X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনীতি-দুর্নীতি

আনিস আলমগীর
০৭ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:১০আপডেট : ০৭ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:৪৪

আনিস আলমগীর দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে দুর্নীতি আর রাজনীতি এক ও অভিন্ন সত্তায় রুপ নিয়েছে। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ক্ষমতাসীন হয়ে প্রথম পাঁচ বছর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযান চালিয়েছিলেন। তিনি ১৯তম কংগ্রেসে বলেছেন, দুর্নীতির কারণে কমিউনিস্ট পার্টির গ্রহণযোগ্যতা সাধারণ মানুষের কাছে খাটো হয়ে পড়েছিলো। এখন চীনে ১৩ লাখ কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী জেলে রয়েছে। যদি তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে এ অভিযান না চালাতেন তবে কমিউনিস্ট পার্টি এবং নেতাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সাধারণ মানুষের মাঝে ফিরে আসতো না।
এখনও যে চীনের সমাজ পরিপূর্ণভাবে দুর্নীতি মুক্ত হয়েছে তা নয়। শি জিনপিং ১৯তম কংগ্রেসে বলেছেন, ‘দলের উচিত নিজেদের শাসন নিজেরাই পরিচালনা করা।’ শি বলেছেন, ঘটনা ধরে ধরে দুর্নীতি বন্ধের চেষ্টা করলে দুর্নীতি বন্ধ হবে না। তিনি রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার কাঠামোর পরিবর্তনের ওপর জোর দিয়েছেন।
ভারতেও একই অবস্থা। বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের ছেলে জয় শাহ ৫০ হাজার টাকা মূলধন নিয়ে ব্যবসা আরম্ভ করেছিলো। দুই বছরে তার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৮০ কোটি টাকা। প্রত্যেক দেশে দুর্নীতির লাগাম ধরে টানা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির মামলা পরিচালনার জন্য যেন পৃথক একটা আদালত গঠন করা হয়– এটি চেয়ে গত ৩০ অক্টোবর ভারতের নির্বাচন কমিশন ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করেছে। আর দুর্নীতি মামলায় দুই বছরের অধিক কাউকে যদি আদালত জেল দিয়ে থাকে তবে তাকে যেন সারা জীবনের জন্য নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়, তাও চাওয়া হয়েছে। ভারতে এখনও অযোগ্য ঘোষণার আইন রয়েছে, তবে তা হচ্ছে যত বছর জেল হয় তার সঙ্গে ৬ বছর যোগ করলে যোগফল যত বছর হবে ঠিক তত বছরের জন্য অযোগ্য।

১৯৯৬ সালে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার বিরুদ্ধে বিজেপি নেতা সুব্রমনিয়াম স্বামী দুর্নীতির মামলা করেছিলেন। আঠার বছর বিচার প্রক্রিয়া চলার পর ২০১৪ সালে মামলার রায়ে তিনি ১০ বছরের জন্য নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষিত হন। আর এই ১৮ বছরের মধ্যে তিনি দু’বার মুখ্যমন্ত্রী হন। দুর্নীতি মামলার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে দু’বার তিনি মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন।

বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালু প্রসাদ যাদব পশুখাদ্য মামলার আসামি ছিলেন। পশুখাদ্যের ১২০০ কোটি টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন এ কথা প্রমাণিত হওয়ার পর তিনিও ১০ বছরের জন্য অযোগ্য হয়েছেন। অথচ মামলা বিচারাধীন থাকার সময় তিনি একবার আর তার স্ত্রী রাবরি দেবী একবার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন।

ভারতে এখন মনে হয় দুর্নীতি সংস্কৃতি হয়ে গেছে। সাধারণ মানুষ মনে হয় দুর্নীতিকে আর অপরাধ মনে করছে না। না হলে জয়ললিতার মৃত্যুতে ১৭ জন মানুষ আত্মাহুতি দেয় কিভাবে? হরিয়ানায় তিন ‘লাল’ মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। দেবী লাল, বংশী লাল আর ভজন লাল। তিন লালই ছিলেন দুর্নীতির সম্রাট। অথচ তারাই ঘুরে ফিরে মুখ্যমন্ত্রী হতেন।

ভারতের রাজনীতিতে এখন সাধু সন্ন্যাসীদের উত্থান হয়েছে। সংঘ পরিবার এখন রাজনীতির চালিকা শক্তি। সাধুদেরও চরিত্র বলতে এখন কিছু নেই। ক’দিন আগে গুরমিত রাম রহিম সিং নামের এক সাধুর কথা আমরা জেনেছি। নৈতিক চরিত্র বলতে লেশমাত্র নেই। নিজের পালিত কন্যার সঙ্গেও দৈহিক মিলনের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

প্রায় সাধু আবার চিরকুমার। অনেক ধর্মে চিরকুমার থাকার প্রথা রয়েছে। আকাঙ্ক্ষাকে শাসনের মাঝে রাখার চেষ্টা করাই উত্তম। চিরকুমার প্রথাটার মাঝে মনে হয় কিছুটা ভণ্ডামিও জড়িত। মহামতি গৌতম বুদ্ধের জীবনকালে যখন তিনি দেখলেন যে সংঘের মাঝে ভিক্ষুদের ব্যাপক নৈতিক স্খলন হয়েছে তখন তিনি অজাতশশ্রু বালক সন্ন্যাসীদের জন্য বড়দের থেকে পৃথক শয্যার ব্যবস্থা করলেন। বুদ্ধের এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে তখন নয় শ’ বয়স্ক ভিক্ষু বুদ্ধের সহচার্য ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন।

এখন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন সাধু আদিত্যনাথ। তিনি আগে গোরক্ষপুর থেকে লোকসভার সদস্য ছিলেন। নারী কেলেঙ্কারির বহু অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। এক সময়ে তিনি রাজ্যসভারও সদস্য ছিলেন। রাজ্যসভার এক তহবিল তছরূপ করেছিলেন আর সে অভিযোগে তার সদস্যপদও খারিজ হয়েছিলো। সংসদীয় কার্যক্রমের পর তার বিরুদ্ধে কিন্তু কোনও ফৌজদারি মামলা হয়নি। সম্ভবতো রাজ্যসভা একই ব্যক্তির দু’বার সাজার পক্ষে ছিলে না।

পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের প্রধানমন্ত্রীত্ব গেছে দুর্নীতির কারণে। পানামা পেপারস্-এ তার সম্পত্তির যে বিবরণী প্রকাশিত হয়েছিলো, সুপ্রিম কোর্ট দেখেছেন শরীফ নমিনেশন পেপারের সঙ্গে যে সম্পদ বিবরণী জমা দিয়েছিলেন তাতে তা উল্লেখ নেই। উল্লেখ করেননি বলে সুপ্রিম কোর্ট তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে তার জাতীয় সংসদের সদস্যপদ খারিজ করে দেন। তার ফলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে যেতে বাধ্য হন। বাকি ফৌজদারি অপরাধ বিষয়ে বিচার শেষ করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট অ্যাকাউন্টিবিলিটি কোর্টে মামলার নথিপত্র পাঠিয়ে মামলা নিষ্পত্তি করার হুকুম দেন। বাংলাদেশে বা ভারতে অ্যাকাউন্টিবিলিটি কোর্টের কোনও ব্যবস্থা নেই।

বাংলাদেশে আমরা কখনো কোনও অভিযোগের শাস্তির কারণে কোনও রাজনীতিবিদকে নির্বাচন থেকে সরে থাকতে দেখিনি। কিন্তু নির্বাচনে ফৌজদারী মামলায় অভিযুক্ত হলে নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ার বিধানসহ আইন রয়েছে। আগে ট্রায়াল কোর্টে শাস্তি হলেও সপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার বিধান ছিল কিন্তু ২০০১ সালে বেগম জিয়ার সরকার আইন পরিবর্তন করেছেন। এখন ট্রায়াল কোর্টে শাস্তি হলেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার আর পাবে না। এখন পর্যন্ত তারেক জিয়ার মানি লন্ডারিং মামলার কারণে তিনি নির্বাচনে আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। কারণ উক্ত মামলায় তার সাড়ে সাত বছরের কারাদণ্ড হয়েছে।

খালেদা জিয়ার নামে জিয়া অরফানেইজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির দু’টি মামলা বিচারাধীন আছে। মামলা দু’টিতে তার শাস্তি হলে তিনিও হয়ত নির্বাচনের অযোগ্য হবেন। বিএনপির আরও অনেক নেতার বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। সব নেতার মামলাগুলোর রায় হলে বুঝা যাবে বিএনপির কত নেতা নির্বাচনে অযোগ্য হলেন।

বাংলাদেশেও রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য পৃথক কোর্ট স্থাপন করা প্রয়োজন এবং দুর্নীতির জন্য একবার দণ্ডিত হলে তাকে আজীবনের জন্য নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা দরকার। তৃতীয় বিশ্বে যে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা চালু রয়েছে তার ত্রুটি বিচ্যুতির সীমা নেই। তৃতীয় বিশ্বে যে অপরাধী সে দণ্ডিত নয়। যে দণ্ডিত সে অপরাধী নয়। সমানে অসমানে সবাই সমান। এখানে ঔদ্ধত্যকে বলে আভিজাত্য, অরাজকতাকে বলে স্বাধীনতা আর মূর্খতাকে বলে বিক্রম। সুতরাং এখানে রাষ্ট্র পরিচালনা করা খুবই কঠিন। এমন সমাজে কঠোর আইনের শাসন ছাড়া বিকল্প অন্য কোনও পথ নেই।

সুতরাং এমন সমাজে আইনের সার্বভৌমত্বের প্রতি অনুগত হয়ে কঠোরভাবে আইন প্রয়োগ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে। এমন নীতিহীন দায়িত্বহীন সমাজে ত্রুটির ফাঁকগুলোকে কঠোর আইন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে আর কঠোর আইনের শাসন দিয়ে সমাজকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। যে সমাজে দণ্ডিত অপরাধীর মৃত্যুতে ১৭ জন লোক আত্মাহুতি দেয় সে সমাজ সুস্থ এই কথা বলা যায় না।

চীনের মতো নির্বিচারে ১৩ লক্ষ লোককে জেলে দেওয়া গণতান্ত্রিক সমাজে সম্ভব নয়। চীনে সম্ভব হয়েছে কমিউনিস্ট ব্যবস্থার নামে সেখানে একনায়কতন্ত্র চালু রয়েছে বলে। এই কারণে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় আইনের শাসনের প্রাধান্য দিয়ে আইনের সার্বভৌম প্রয়োগে আপোসহীন হতে হবে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
বাংলাদেশের স্পিন বিভাগে পার্থক্য তৈরি করতে চান মুশতাক
‘মুম্বাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় খেললে ব্রেইন ফেটে যাবে’
‘মুম্বাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ সময় খেললে ব্রেইন ফেটে যাবে’
৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুক্রবার: যেসব নির্দেশনা দিলো পিএসসি
৪৬তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুক্রবার: যেসব নির্দেশনা দিলো পিএসসি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ