকে জাগ্রত করতে শুরু করেছে স্কুলভিত্তিক কেবিনেট নির্বাচনি ব্যবস্থা। উদ্যোগটি অবশ্যই প্রশংসার। কিন্তু তার চেয়েও বেশি দরকার আমাদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা যেখান থেকেই তৈরি হবে আমাদের জাতীয় রাজনীতির যোগ্য নেতৃত্ব। থাকবে একটি ধারাবাহিকতা। আবার ক্যাম্পাসজুড়ে গড়ে উঠবে সংস্কৃতি চর্চার ক্ষেত্র, ছাত্রদের মাঝে আলোচনার ঝড় উঠবে দেশের চলমান ও ভবিষ্যত অবস্থা নিয়ে। সাধারণ ছাত্ররা খুঁজে পাবে তাদের পক্ষে কথা বলার মতো যোগ্য নেতাকে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিন্তার যে বন্ধ্যাত্ব চলছে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতে সেখানে আবার আসবে পরিষ্কার পানির স্রোত। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আজকে যে একচেটিয়া আচরণ করে যাচ্ছে তারাও বিনা চ্যালেঞ্জে কিছু করতে পারবে না। সেখান থেকেই ছড়িয়ে যাবে সারা দেশে। সমাজের আনাচে-কানাচে। তারাই দায়িত্ব নেবে আবার দেশকে সামনে নিয়ে যাওয়ার। আন্দোলন সংগ্রামের মাঝে আবার আমরা পাবো শেখ মুজিব, তাজউদ্দীনের মতো নেতাকে। নেতা কখনও নিজে নিজে নেতা হতে পারে না। পরিবেশ পরিস্থিতি বা সময়ের প্রয়োজন নেতাদের তৈরি করে।

আমাদের রাষ্ট্রপতিও একথা স্বীকার করেছেন এবং তিনিও ডাকসু নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছেন। ছাত্রদের ভূমিকা কেবল রাজনীতির মাঠ নয়, আমাদের ছাত্র সমাজ এগিয়ে এসেছে দেশের যেকোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগেও। সকলে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে গেছে দেশ গড়ার কাজে। আর এগুলোই একজন ছাত্রকে সামাজিকভাবে সচেতন হতে শেখায়, মানবিক হতে শেখায়। অন্যের অধিকারকে, মতকে স্বীকৃতি দিতে শেখায়।

কিন্তু ১৯৯০ এর পর আর কোনও সরকারের আমলেই ডাকসু নির্বাচন হয়নি। অনেকবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনও এক অদৃশ্য কারণে সেই নির্বাচন রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেবল ডাকসু নয়, চাকসু, রাকসু, জাকসু, বুয়েট, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বিভিন্ন কলেজ এবং মেডিক্যাল কলেজগুলোতেও যে ছাত্রদের ফোরাম রয়েছে সেগুলোতেও নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনাটা খুব জরুরি। আমাদের প্রাইমারি স্কুলগুলোতে যদি নির্বাচনি ব্যবস্থা প্রবর্তন করার প্রয়োজন হয় তবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় কেন এর থেকে বাদ যাবে? বিশেষ করে যখন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলবাদী রাজনীতির চর্চার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

ছাত্র সমাজকে মূলধারায় সঠিকভাবে সম্পৃক্ত করার কোনও বিকল্প নাই। গোটা সমাজে এই চলমান ক্ষয়কে রুখতে হলে, জঙ্গিবাদ, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে সবার আগে সক্রিয় করতে হবে আমাদের সচেতন ছাত্র সমাজকে। তাদের মাঝে ফিরিয়ে আনতে হবে দেশপ্রেমের শপথ। আর সেই কাজটি করতে পারে সমাজে সঠিক রাজনৈতিক চর্চা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম শর্ত হচ্ছে অবাধ মতামতের প্রকাশ। দিনে দিনে এই জায়গাগুলোই আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ছাত্ররা আজকে দ্বিধাগ্রস্ত। কোনটা সঠিক চিন্তা, একজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রের কাছে দেশের কী প্রত্যাশা সে সম্পর্কে নেই কোনও ধারণা, গড়ে উঠছে না দায়িত্ববোধ। হারিয়ে যাচ্ছে দেশ নিয়ে তাদের ভালোবাসার গল্প। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালেই বোঝা যায় অবক্ষয় কতটা গ্রাস করেছে আমাদের প্রজন্মকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ছাত্ররা আন্দোলন করতে চায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত পরিবেশকে বন্ধ করার মতো মৌলবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে তারা শক্ত হয়ে দাঁড়ায় না। তারাও মনে করে টিএসসি’তে শিল্প সংস্কৃতির চর্চাকে নিয়ন্ত্রণে আনা প্রয়োজন।

সম্প্রতি এমনি এক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ-তরুণীর মধ্যে চলা বিতর্কের ভাষাই বলে দিচ্ছে শিক্ষার্থীরা না শিখছে বইয়ের ভাষা, না সমাজের ভাষা। জ্ঞান কেবল পড়া মুখস্থের মধ্যে সীমিত নয় এ কথাটাই ভুলে যেতে বসেছে তারা। একজন নারীকে জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করতে, তাকে পতিতা হিসাবে তুলনা করতেও তাদের সংস্কৃতিতে আটকায় না। এরা কারা? ভবিষ্যৎ কী এদের? এদের মধ্য থেকেই হয়তো কেউ কেউ অনেক বড় জায়গায় যাবে। নীতি-নির্ধারক হবে। তাহলে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে ধর্মীয় যুক্তিতে বাঁধতে চায়, যারা একজন নারীর স্বাধীন চলাফেরাকে রুদ্ধ করতে চায় তারা কোথা থেকে পাচ্ছে এই শিক্ষা, সাহসই বা আসছে কেমন করে? এ কোন সংস্কৃতি নিয়ে বেড়ে উঠছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্ররা? এ নিয়ে কি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক বা অন্যান্য সচেতন মহল ভাবছে কিছু?

ভাবতে হবে গভীরভাবে। একটি দেশের পথ প্রদর্শক হিসাবে, জ্ঞান-বিজ্ঞানের মেরুদণ্ড হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ও সংবাদমাধ্যম। এ দু’টোর মধ্যে একটি চমৎকার আধুনিক দৃষ্টির সংযুক্তি থাকাটা জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের কাজ কেবল নিয়ম করে রুটিন মাফিক ক্লাস বা পরীক্ষা পরিচালনা করা নয়। একজন ছাত্রের মননের বিকাশকে নিশ্চিত করাও দায়িত্বের মধ্যে আসে। এ জায়গাটি দারুণভাবে উপেক্ষিত। ছাত্রদের সামনে কোনও ইতিবাচক আদর্শ নেই। সঠিক ও সুস্থ আদর্শের চর্চা নেই। দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলার মতো কোনও কার্যক্রম নেই। সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোও টিকে আছে দায়সারাভাবে। এভাবে চলতে থাকলে সামনে কেবল অন্ধকারকেই খুঁজে পাবো আমরা। জেগে উঠতে হবে সবাইকে। কথা বলতে হবে এসব অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে। আসুন আমরা সবাই দাবি তুলি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়, একটি প্রজন্ম আর সামনের বাংলাদেশকে বাঁচাতে এর কোনও বিকল্প নেই।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

/এমও/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহের উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
রিয়ালের মধুর প্রতিশোধে গর্বিত আনচেলত্তি 
রিয়ালের মধুর প্রতিশোধে গর্বিত আনচেলত্তি 
টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ককটেল বিস্ফোরণ, শহরজুড়ে আতঙ্ক
টাঙ্গাইল শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে ককটেল বিস্ফোরণ, শহরজুড়ে আতঙ্ক
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৭ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলা বৃষ্টির পূর্বাভাস
আজকের আবহাওয়া: ঢাকাসহ ৭ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলা বৃষ্টির পূর্বাভাস
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ