X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

নির্বাচনি সমঝোতা কী জিনিস?

আমীন আল রশীদ
১৬ নভেম্বর ২০১৭, ১৩:৫৮আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:০০

আমীন আল রশীদ দেশের রাজনীতিতে সমঝোতার সবচেয়ে বড় উদাহারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল সংবিধান সংশোধন করে এই বিধান যুক্ত করার জন্য–যেটি ছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের দাবি। রাজনীতির নির্মম পরিহাস, আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে সেই বিধান সংবিধান থেকে বাতিল হয়েছে আওয়ামী লীগের আমলেই।
যে বিএনপি একসময় নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের বিরোধী ছিল এবং ‘পাগল ও শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ নয়’ বলে মন্তব্য করেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া, তারাই কিন্তু এখন নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে সোচ্চার। যদিও এখন তারা সরাসরি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসে বলছে, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার। আরও পরিষ্কার করে বললে, তারা চাচ্ছে নির্বাচনকালে এমন একটি সরকার থাকবে, শেখ হাসিনা যার প্রধান থাকবেন না। সবশেষ ১২ নভেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায়ও খালেদা জিয়া বলেছেন, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন নয়।
মাস কয়েক আগে বাংলা ট্রিবিউনেই আমি লিখেছিলাম, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার মানে ‘অসহায় সরকার’। অর্থাৎ সরকার প্রধান হিসেবে যিনিই থাকুন না কেন, নির্বাচনকালীন সময় বলতে যে তিন মাসকে বোঝায়, সেই সময়ে নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক এবং আইনিভাবে এতটাই শক্তিশালী ও সার্বভৌম রাখা দরকার যে, ওই তিন মাসে নির্বাচন কমিশনের হুকুম ছাড়া ‘গাছের পাতাও নড়বে না’। সরকার একেবারেই অসহায় থাকবে। কেবল রুটিন দায়িত্ব পালন করবে। সরকারের মন্ত্রীরাও ওই তিন মাস কোনও ধরনের রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে নির্বাচনি প্রচার চালাবেন না।

দ্বিতীয়ত, কমিশনে এমন লোকদের বসাতে হবে, যারা কোনও মত ও পথের প্রতি অনুরক্ত কিংবা বিরক্ত হবেন না। তারা শুধু মাঠে রেফারির দায়িত্ব পালন করবেন। প্রয়োজনে লাল কার্ড হলুদ কার্ড দেখাবেন। তৃতীয়ত, এই গুরুদায়িত্ব পালনে সক্ষম এমন নির্লোভ, সাহসী এবং সৎ মানুষদের খুঁজে বের করে কমিশনে বসাতে হবে। কিন্তু কার কী রাজনৈতিক বিশ্বাস, সরকারের প্রতি তিনি কতটা অনুগত থাকতে পারবেন, কোন সরকারের আমলে তিনি সচিব হয়েছিলেন কিংবা কার আমলে ওএসডি ছিলেন–এসব বিবেচনায় নিয়ে নিরপেক্ষ লোক যেমন নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব নয়, তেমনি সত্যিকার অর্থেই দল নিরপেক্ষ, সৎ ও সাহসী লোক ছাড়া গঠিত নির্বাচন কমিশনের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনও সম্ভব নয়। তাতে আইনি কাঠামো যতই শক্তিশালী হোক। নির্বাচন কমিশনকে যতই স্বাধীন বলা হোক।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন কতটা নিরপেক্ষ, এখানে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাঁচজন মাননীয় কমিশনার (সিইসিসহ) সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কতটা আন্তরিক, সে বিষয়ে তর্কে না গিয়ে আমরা বরং দেখার চেষ্টা করি, ইদানীং রাজনীতিতে যে সমঝোতার কথা বলা হচ্ছে, তার স্বরূপটা আসলে কেমন কিংবা রাজনীতিতে ‘নির্বাচনি সমঝোতা’ বলে আদৌ কোনও শব্দ আছে কিনা?

সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনায় বলেছেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকার সমঝোতায় না এলে দেশে গণবিস্ফোরণ হবে।’ প্রশ্ন হলো ‘সমঝোতা’ বলতে তারা কী বোঝাচ্ছেন? বিএনপির জন্য সবচেয়ে ভালো সমঝোতা হলো, আওয়ামী লীগ বা সরকার এমন একটি অবস্থা তৈরি করবে, যাতে বিএনপি আগামীতে ক্ষমতায় আসে। আওয়ামী লীগ কি এতই বোকা যে তারা এরকম একটি সমঝোতা করবে? বিএনপি ক্ষমতায় থাকলে কি তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে এরকম সমঝোতা করত?

সমঝোতার মানে কী? প্রধান দুটি দল পরস্পরের প্রতি এতটাই বীতশ্রদ্ধ যে, তারা সব সময়ই একপক্ষ অপর পক্ষের অমঙ্গল কামনায় ব্যস্ত থাকে। প্রতিপক্ষকে কিভাবে কত নিত্য নতুন কায়দায় গর্তে ফেলা যায়, সেই চিন্তায় মশগুল থাকে। সুতরাং সমঝোতা হবে কী করে? কী নিয়ে সমঝোতা হবে?

বিএনপির দাবি মেনে যদি সরকার নির্বাচনকালীন এমন একটি সহায়ক সরকার গঠন করতে চায় যেখানে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা থাকবেন না, তাহলে সংবিধান পরিবর্তন করতে হবে। কারণ বিদ্যমান সংবিধানের আলোকে শেখ হাসিনাকে বাদ দিয়ে সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। আর বিএনপিকে সুবিধা দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সংবিধানে এমন একটি পরিবর্তন আনবে, তা কোনও বোকাও বিশ্বাস করে না।

তাহলে বিএনপি সমঝোতা বলতে কী বোঝাচ্ছে? তারা কি এটা মনে করে যে, ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সারা দেশে যে গণআন্দোলন তৈরি হয়েছিল সেরকম একটি পরিস্থিতি তৈরি করবে? বিএনপির আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বা সবশেষ খালেদা জিয়ার বক্তব্যে সেরকম কোনও ইঙ্গিত নেই। বরং তারা আপাতত অহিংস পথেই হাঁটছে বলে মনে হয় এবং এটি অবশ্যই দেশের জন্য মঙ্গল। ২০১৪ এর নির্বাচনের আগে যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তাতে বিএনপি-আওয়ামী লীগের যা ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে সাধারণ মানুষের, দেশের অর্থনীতির। সুতরাং দাবি আদায়ের নামে কোনও ধরনের সহিংসতা বা পেট্রোলবোমার পুনরাবৃত্তি দেশের মানুষ দেখতে চায় না।

সুতরাং সমঝোতা হবে কোন পয়েন্টে? বিএনপি নিজেও জানে যে, আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলে তারা নিজেরাই অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। মামলায় জর্জরিত হয়ে দলের বহু নেতাকর্মীর ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ হয়ে গেছে। আগামীতে বিএনপি যদি নির্বাচনে না আসে এবং অন্তত বিরোধী দলেও না থাকে, তাহলে বিএনপি মাঠ পর্যায়ে কোনও কর্মী খুঁজে পাবে না। কারণ নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে তারা দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগ দেবে। গত কয়েক বছরে এই প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে।

এ মুহূর্তে কয়েকটি বিষয়ে বিএনপির সমঝোতার সুযোগ আছে বলে মনে হয়। তবে সেটিও পুরোপুরি নির্ভর করবে সরকারের ওপর। যেমন বিএনপি বারবারই বলছে যে, নির্বাচনে সেনা মোতায়েন করতে হবে, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন বা ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না ইত্যাদি।  বিএনপি কি এটা বিশ্বাস করে যে, সেনাবাহিনী মাঠে থাকলেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে? সেনাবাহিনী কি কেন্দ্রে কেন্দ্রে গিয়ে বসে থাকবে? তারা কি ভোট গণনা করবে? তারা কি ভোটারদের নিরাপত্তার জন্য তাদের বাড়ি থেকে নিয়ে আসবে এবং ভোট শেষে বাড়ি দিয়ে আসবে? তা নিশ্চয়ই নয়। বরং বাস্তবতা হলো, ভোট কেমন হবে, তার পুরোটাই নির্ভর করবে মাঠপ্রশাসনের ওপর। অর্থাৎ যারা নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত থাকবেন।

বিএনপি ইভিএম-এর বিরোধিতা কেন করে জানি না। অথচ ভোটব্যবস্থা সুষ্ঠু ও নির্ঝঞ্ঝাট করতেই এই প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছে। বিএনপি কি মনে করে যে, এই মেশিনে কারচুপি করে আওয়ামী লীগ ভোটের ফল বদলে দেবে? তাহলে আর আমরা প্রযুক্তির কথা কেন বলি? মোবাইল ফোন বাদ দিয়ে হাতে চিঠি লেখাই ভালো।

বিএনপির একটি প্রস্তাব সংসদ ভেঙে দিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন করা। এটি সরকারের জন্য খুব কঠিন শর্ত নয়। ফলে এখানে সমঝোতা হতে পারে। দলীয় আনুগত্যে কাজ করেছেন এমন বিতর্কিত কর্মকর্তাদের নির্বাচনি কোনও দায়িত্ব প্রদান করা যাবে না––বিএনপির এই দাবিতে সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ বিএনপি যাকে বিতর্কিত বলছে, আওয়ামী লীগ তাকে বলবে বিশ্বস্ত।

নির্বাচনের ছয় মাস আগে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটি বাতিল করে স্থানীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে আনারও দাবি আছে বিএনপির। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে জাতীয় নির্বাচনের কী সম্পর্ক তা ঠিক পরিষ্কার নয়। তবে এটি যেহেতু খুব ঝুঁকিপূর্ণ কিছু নয়, সুতরাং সরকার চাইলে বিএনপির এই দাবি মেনে নিতে পারে। অর্থাৎ এখানে সমঝোতা হতে পারে।

ভোটের সময় গণমাধ্যম যাতে চাপমুক্ত থেকে সংবাদ পরিবেশন করতে পারে, সেটির নিশ্চয়তা এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিলের দাবি আছে বিএনপির। আশা করি এই ইস্যুতে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়। সুতরাং এটি কোনও সমঝোতার বিষয় নয়। বরং এটি দেশের মানুষেরই প্রত্যাশা।

তবে নির্বাচন নিয়ে প্রধান দুই দলের মধ্যে আসলেই সমঝোতা হবে কি হবে না, তার চেয়ে বড় বিষয় এবং সবচেয়ে যেটি ইতিবাচক বলে মনে হচ্ছে, তা হলো বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত। মওদুদ আহমদের ভাষায়, ‘বিএনপি অংশ না নিলে আগামীতে দেশে নির্বাচন হবে না।’ তাই যে কোনও প্রতিকূল অবস্থায় তারা নির্বাচনে অংশ নেবে। তিনি অবশ্য এও বলেছেন যে, ভোটের আগে তারা এমন কর্মসূচি দেবেন, সেখানে গণজোয়ার দেখে সরকার সমঝোতায় আসতে বাধ্য হবে। যদিও বিএনপি কী কর্মসূচি দেবে বা দিতে পারবেন, সেটি সময়ই বলে দেবে। কিন্তু এখানে বিএনপির এই ইঙ্গিতটা ইতিবাচক যে, তারা দাবি মেনে না নিলে ভোট ঠেকানো হবে কিংবা এই দাবি না মানলে দেশে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না––এমন কোনও হুঁশিয়ারি দেয়নি। এটিই আমাদের আশাবাদী করে। কেননা নির্দিষ্ট সময়ে ভোট না হলে দেশে কারা ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং ক্ষমতায় গিয়ে তারা কী করে, সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা দেশের মানুষের একাধিকবার হয়েছে। সেই বেলতলায় ন্যাড়া আর যেতে চায় না। সুতরাং মেয়াদান্তে ভোটই শ্রেয় এবং গণতন্ত্রহীনতার চেয়ে অল্প গণতন্ত্রও ভালো। গালাগালি যতই দিই না কেন, দিন শেষে রাজনীতিবিদদের হাতেই দেশটা নিরাপদ। অন্য কারও হাতে নয়।  

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘রানা প্লাজার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ করতে হবে’
‘রানা প্লাজার দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ করতে হবে’
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাকি দুই টি-টোয়েন্টিতে অনিশ্চিত রিজওয়ান
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বাকি দুই টি-টোয়েন্টিতে অনিশ্চিত রিজওয়ান
প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে বিএনপি নেতা বললেন ‘রিজভী ভাই আমাকে ফোন করেছিলেন’
প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে বিএনপি নেতা বললেন ‘রিজভী ভাই আমাকে ফোন করেছিলেন’
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
‘যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করছে সামাজিক কুসংস্কার’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ