X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

‘ফেক নিউজ’ নিউজ নয়

প্রভাষ আমিন
২০ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:১৯আপডেট : ২০ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:৫৪

প্রভাষ আমিন উৎসব আমাকে সবসময়ই টানে। গ্রামের মেলা যেমন, শহুরে করপোরেট উৎসব তেমনি। ফোক ফেস্ট, ক্ল্যাসিক্যাল ফেস্ট, লিট ফেস্ট, বইমেলা—সব উৎসবই আমাকে টানে। এসব উৎসবে গেলে কিছু না কিছু লাভ হয়, আমি অন্তত কোনও ক্ষতি দেখি না। কিন্তু আমার বন্ধুদের কাউকে কাউকে দেখি, এসব উৎসবকে ‘বুর্জোয়াদের উৎসব’, ‘করপোরেট উৎসব’—ইত্যাদি নানা ট্যাগ লাগিয়ে দূরে থাকেন। তবে উৎসবের শ্রেণি বিভাজনে আমার আগ্রহ নেই। আমার ভালো লাগলে, সময় থাকলে আমি যাবো; সময় না থাকলে যাবো না। যেমন এবার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ফোক ফেস্টে যেতে পারিনি। তবে অনেক ঝামেলা করে শেষপর্যন্ত হতে যাওয়া ক্ল্যাসিক্যাল ফেস্টে যাওয়ার চেষ্টা করবো। গত সপ্তাহে ঢাকায় হয়ে গেলো ‘ঢাকা লিট ফেস্ট ২০১৭’। তিন দিনের এই আয়োজনে ২৪টি দেশের দুইশরও বেশি অতিথি অংশ নেন। তিনদিনে একশরও বেশি সেশনে দেশি-বিদেশি সাহিত্য এবং সাম্প্রতিক নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়। এবার ছিল লিট ফেস্টের সপ্তম আয়োজন। তবে প্রথম চার বছর এই আয়োজন বসেছিল ‘হে ফেস্টিভাল’ নামে। গত তিন বছর বসছে ‘ঢাকা লিট ফেস্ট’ নামে। তিন দিনের এই আয়োজনের প্রথম দু’দিন আমি গিয়েছিলাম। সাহিত্য আমি ভালোবাসি। বাংলা সাহিত্য টুকটাক পড়লেও বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনে আমার চলাফেরা নেই বললেই চলে। বিশ্ব সাহিত্যের কিছু ক্ল্যাসিকের রসাস্বাদন করার চেষ্টা করেছি অনুবাদ পড়ে। যদিও দুধের স্বাদ কখনোই ঘোলে মেটে না।
সাহিত্য জগতে প্রায় অনাহুত হলেও লিট ফেস্টে গিয়ে আমার মন ভালো হয়ে গিয়েছিল। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণকে আমার মনে হয়েছে বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের সেতুবন্ধন, এ যেন এক খোলা জানালা। সব বয়সের মানুষের প্রাণবন্ত পদচারণায় মুখরিত ছিল বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ। বিশ্ব সাহিত্যের অনেক দিকপাল এসেছিলেন উৎসবে। তাদের বই কিনতে, অটোগ্রাফ নিতে বা ছবি তুলতে ছিল মানুষের লম্বা লাইন। আমি মূর্খ হলেও বাংলাদেশে নিখাদ সাহিত্যপ্রেমী অনেকে আছেন দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। এখন ‘করপোরেট উৎসব’ এই অভিযোগে দূরে থাকলে উৎসবের কোনও ক্ষতি হবে না, ক্ষতি হবে আমার। উৎসবে গেলে আপনি আদোনিস-এর মতো কবির দেখা পাবেন, বেন ওক্রির মতো কথাশিল্পীর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। না গেলে তাদের কোথায় পাবেন? বুর্জোয়া আর করপোরেট; যারাই আয়োজক হোক; উৎসবস্থলে নানা বিষয়ে সমৃদ্ধ আলোচনা হয়েছে; প্রায় সব সেশনে ছিল উপচেপড়া ভিড়।

গুণে-মানে-আয়োজনে লিট ফেস্ট ছিল অসাধারণ। আমি একটাই খুঁত খুঁজে পেয়েছি। আমার মতো মূর্খকেও একটি সেশন মডারেট করতে হয়েছে। তবে ২৭ বছর ধরে সাংবাদিকতায় লেগে আছি বলে ‘নিউজ’ সংক্রান্ত সেশনে উপস্থিত থাকার একটা অধিকার হয়তো জন্মায়। ধারে না কাটলেও ভারে কেটে গেছে। তবে দেশি-বিদেশি গুণী অতিথিদের কল্যাণে আমার মূর্খতা খুব বেশি এক্সপোজ হয়নি, এটাই বাঁচোয়া। মডারেটর হলেও সেশনের শিরোনাম নিয়েই আমার আপত্তি ছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের কল্যাণে ‘ফেক নিউজ’ শব্দটি বহুল প্রচার পেলেও আমি বিশ্বাস করি নিউজ মানে শুধুই নিউজ; এর কোনও সাদা নেই, কালো নেই, ফেক নেই, অরিজিনাল নেই। ‘ফেক নিউজ’—এই টার্মটি প্রচলনের কৃতিত্ব অবশ্যই ডোনাল্ট ট্রাম্প পাবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গত নির্বাচনের আগে থেকেই আলোচনায় ‘ফেক নিউজ’। বলা হয়, ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পেছনেও এই ‘ফেক নিউজ’-এর বড় অবদান রয়েছে। আর জয়ের পর তো তিনি প্রায় জপের মতো করে ‘ফেক নিউজ’ শব্দটি ব্যবহার করছেন। কোনও নিউজ তার বিপক্ষে গেলে বা পছন্দ না হলেই, তিনি সেটাকে ফেক নিউজ বলে অভিহিত করেন। এমনকি সিএনএন’-এর মতো প্রতিষ্ঠিত সংবাদ মাধ্যমের সাংবাদিককেও তিনি, ‘ইউ আর ফেক নিউজ’ বলে গালি দিয়ে দেন অনায়াসে। ট্রাম্পের কল্যাণে ‘ফেক নিউজ’ চলতি বছরের ওয়ার্ড অব দ্য ইয়ার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। অভিধান প্রকাশক কলিনস এই ঘোষণা দিয়েছে। ২০১৬ সালের পর থেকে এই শব্দটির ব্যবহার ৩৬৫ শতাংশ বেড়েছে বলে জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

শুধু ট্রাম্প নয়, পছন্দ না হলে সব দেশেই রাজনীতিবিদরা গণমাধ্যমকে গালি দেন, নিউজে রঙ চড়িয়ে দেন। তবে এটাও ঠিক, গণমাধ্যমও অনেকসময়ই ‘ফেক নিউজ’কে নিউজের মতো করে প্রচার করে। বেশি পেছনে যেতে হবে না। বছর চারেক আগে পবিত্র মক্কা শরিফের গিলাফ পরিবর্তনের ছবিকে  মানবতাবিরোধী অপরাধী সাঈদীর মুক্তির দাবির মানববন্ধনের ছবি হিসেবে প্রচার করা হয়েছিল ‘দৈনিক আমার দেশ’ পত্রিকায়। অনেক বানানো নিউজ, রঙ চড়ানো নিউজ প্রচার করে রাজনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা হয়। দৈনিক ইনকিলাব বাংলাদেশে একাধিকবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল মিথ্যা সংবাদ ছাপিয়ে।

ইদানিং বহুল প্রচারিত হলেও ‘ফেক নিউজ’ কিন্তু পুরনো প্রবণতা। মূলধারার গণমাধ্যমের পাশাপাশি সারাবিশ্বেই ট্যাবলয়েড সংবাদপত্র প্রচলিত ও জনপ্রিয়। কখনও কখনও মূলধারার চেয়েও ট্যাবলয়েডের জনপ্রিয়তা বেশি হয়। পুরোপুরি বিশ্বাস না করলেও মানুষ মজা পায় বলে ট্যাবলয়েড সংবাদপত্র কেনে। আশির দশকে বাংলাদেশেও এক ধরনের ট্যাবলয়েড পত্রিকা ছিল। বাসস্ট্যান্ড, রেলস্টেশন বা জনবহুল স্থানে হকার চিৎকার করে আকর্ষণীয় হেডলাইন শুনিয়ে পত্রিকা বিক্রি করতো। তেমন একটি পত্রিকার শিরোনাম ছিল ‘খালেদা জিয়া মা হয়েছেন’। চমকে ওঠা শিরোনাম সন্দেহ নেই। কিন্তু নিউজটি পড়তে গিয়ে জানা গেলো, ছাত্রদলের একটি প্রতিনিধি দল খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তাদের একজন খালেদা জিয়াকে বলেছিলেন, আপনি আমাদের মায়ের মতো। ব্যস এটুকু ধরেই সেই ট্যাবলয়েড সেই শিরোনাম করেছে!

এখন আর সেই রাস্তায় ফেরি করে রংচঙা নিউজ বিক্রি করার দিন নেই। এখন সবকিছু ঢুকে পড়েছে ভার্চুয়াল জগতে। গোটা জগত এখন সত্যি সত্যি হাতের মুঠোয়। অনেক মানুষকে চিনি, যারা এখন আর রেগুলার পত্রিকা পড়েন না। ফেসবুক বা অন্য সামাজিক মাধ্যমই অনেকের সংবাদের উৎস। অনেকে ফেসবুকে শেয়ার হওয়া লিংক থেকে খবর পড়ে। তারা জানেন গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো কেউ না কেউ শেয়ার করবেই। স্মার্ট ফোন আর ফেসবুকের কল্যাণে সবাই এখন নিজেই সাংবাদিক। কিন্তু এই ভার্চুয়াল জগতে সত্য আর মিথ্যার মাঝখানের দেয়ালটা প্রায়ই ঘুচে যায়। সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশিয়ে বা মিথ্যাকে সত্যের মতো করে উপস্থাপন করে বিভ্রম তৈরি করা হয়। মিথ্যাকে সত্যের মতো করে উপস্থাপনের সাম্প্রতিক উদাহরণ গতমাসেই। প্রধান বিচারপতি ছুটি নিয়ে দেশ ছেড়ে যাওয়ার পরদিন কয়েকটি প্রতিষ্ঠিত পত্রিকার শিরোনাম ও সংবাদ বদলে দিয়ে লিংক বানানো হয় এবং তা প্রচার করা হয় ফেসবুকে। সাধারণ মানুষের পক্ষে দু’টি আলাদা করা সত্যি কঠিন। সত্য মিথ্যাকে আলাদা করতে হলে, মানুষকে এখন আর শুধু সন্দেহ করলেই হবে না, রীতিমতো তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হতে হবে। ভুয়া নিউজ চিহ্নিত করার জন্য ফেসবুক নানা উদ্যোগ নিয়েছে। নানা অ্যাপসও বেরিয়েছে ভুয়া নিউজ বের করার জন্য। ফেসবুক বা ভার্চুয়াল জগত মানুষের মনের মতো করেই সবকিছু সাজায়। মানুষ কী ধরনের নিউজ পড়তে চায়, সেটা তারা জানে। তাই ফেসবুকের নিউজফিডে ‘মোটা হওয়ার ১০টি উপায় (ভিডিওসহ)’ ধরনের লিংক খুব হিট করে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, ফেসবুকে এখন ‘ফেক নিউজ বানানোর ১০টি উপায় (ভিডিওসহ)’ বা ‘ফেক নিউজ চেনার ১০টি উপায় (ভিডিওসহ)’ ধরনের লিংকও ঘুরে বেড়ায়। এখন পাঠককে রীতিমত গোয়েন্দা মনোবৃত্তি নিয়ে নিউজ খুঁজতে বেরুতে হবে। মূলধারার গণমাধ্যমের ওপর আপনি আস্থা রাখলেন। কিন্তু আগের সেই বিকালের ট্যাবলয়েডের মতো আছে ব্যাঙের ছাতার মতো হাজার হাজহার অনলাইন। ক্লিকের নেশায় যারা, পাঠক খায়, এমন নিউজ করে; সেটা সত্য হোক, অর্ধ সত্য হোক আর মিথ্যা হোক।

কিছু নিউজ আছে, নিছক ক্লিকের আশায় করা হয়। তার মধ্যে অনেকগুলো আছে নির্দোষ মিথ্যা। কিন্তু বিপদটা হলো, এই ভুয়া নিউজ কখনও কখনও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ইন্ধন জোগাতে পারে। অনেকে পরিকল্পনা করে ফেসবুকের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেয়। আগে যেটা আমার দেশ বা ইনকিলাব করতো; এখন সেটা করতে পারে যে কেউ। রামু, নাসিরনগর বা রংপুরে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালানো হয়েছিল ফেসবুকের ভুয়া নিউজ দিয়েই। সাঈদীকে চাঁদে দেখা গেছে, এমন ভুয়া খবর বিশ্বাস করেও মানুষ দাঙ্গা বাধিয়েছে। তাই সাবধানতা, সচেতনতার কোনও বিকল্প নেই। চিলে কান নিয়েছে, এটা শুনলে প্রথমে নিজের কানে হাত দিতে হবে। চিলের পেছনে দৌড়ালে হবে না। পত্রিকায় ছাপা হলেই সেটা সত্য বা ফেসবুকে লিংক আসলেই সেটা সত্য; এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

তবে ফেক নিউজের আগ্রাসন থেকে মানুষকে রক্ষা করতে মূলধারার গণমাধ্যমকে আরও বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে। গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমের ব্যবধানটা বুঝতে হবে। তথ্যই শক্তি। এই শক্তিটা কাজে লাগাতে হবে আরও বেশি দায়িত্বশীলতা এবং আরও ভালো সাংবাদিকতা দিয়েই।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

[email protected]

 

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
৫ ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল স্বাভা‌বিক
৫ ঘণ্টা পর ঢাকার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের ট্রেন চলাচল স্বাভা‌বিক
সুইডেনের বিপক্ষে পর্তুগাল দলে জায়গা হয়নি রোনালদোর
সুইডেনের বিপক্ষে পর্তুগাল দলে জায়গা হয়নি রোনালদোর
মিয়ানমারের বিমান হামলায় উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ মহাসচিব
মিয়ানমারের বিমান হামলায় উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ মহাসচিব
ইনজুরিতে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির  
ইনজুরিতে আর্জেন্টিনার প্রীতি ম্যাচে খেলা হচ্ছে না মেসির  
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ