X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

সর্বনাশের ঘণ্টাধ্বনি

বিভুরঞ্জন সরকার
০৫ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:২১আপডেট : ০৫ নভেম্বর ২০১৭, ২৩:২৫

বিভুরঞ্জন সরকার লিখতে বসে বিষয় ঠিক করতে মাঝেমাঝে হিমশিম খেতে হয়। কোন বিষয় ছেড়ে কোনটা নিয়ে লিখব, তা বুঝে উঠতে পারি না। দুই-একবার এমনও মনে হয়, কী হয় এসব না লিখলে? গত প্রায় চার দশক ধরে কম তো লিখলাম না! আগে মনে হতো, লিখলে বোধহয় কিছু কাজ হয়। এখন আর তেমন মনে হয় না। এই যে এত এত গণমাধ্যমে এত এত বিষয়ে প্রতিদিন বিশেষজ্ঞ-অবিশেষজ্ঞ মিলে এত এত অভিমত দেওয়া হচ্ছে, তাতে পরিবর্তনটা কী হচ্ছে? ভালো কিছু কি কোথাও দেখা যাচ্ছে? মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ব্যয়। চালসহ প্রতিটি নিত্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। পেঁয়াজের দাম আকাশছোঁয়া। যারা স্বল্প ও নির্ধারিত আয়ের মানুষ, তারা কিভাবে সংসার চালাচ্ছেন, সে খবর আমরা কি রাখি? একশ্রেণির মানুষের হাতে অঢেল অর্থ-সম্পদ জমা হচ্ছে, তাদের জীবনে বিলাসিতার কোনও কমতি নেই। কিন্তু সংখ্যায় তারা অল্প। সমাজে আর্থিকবৈষম্য বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক বৈষম্যও বাড়ছে। চারদিকে কেমন একটি অস্থিরতার লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ক্ষমতার লড়াই সর্বগ্রাসী হয়ে উঠছে। সরকারবিরোধীরাই কেবল ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে তা নয়, সরকার সমর্থকদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে বেপরোয়া ভাব। কেউ আর বঞ্চিত থাকতে চায় না। যার যার পাওনা বুঝে নেওয়ার জন্য কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে যেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার সমর্থক শিক্ষকরাও এই ভয়ঙ্কর প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই। গত ২ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারপন্থী শিক্ষকরা হাতাহাতি-মারামারি করেছেন বলে পত্রিকায় খবর বের হয়েছে। সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সমর্থক ও তার বিরোধী পক্ষের ওই হাতাহাতির ঘটনায় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ও সিনেট সদস্য আ ক ম জামলউদ্দিন আহত হয়েছেন। দেশের একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষকরা তুচ্ছ কিংবা বড় কোনও কারণেও হাতাহাতি করতে পারেন, এট ভাবলেও তো কেমন গা গুলিয়ে ওঠে!

এতদিন সমালোচনা ছিল ছাত্রদের বিরুদ্ধে। তারা মারামারি করে, খুনোখুনি করে। রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করে। এক সময় বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন ছিল গৌরবের পতাকাবাহী। যখন বলা হয়, বাংলাদেশ হলো ছাত্র আন্দোলনের ফসল, তখন তা একেবারেই বাড়িয়ে বলা হয় না। আমাদের ভাষার লড়াই, গণতন্ত্রের লড়াই, স্বাধীনতার যুদ্ধ–কোনোটাই ছাত্র আন্দোলনকে বাদ দিয়ে হয়নি। ছাত্র আন্দোলন মানেই ছিল আদর্শের আন্দোলন। কিন্তু সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান ছাত্রসংগঠনগুলোকে রাজনৈতিক দলের লেজুড় বানিয়ে দেওয়ার পর থেকে ছাত্র আন্দোলনের উল্টো যাত্রা শুরু। ছাত্র আন্দোলনে পচন ধরেছে। ছাত্রদের কাছে এখন আর মানুষ ভালো কিছু আশা করে না। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, নেতাদের লেজুড়বৃত্তি, আধিপত্য বিস্তারের জন্য খুনোখুনিসহ নানা অপরাধমূলক তৎপরতায় জড়িয়ে বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছাত্র সংগঠনগুলো মানুষের কাছে নিন্দিত হচ্ছে। ছোট ছাত্র সংগঠনগুলো খাবি খাচ্ছে।

এখন দেখা যাচ্ছে, ক্ষুদ্রতায় পিছিয়ে নেই শিক্ষকরাও। মানুষ গড়ার কারিগর বলে যাদের সমীহ করা হয়, তারা এখন শুধু দলাদলি করছেন, তাই নয়, মারামারিও করছেন। এই শিক্ষকরা ছাত্রদের কী শেখাবেন? ছাত্ররা তাদের কাছে কী শিখবে? এক মত, এক আদর্শের শিক্ষক হয়েও কোনও মহৎ উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ঢাবি শিক্ষকরা হাতিহাতি করে খবর হলেন? এ বিষয়ে কিছু লিখতে, শিক্ষকদের সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে আমার তো কষ্ট হচ্ছে, লজ্জাবোধ হচ্ছে। কিন্তু যারা সত্যি সত্যি ঘটনাটি ঘটিয়েছেন, তারা কি একটুও মানসিকপীড়ন অনুভব করছেন? আমরা উন্নয়নের নামে, সমৃদ্ধি অর্জনের নামে কোন পতনের দিকে ধাবিত হচ্ছি, তা ভেবে দেখার সময়ও বোধহয় পার হয়ে যাচ্ছে। এই সর্বনাশা যাত্রা এখনই থামাতে হবে। না হলে ভবিষ্যৎ আমাদের মার্জনা করবে না। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা রাজনীতি করবেন, শিক্ষার্থীদের রাজনীতি সচেতন করে তুলবেন–এতে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু শিক্ষকরা যখন দলীয় রাজনীতির, ক্ষমতার রাজনীতির পাহারাদার কিংবা হাতিয়ার হয়ে পড়েন, তখন তা সমর্থন করা যায় না। আলোকিত মানুষ গড়া যাদের ব্রত হওয়ার কথা, তারা কেন বৃত্তবন্দি হয়ে পড়বেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য যখন একটি রাজনৈতিক দলের একটি উপ কমিটির সদস্য পদ গ্রহণ করেন, তখন তিনি গৌরববোধ করলেও বিবেকবান যেকোনও মানুষই লজ্জাবোধ না করে পারেন না। দলের খাতায় নাম লেখালে দলের খারাপ বা ভুল পদক্ষেপেও বিরোধিতা করা যায় না। কারণ সেটা দলীয় শৃঙ্খলাপরিপন্থী হয়। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো তো পদে পদে ভুল করে, মিথ্যাচার করে। একজন উপাচার্যের হওয়ার কথা বিবেকের কণ্ঠস্বর। তিনি যখন দলীয় রাজনীতির পঙ্কে কণ্ঠ মেলান, তখন তার প্রতি সর্বজনীন শ্রদ্ধা থাকে কি?

আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কত রকম সমস্যা তাদের। তাদের শিক্ষাজীবন নিষ্কণ্কট করার মুখ্য আধিকারিক  উপাচার্য। কিন্ত কয়েকজন উপাচার্য যেভাবে নিয়মিত টেলিভিশন টকশোতে অংশ নেন কিংবা সংবাদপত্রে কলাম লিখছেন,  তাতে প্রশ্ন জাগে, এত সময় তারা পান কিভাবে? তাদের আবার রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশেও প্রথম সারিতে বসে থাকতে দেখা যায়। উপাচার্য ও ছাত্র যখন একসঙ্গেই দলীয় কর্মী, তখন তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটা কেমন দাঁড়ায়? ছাত্র  ও শিক্ষক–উভয়কে ক্যাডার হিসেবে পেয়ে রাজনৈতিক নেতারা হয়তো খুশিতে বাগবাগ। কিন্তু যারা একটু ভাবনাচিন্তা করেন, যাদের একটু বিবেক-বিবেচনাবোধ আছে, তারা কি এসবে খুশি হচ্ছেন?

রাজনীতিবিদদের কাছে মানুষের খুব বেশি চাওয়া-পাওয়ার নেই। রাজনীতিতে শিক্ষিত মেধাবী মানুষ আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও যদি যুক্তি-বুদ্ধির চর্চা পরিহার করে রাজনীতির নামে পেশিশক্তির চর্চা শরু করেন, তাহলে মানুষ ভরসা করবে কার ওপর? যাদের কাছে দায়িত্বশীলতার প্রত্যাশা বেশি তারা আর আমাদের হতাশ করবেন না–এর চেয়ে আর বেশি বলার কিছু নেই। 

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/ এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
উত্তরাসহ দেশের চার পাসপোর্ট অফিসে দুদকের অভিযান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
রনির ব্যাটে প্রাইম ব্যাংককে হারালো মোহামেডান
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
কুড়িগ্রামে বৃষ্টির জন্য নামাজ, এপ্রিলে সম্ভাবনা নেই বললো আবহাওয়া বিভাগ
‘উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে’
‘উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় বাস্তুচ্যুত জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ