X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

গণতান্ত্রিক ভালোবাসা

শান্তনু চৌধুরী
১৬ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:১৩আপডেট : ১৬ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:১৫

শান্তনু চৌধুরী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত বদলে যাচ্ছে পরিবেশ পরিস্থিতি। যে মায়ের কোল হওয়ার কথা সন্তানের নিরাপদ আশ্রয়, সেই মা-ই হয়ে উঠছে ঘাতক। যে শিশুর অন্তরে তার পিতার ঘুমিয়ে থাকার কথা। সেই বাবা হয়ে উঠছে সন্তান হত্যা মামলার প্রধান আসামি। এমন নানা বিকৃত ঘটনা ঘটছে সমাজে। প্রতিকার নেই, প্রতিবন্ধকতা নেই। অবাধে বিচরণ এসব মানুষের। এরাই নষ্ট করছে সমাজকে। নষ্ট করে দিচ্ছে বেঁচে থাকার মানে। এতে করে ভেঙে পড়ছে পারিবারিক বন্ধন। যে মানুষটি প্রিয় হয়ে পাশে থাকার কথা, যে মানুষটি হয়ে ওঠার কথা বিপদে আপদে স্বান্তনার। সেই মানুষটি হয়ে উঠছেন হন্তারক। প্রিয় মানুষরাই নির্মমভাবে হত্যা করছেন স্বজনদের। তাহলে ভরসা কোথায়। স্বজনের জন্য বিচার চাইবে স্বজন? ঘটনার আড়ালে ঘটনা চাপা পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু নিয়ত নাড়া দিয়ে যাচ্ছে বিবেককে।
রাজধানীর কাকরাইলের নিজেদের বাড়িতে খুন হন ধনাঢ্য পরিবারের গৃহিণী ও তার স্কুল পড়ুয়া ছেলে। এর অল্প সময় পরই বাড্ডার ঘিঞ্জি একটি বাড়ির এক কামরার সংসারে গাড়িচালক বাবা আর তার তৃতীয় শ্রেণি পড়ুয়া মেয়ের লাশ পাওয়া যায়। দুটো পরিবারের বিত্তবৈভব আর সামাজিক মর্যাদার ব্যাপক পার্থক্য থাকলেও সংকটটা একই ধরনের। পুলিশ বলেছে, দুটো ঘটনার মূলেই রয়েছে পারিবারিক সংকট। এরপর মুন্সিগঞ্জেও নিজ বাড়ি থেকে উদ্ধার হয় বাবা-মা ও সন্তানের লাশ। সেখানেও পারিবারিক কলহের জেরে তারা আত্মহত্যা করে বলে ধারণা পুলিশের। এ ধরনের ঘটনা প্রায় ঘটছে। এর কারণ সম্ভবত মানুষ এখন আর নির্দিষ্ট কোনও সম্পর্কের সীমারেখায় থাকতে চাইছে না। পুরোপুরি কমিটেড কোনও সম্পর্ক যেন ঠিকাতে চাইছে না। সকলের জীবনে এমন একটা না একটা রিলেশন সৃষ্টি হচ্ছে যেখানে পুরোপুরি কমিট করা সম্ভব হয় না। সম্পর্কটা কোনও আকার নিতে পারে না সমাজ ও পরিবারের কথা চিন্তা করে। আর যেই পরিণতির কথা চিন্তা করা হচ্ছে অনেক সময় সেটা স্বাভাবিক পরিণতির দিকে না গিয়ে হয়ে উঠছে রক্তাক্ত হন্তারকের পরিণতি।

একটি সম্পর্ক সৃষ্টি করতে গিয়ে আরেকটি সম্পর্ককে খুন হতে হচ্ছে নির্মমভাবে। ঠিক কী হয় একটা পরকীয়ায়? বেলজিয়ামের বিখ্যাত লেখক ও থেরাপিস্ট এসথার পেরেলের মতে, তথাকথিত অবৈধ সম্পর্ক একসঙ্গে তিনটে জিনিস নিয়ে আসে। যার মূলে থাকে অবশ্যই রগরগে সম্পর্কের ছোঁয়া। তার সঙ্গে মিশে থাকে মানসিক অনুভব আর শরীরী আহ্বানের রসায়ন। এই রসায়নটাই আসল। কবি জয় গোস্বামী বলেন, ‘চুম্বনের স্বপ্ন দেখে ভেঙে যাওয়া ঘুম সহস্র সঙ্গমের সুখকেও তুচ্ছ করে দিতে পারে।’ বাঙালির পরকীয়া কি নতুন। মোটেই না। কিন্তু কালে কালে সেটি রূপ বদলে, ভোল পাল্টে হয়ে উঠেছে হিংসাত্মক। একটা সময় ছিল বারবণিতা, এক সময় জমিদারদের রক্ষিতা। এক সময় জমিদার-বঙ্গে বারমহলে যারা অপেক্ষা করত রাতের জন্য তারাই আজ ঢুকে পড়েছে অন্দরমহলে। কার ঘরে কে রাত কাটাচ্ছে, দ্রুত সময় চলে যাওয়ার এই সময়ে সময় কোথায় খোঁজ রাখার। যার তেমন কেউ নেই তারও নিদেনপক্ষে রাত কাটে ঘুমে আধো-ঘুমে, স্মার্টফোনে, ল্যাপটপে, ডেস্কটপে। আর দিনের বেলায় তার ক্লান্ত শরীর। কাজে কর্মে মনোযোগ নেই। বিল ক্লিনটনের পরকীয়া, প্রিন্স চার্লস বা প্রিন্সেস ডায়ানা, আইনস্টাইন থেকে শুরু করে হাল আমলের তারকাদের পরকীয়ার গল্প আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি। ধারাবাহিক নাটকগুলোতেও এখন পরকীয়ার ছড়াছড়ি। বিশেষ করে পাশের দেশের চ্যানেলগুলো আমাদের অন্দরে ঢুকে পড়ার পর থেকে। অনেকেই গালমন্দ করি। তারপরও দর্শক আকর্ষণ কমছে না। একটা সময় বাড়ির কোনও আত্মীয়ের সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়তেন কেউ কেউ। এর বাইরে বড়জোর পাশের বাড়ির কেউ বা অফিসের সহকর্মী। এখন আর সীমাবদ্ধতা নেই। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে দ্রুত। ফেসবুক, ভাইবার, হোয়াটস অ্যাপসহ যোগাযোগের নানা মাধ্যমের কারণে অনেক অচেনা, অপরিচিত জন হয়ে ওঠছেন কাছের মানুষ। যার ফলে বিপদ চলে আসছে অন্তর্জালের মাধ্যমেও। আগে ইন্টারনেট থাকলে ভয় করা হতো ভাইরাস আসবে। নষ্ট করে দেবে সবকিছু। কিন্তু এখন অবিশ্বাসের ভাইরাস এসে ভর করছে তারে তারে, ইথারে ইথারে। কেন এমন হচ্ছে? প্রতিকার কি আছে? আগে ছিল এমন। যাকে ভালোবেসেছিলে, যাকে বিয়ে করেছিলে তার সঙ্গে মৃত্যুকাল পর্যন্ত সংসার করা হতো। এখন বিশ্ব গণতন্ত্রায়নের যুগে ভালোবাসাও গণতান্ত্রিক হয়েছে। ‘গণতান্ত্রিক ভালোবাসা’ আসার পরে মানুষের পছন্দটা বেড়ে গেছে। যে যারা ইচ্ছেমতো ভালোবাসাটাকে দেখছে।

আদিনাথ বসাকের বাল্যশিক্ষায় ছিল, ‘গুরুজনে কর নতি’। এখন সেটা নেই বললেই চলে। পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে কুটচাল ঢুকে পড়ছে। যৌথ পরিবার ভেঙে ভেঙে তৈরি হচ্ছে ছোট ছোট পরিবার। মানুষ সম্পর্কগুলোকে পরোয়া করছে না। সামাজিকভাবে ন্যায় বিচার না পাওয়ায় বাড়ছে হতাশা। অস্থিরতা। ভুল করে ক্ষমা চাওয়া, সরি বলা বা থ্যাংক ইউ বলার মতো ম্যানার্সও কমে যাচ্ছে। মানুষের জীবন যাপনের ধরন ও দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে যাচ্ছে। কিন্তু এই যে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাচ্ছে বলছি সেটাকে যদি ভালোদিকে ধাবিত করা যায় তাহলে ওই যে কথায় বলি ‘দৃষ্টিভঙ্গি বদলাও, জীবন বদলে যাবে।’ সেটি সত্যিকার অর্থেই সম্ভব। তিক্ততায় মোড়ানো নিষিদ্ধ সুখ সবসময় উপভোগ্য হয় না। কিন্তু এটাও ঠিক মানুষ যখন চরম হতাশায় পৌঁছায় তখন যুক্তি হারায়, আবেগে ভাসে। আমাদের সমাজ কাঠামোকে তৈরি করতে হবে সম্পর্কের ওপর মূল্যায়ন করে। সেটা তৈরি করতে হবে পরিবার থেকে। কেন বলছি কথাটা। এদেশে সামাজিক নিরাপত্তা না থাকায় মানুষ অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার পেছনে ছুটছে। যে পরিবারের জন্য, ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য মানুষ অর্থ কামাই করছে সেটিই আবার তাকে মোহাবিষ্ট করে ফেলছে। এতে করে যেটি হচ্ছে চক্র থেকে বের হতে পারছে না। সে কারণে সমাজের সর্বস্তরে মানুষের মূল্যায়নটাও জরুরি। যুক্তরাজ্যের ড্রাই-ক্লিনিং ও লন্ড্রি সার্ভিস জিপজেটের তথ্য বিশ্লেষণ করে সিএনএন ট্রাভেল সম্প্রতি যে তালিকা প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকা বিভিন্ন শহরের মধ্যে বেশি মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী ১০ শহরের মধ্যে সপ্তম। যেসব সূচকের কারণে চাপ কম ও বেশি ধরা হয়েছে সেগুলো হলো, শহরের জনঘনত্ব, পরিবহন ব্যবস্থা, যানজটের মাত্রা, পরিবেশদূষণ, সবুজের সমারোহ, নাগরিকদের আর্থিক অবস্থান, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের অবস্থা, কর্মঘণ্টার প্রয়োগ। তাদের মতে, আমরা যে নগরে বাস করছি, তার ওপর নির্ভর করছে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য কতটুকু ভালো, কতটুকু খারাপ। সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে মানসিকভাবে এই শহরে আমরা সুস্থ নেই। এই যে শহরের সুস্থতার প্রভাব পড়ছে পারিবারিক জীবনে। তৈরি হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতাও। তাই এই অস্থিরতা কমানোর দিকেই মনযোগ দিতে হবে বেশি। সেটি প্রথমত করতে হবে যারা নগর নিয়ে ভাবেন, যাদের হাতে দায়িত্ব এই নগরকে সুন্দর করার। মানুষ যদি একটি নিরাপদ সুন্দর যাপিত জীবনের সন্ধান পান তাহলে সে কখনও হন্তারক হতে পারে না। সে নান্দনিক হতে বাধ্য। আর নান্দনিক হতে না পারলে নিজের আনন্দসময়গুলো যেমন সে নষ্ট করবে তেমনি পরিবেশকেও করে তুলবে দুর্বিষহ।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো ইউপি সদস্যের
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো ইউপি সদস্যের
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ