X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

‘গোয়েন্দা কাহিনি’

আমীন আল রশীদ
২৯ অক্টোবর ২০১৭, ১৩:৫৬আপডেট : ২৯ অক্টোবর ২০১৭, ১৪:০০

আমীন আল রশীদ শৈশব-কৈশোরে মাসুদ রানা পড়ে তার মতো গোয়েন্দা হতে চায়নি, এমন তরুণ খুঁজে পাওয়া কঠিন। বস্তুত মাসুদ রানার কারণেই তরুণদের কাছে গোয়েন্দারা একধরনের নায়কে পরিণত হন। কিশোর-তরুণের মনে গোয়েন্দাদের একরকম অতিমানবীয় মূর্তি গড়ে ওঠে। ফলে দূর থেকেও যখন তারা একজন গোয়েন্দাকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে দেখে, তার দিকে সমীহভরে তাকায়।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, কল্পনার এই নায়কেরা বাস্তব জীবনে এসে প্রায়ই ভিলেনে পরিণত হন এবং তাদের হাতে সাধারণ নাগরিকদের বিবিধ উপায়ে নাজেহাল হওয়ার খবর সংবাদ শিরোনাম হয়। আবার এসব ঘটনার একটা বড় অংশই দৃশ্যের আড়ালে থাকে। নাজেহালের শিকার লোকেরা ভয়ে অনেক সময়ই এসব ঘটনা চেপে যান। কিন্তু কক্সবাজারের টেকনাফে সবশেষ যে ঘটনা ঘটলো, সেটি অতীতের ঘটনাগুলোর চেয়ে একেবারেই ভিন্নমাত্রার। কেননা, একজন ব্যবসায়ীকে অপহরণের পর তার কাছ থেকে ‍মুক্তিপণের টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার পর ৭ জন ডিবি পুলিশ ধরা খেয়েছেন সেনা সদস্যদের হাতে।
তাদের তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। অপহরণের শিকার ওই ব্যবসায়ীর মামলায় জামিন নামঞ্জুর করে তাদের পাঠানো হয়েছে কারাগারে। ঘটনা তদন্তে একটি কমিটিও করেছে জেলা পুলিশ। বাহিনীর মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেছেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ঘটনার পরের এই পদক্ষেপগুলো নিঃসন্দেহে প্রশংসার এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে জরুরি।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি ওই ব্যবসায়ীর পরিবার কৌশল করে বিষয়টি সেনাবাহিনীকে না জানাতো এবং সেনা সদস্যরা যদি সত্যি সত্যি তাদের হাতেনাতে ধরতে না পারতেন, তখন পরিস্থিতি কী হতো? ওই ব্যবসায়ী শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হওয়া কিংবা কথিত ক্রসফায়ারে নিহত না হলেও তিনি ডিবি পুলিশকে যে ১৭ লাখ টাকা দিয়েছিলেন, সেই টাকা কোনোদিনই আর ফিরে পেতেন না। ঘটনার পরে তিনি স্থানীয় থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নিতো কিনা, তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। যেহেতু ডিবি পুলিশ সাদাপোশাকে অভিযান চালায়, তাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এই ঘটনা হয়তো পুরোপুরি অস্বীকার করতো। কেননা, এর আগেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অনেককে তুলে নেওয়ার পরও সেটি সংশ্লিষ্টরা স্বীকার করেনি। কারণ সব সময় এর কোনও প্রমাণ থাকে না। বরং মামলা করতে গেলে ওই ব্যবসায়ীর পরিবার আরও বেশি রোষানলে পড়ত এবং শুধু ওই ১৭ লাখ টাকাই নয়, তাদের জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ত। ওই ব্যবসায়ীর অভিযোগের প্রেক্ষিতে এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে বা সামাজিক চাপ বাড়লে সরকারের তরফে বড়জোর তদন্তের আশ্বাস দেওয়া হতো। যতক্ষণ না তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হতো ততক্ষণ ওই পরিবারটি আতঙ্কে এবং নিরাপত্তাহীনতায় থাকতো। এমনকি মামলা নিতে পুলিশ বাধ্য হলেও সেই মামলা তুলে নিতে তাদের প্রাণনাশ বা এলাকাছাড়া করার হুমকিও হয়তো আসতো। শৈশব-কৈশোরের নায়ক গোয়েন্দাদের বিষয়ে এখন এই কথাগুলো অনায়াসেই বলে দেওয়া সম্ভব।

অথচ ঘটনাটি হওয়ার কথা ছিল একেবারেই বিপরীত। অর্থাৎ কোনও একদল দুর্বৃত্ত ওই ব্যবসায়ীকে অপহরণের পর মুক্তিপণের টাকা চাইতো এবং সেই খবর পেয়ে ডিবি পুলিশের নায়কেরা সিনেম্যাটিক ভঙিতে অভিযান চালিয়ে ওই ব্যবসায়ীকে অক্ষত উদ্ধার করতেন এবং টাকাসহ হাসিমুখে তাকে তার পরিবারের হাতে তুলে দিয়ে গুডবাই চলে চলে যেতেন। অপরাধীদের হাতকড়া পরিয়ে সাদা মাইক্রোবাসে তুলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি ধীরে ধীরে ফোকাসের আড়াল হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো এই যে, সেই নায়কদেরই ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সারা দেশের মানুষ দেখলো। কল্পনার নায়কেরা এখানে ভিলেন।

কক্সবাজারের এই ঘটনার পরদিন ২৬ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকের প্রধান শিরোনামই ছিল ‘গোয়েন্দা পুলিশের হয়রানির গল্প’। খবরে বলা হয়, অনুপম বণিক নামে রাজধানীর ফকিরাপুলের একজন ব্যবসায়ীর অফিসে গিয়ে বারোশোর বেশি পাসপোর্ট জব্দ করে কোটি টাকা ঘুষ দাবি করেন সিআইডির মতিঝিল ইউনিটের একজন  উপ-পরিদর্শক। শেষ পর্যন্ত ৪৫ লাখ টাকার বিনিময়ে প্রায় ১১শ' পাসপোর্ট ফেরত পান। বাকি ১০১টি পাসপোর্ট জব্দ তালিকায় দেখিয়ে অনুপমের ভাই প্রবীর বণিক ও তার দুই কর্মচারী মো. রিয়াদ হোসেন ও আশিকুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করে সিআইডি। লোমহর্ষক এরকম ঘটনা অনেক ব্যবসায়ীর জীবনেই আছে। কিন্তু তারা পুনর্বার হয়রানি বা পরিবারের নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে এসব চেপে যান।

তবে ডিবি পুলিশ যে নায়কের ভূমিকায় থাকে না, তা নয়। তাদের অজস্র ভালো কাজের উদাহরণও আমাদের সামনে আছে। অনেক অপহৃতকে উদ্ধার, বড় বড় সন্ত্রাসীকে ধরার মতো সাফল্য তাদের নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু হাজারো ভালো কাজের ভিড়ে সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের নাজেহাল করার ঘটনাও ভুরি ভুরি। পুলিশের গোয়েন্দা শাখা বা ডিবির প্রতি মানুষের বিশ্বাস ও নির্ভরতা অনেক। কিন্তু যখন এরকম একটি শক্তিশালী ও দক্ষ বাহিনীর বিরুদ্ধে এ জাতীয় অভিযোগ ওঠে, তখন নাগরিকদের ভীত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

কক্সবাজারে গ্রেফতার ৭ ডিবি পুলিশের নিশ্চয়ই বিচার হবে। ওই ব্যবসায়ীর টাকাও উদ্ধার হয়েছে। কিন্তু এ জাতীয় ঘটনা কি এখানেই শেষ হবে? সেই সম্ভাবনা একেবারেই কম। কারণ এরকম ঘটনা বছরের পর বছর ধরেই চলছে। কতটি ঘটনা জানা যাচ্ছে আর জানা গেলেও কতটির ন্যায়বিচার হচ্ছে? মনে রাখা দরকার, জনগণের করের পয়সায় যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাখা হয় জননিরাপত্তার স্বার্থে, সেই বাহিনীকেই সব আমলে সব ধরনের সরকার মূলত ব্যবহার করে বিরোধী মত দমনে। ফলে পুলিশ যখন সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন তারা সাধারণ নাগরিকদের ওপর যত বড় অন্যায়ই করুক না কেন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নৈতিক অধিকার সরকারের থাকে না। ফলে আখেরে ভরসা সেই বিচার বিভাগ। কিন্তু সব ঘটনা আদালত অবধি গড়ায় না।

নারায়ণগঞ্জে লোমহর্ষক সাত খুনের মামলার রায়ে র‌্যাব সদস্যদের ফাঁসির দণ্ড কি এ জাতীয় ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাবে? হয়তো কমাবে। কিন্তু তা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা ততক্ষণ পর্যন্ত সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্য‌ন্ত না পুলিশ বাহিনীতে লোক নিয়োগে মোটা অংকের ঘুষ আর দলীয় বিবেচনা পরিহার করা না হবে। পুলিশ যতদিন সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকবে, ততক্ষণ পুলিশের পক্ষে জনগণে বন্ধু হওয়ার সুযোগ নেই।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতনও যথেষ্ট বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু তারপরও ঘুষ কি বন্ধ হয়েছে? হবে না। তার চাহিদা প্রতিদিনই বাড়ে। ফলে যে লোক সৎ, সে কম বেতন পেলেও ঘুষ খাবে না। আবার যে অসৎ তাকে বস্তা ভরে বেতন দিলেও সে ঘুষ খাবে। ফলে গণকর্মচারীদের ঘুষ খাওয়া কিভাবে বন্ধ করা যায়, আমাদের বরং সেই তরিকাই এখন বের করার সময় এসেছে। না হলে পুলিশ রাতবিরেতে লোকজনের পকেটে ইয়াবা ঢুকিয়ে দিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করবে অথবা মাদক মামলায় কোর্টে চালান করে দেবে। মাস শেষে যে জনগণের পয়সায় সে বেতন নিচ্ছে, সেই জনগণই তাদের ভয়ে তটস্থ থাকবে।

লেখক: সাংবাদিক

এসএএস

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
ছাত্রলীগের ‘অনুরোধে’ গ্রীষ্মকালীন ছুটি পেছালো রাবি প্রশাসন
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
সাজেকে ট্রাক খাদে পড়ে নিহত বেড়ে ৯
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
বার্সেলোনার সঙ্গে থাকছেন জাভি!
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
চার বছরেও পাল্টায়নি ম্যালেরিয়া পরিস্থিতি, প্রশ্ন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ