X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকা লিট ফেস্ট ও বাংলাদেশ

দাউদ হায়দার
২১ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:৫৯আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০১৭, ১৭:৪১

দাউদ হায়দার কবুল করছি, লজ্জিত। বাংলাদেশের হালের রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ে জ্ঞান কম। অজ্ঞও বলতে পারেন। মাঝে-মাঝে বা মধ্যে-মধ্যে কৌতূহল হয় বটে, দমিয়ে রাখি নানা কারণে। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, দেশ ও দেশের মানুষকে ভুলে গেছি। অতীত ভুলে গেছি। মাটি-হাওয়া-জলের গন্ধ নেই শরীরে, শুকিয়ে লাপাত্তা হয়তো। তবে, আকাশ-মেঘ-বৃষ্টি-নদীর স্নিগ্ধতা আর নিবিষ্টতার জট পরতে পরতে এখনও। মননে। বোধে। বিন্যাসেও।
ইনিয়ে-বিনিয়ে ‘আমি’, ‘আমাকে’, ‘আমিত্ব’ প্রকাশের অভ্যাস নেই। এসব বেশিদিন চলে না। লোকে ‘খায় না’।
আমেরিকার একটি পুরনো লোকসঙ্গীত ‘হোম সুইট হোম’। এই হোম ‘দেশ’। তো, দেশের পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলে, বিদেশে, প্রসঙ্গক্রমে ‘সুইট হোম’। জেনে সুখী। ‘ভালো-মন্দ সব মিলিয়ে’।
চিনতাম না সাদাফ সায্‌কে। ঝকঝকে, ঝলমলে তরুণী। এসেছেন বার্লিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের (INTERNATIONALS LITERATURE FESTIVAL) ১৭তম আসরে। উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়েছে ৬ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর (২০১৭)। এতে ছিল বিশ্বের  খ্যাতিমান লেখকের উপস্থিতি। অরুন্ধতী রায়, এলিফ সাফাক, অমিত চৌধুরী, মহসিন হামিদ, টিম পার্কস, ডেভিড গ্রোস প্রমুখ। অনুষ্ঠানসূচিতে দেখি সাদাফ সায্-এর নাম। তার পরিচয়ে উল্লেখ, ‘বাংলাদেশের কবি’। একক কবিতাপাঠ ছাড়াও দু’টি প্যানেল আলোচনায় বক্তা।

ইতোপূর্বে বার্লিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে বাংলাদেশের কোনও কবি-গল্পকার-ঔপন্যাসিক পাঠের জন্যে আমন্ত্রিত হননি। বহুমান্য এই উৎসবে, গত ১৭ বছর অন্তত এক ডজন নোবেল বিজয়ী যোগ দিয়েছেন। গত বছর এসেছিলেন এ বছরের নোবেলজয়ী ইশিগুরো। ঢাকা লিট ফেস্ট-এ পয়েলা আকর্ষণ আদোনিস। সালমন রুশদি ছয়বার। অরুন্ধতী রায় তিন বার। সাদাফ সায্-এর নাম দেখে (অনুষ্ঠানসূচিতে) পরম আনন্দ।

তিনি কবি। বাংলাদেশের কবি। তার কবিতা কি পড়েছি? না। কোন ভাষায় কবিতা লেখেন? বাংলা না ইংরেজি? অজানা। হঠাৎই স্মরণ হলো–গতবছর, ইউপিএল প্রকাশনীর মাহরুখ মহিউদ্দীন ফ্রাংকফুর্ট বইমেলায় সাদাফ সায্-এর নাম বলছিলেন। সাদাফের একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করবেন। প্রশংসাও করছিলেন ওর কবিতার।

বাংলাদেশে ‘সাদাফ সায্’ নাম, খটকা লাগে কানে। পারস্য দেশে ‘সাদাফ’ প্রচলিত। ‘সায্’ শুনিনি। থাকতেও পারে। এও হওয়া সম্ভব, ছদ্মনাম। বিস্তর কবি লেখকের ছদ্মনাম আছে। ঢাকা লিট ফেস্ট-এ যেমন সিরিয়ার কবি আদোনিস। একসময় রবীন্দ্রনাথও ছদ্মনামী ভানুসিংহ। বিখ্যাত রাজশেখর বসু ‘পরশুরাম’। সমরেশ বসু ‘কালকূট’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘সনাতন পাঠক’। ‘নীললোহিত’। গৌরফিশের ঘোষ ‘রূপদর্শী’। এমনকী অন্নদাশঙ্কর রায়ের মতো ডাকসাইটে, নির্ভয় লেখক ‘লীলাময় রায়’।

বার্লিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবের বিরাট যজ্ঞে শতাধিক দেশের লেখক, ভিড়, আনাগোনা। দেখলুম, সুন্দরী তরুণী শাড়ি-পরা। কয়েকজনের সঙ্গে গল্প বা আলাপচারিতায় মশগুল।

‘শাড়ি-পরা’, নিশ্চিত বাংলাদেশের। যেচে আলাপ করলাম।

‘আপনি সাদাফ সায্’?

আচমকা প্রশ্নে বিস্মিত বোধ হয়। বিনয়ের সঙ্গে, সলজ্জ ‘হ্যাঁ’।

অতপর আড্ডা। জানালেন বাবার পরিচয়।

‘আরে! চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জামাল নজরুল ইসলামের মেয়ে? জামাল ভাইয়ের মেয়ে? জামাল ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে বিচলিত হই খুবই’।

সাদাফ বিমর্ষ হতে পারেন, কথা ঘুরিয়ে বলি ‘বার্লিন আন্তর্জাতিক সাহিত্য উৎসবে আপনার উপস্থিতি, বাংলাদেশের উপস্থিতি’। উদ্ভাসিত হয় মুখ। সপ্রতিভ চেহারায় দেশের প্রতিনিধিত্বের দায় নিয়ে উৎসবে হাজির। তার হাজিরায় বাংলাদেশ উজ্জ্বল। তার পঠিত তিনটি কবিতায় (তিনটিই ইংরেজিতে লেখা) বাংলাদেশ দৃশ্যমান। তিনটি কবিতার জার্মান অনুবাদ পড়েন অন্যজন। তিনটি কবিতাই তুমুল প্রশংসিত। লুফে নেন শ্রোতাকূল।

সাদাফের ইংরেজি পাঠও অসাধারণ। যদিও, কলোনিয়ান-ব্রিটিশ উচ্চারণ। সব ভারতবর্ষীয়, এমনকী বিলেতে বাস করেও।

‘ম্যাঙ্গো’ (আম) আদৌ ইংরেজি নয়, প্রাচীন তামিল। জার্মান উচ্চারণ ‘মাঙ্গো’। অস্ট্রেলিয়ান ‘ম্যানগো’। ‘ডেজ’ (DAYS) অস্ট্রেলিয়ান উচ্চারণে ‘ডাইজ’।

উচ্চারণ নিয়ে বাংলায়ও হরেক ঝামেলা। এই যে ‘উচ্চারণ’ লিখলাম, ‘মূর্ধন্য’কে উচ্চারণ করে দন্ত্যয়ের বদলে মূর্ধন্য? উচ্চারণে কী সূক্ষ্ণ তফাৎ! তিন ‘ষ, শ, স’-এর ঝামেলা কি কম? শুরুতে ‘স’-য়ের উচ্চারণধ্বনি ‘ছ’; যেমন- ‘সানজিদা’ খাতুন। কিন্তু শেষের ‘স’? রাখালদাস কি রাখালদাছ?

–থাক এসব উচ্চারণ, পণ্ডিতি। ব্যাকরণবিদ, উচ্চারণ পণ্ডিতকূল বলবেন। আমরা নিরক্ষর, বোধগম্য লোককথাই ভাষা ও ভাষ্য।

সাদাফ সায্ও দেশীয় ‘ইংরেজি ভাষ্যে’ কবিতাপাঠে শ্রোতাকে মাতোয়ারা, আবিষ্ট, মুগ্ধ করেছেন। ধন্য তিনি শ্রোতামহলে। বাহবাও কুড়িয়েছেন বিস্তর। ধন্য বাংলাদেশ।

সাদাফ বলছিলেন, ‘বাংলাদেশে বৈশ্বিক সাহিত্যের তরঙ্গ প্রবাহ যেমন জরুরি, বাংলাদেশের সাহিত্যের জোয়ার কতটা বিচ্ছুরিত, বিশ্বমুখী, সর্বজনীন, নির্ভরযোগ্য, কতটা সুগম, কতটা জমিন পোক্ত, সম্মিলিত আবাহনে তুলে ধরাই প্রচেষ্টা ঢাকা লিট ফেস্ট-এ।’

বিশ্ব সাহিত্যের যে ‘অবগাহন’ ঢাকায় তথা বাংলাদেশে, হালের বিশ্বসাহিত্যের ‘রথী’দের নিয়ে (নাইজেরিয়ান-ব্রিটিশ লেখক বেন ওকরি বুকার প্রাইজে ভূষিত, কিন্তু ‘পড়তি’ লেখক এখন। আদৌ আলোচ্য, পাঠ্য নয়) ঢাকা লিট ফেস্ট মুখর, মুখরতায় বাংলাদেশ কতটা উজ্জ্বল, প্রকাশিত? প্রশ্ন উঠবে। উঠছে হয়তো (উঠছে কিনা, অজানা)।

প্রশ্ন ব্যতিরেকেও বলবো, ঢাকা লিট ফেস্ট বাংলাদেশকে বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে পরিচয়ের যে দায় নিয়েছে, স্বল্প হলেও রূপবান, গতিমান।

ঢাকা লিট ফেস্ট-এর কাজী আনিস আহমেদ, সাদাফ সায্, আহসান আকবারসহ আরও যারা নিবিড়ভাবে যুক্ত, পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ পরিচয় নেই, দরকারও নেই, চাই কেবল বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের পরিচয়। দৃঢ় বিশ্বাস, ঢাকা লিট ফেস্ট পারবে। পারার কিছু কৌশলও দরকার। প্রয়োজনে বলবো।

বাংলাদেশের রাজনীতি-শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ‘গোলযোগের’ সঙ্গে মহব্বত নেই ঠিকই, কিন্তু সাদাফরা যখন আসেন, বলেন, ‘শত দুর্যোগেও আগুয়ান’। বলি, ‘সঙ্গে আছি বাংলাদেশ তোমার, আমার, আমাদের’।

সাদাফ সায্-এর মুখ উজ্জ্বল। গোটা বাংলাদেশ উদ্ভাসিত।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
দাবদাহে ট্রাফিক পুলিশ সদস্যদের তরল খাদ্য দিচ্ছে ডিএমপি
জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
কান উৎসব ২০২৪জাপানি ছবির দৃশ্য নিয়ে কানের অফিসিয়াল পোস্টার
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
ড্যান্ডি সেবন থেকে পথশিশুদের বাঁচাবে কারা?
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
লখনউর কাছে হারলো চেন্নাই
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ