X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

শেখ হাসিনার ‘ভুল’ ও বেগম জিয়ার ‘ক্ষমা’

চিররঞ্জন সরকার
২২ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:৩২আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০১৭, ১৪:৩৭

চিররঞ্জন সরকার কয়েকমাস লন্ডনে কাটিয়ে এসে আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া যেন অনেকটা বদলে গেছেন। তিনি আগের চেয়ে অনেক ভালো ভালো কথা বলছেন। জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে চতুর্থ দিনে আদালতে বক্তব্য দিতে গিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, প্রতিহিংসায় নয়, ক্ষমায় বিশ্বাস করি। আমার এবং পরিবারের সদস্যদের প্রতি শেখ হাসিনার প্রতিহিংসামূলক ও বৈরি আচরণ সত্ত্বেও তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি। আমি তার প্রতি কোনও প্রতিহিংসাপরায়ণ আচরণ করবো না।’
এরপর তিনি সোহরাওয়ার্দীর জনসভা থেকে আবারও ঘোষণা দিলেন, ‘আমরা আপনাদের (আওয়ামী লীগকে) শুদ্ধ করবো। যে খারাপ কাজ করেন তা বাদ দিয়ে আপনাদের সত্যিকার অর্থে মানুষ বানাবো।’
বেগম জিয়ার বক্তব্যের শাব্দিক ও অন্তর্নিহিত অর্থ দাঁড়ায়-তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বর্তমান সরকার অশুচি, দূষিত, পাপ-পঙ্কিলতাক্লিষ্ট, তাকে তিনি সাফ-সুতরো করে বিশুদ্ধ করবেন! এটা অনেক কঠিন কর্মযজ্ঞ বটে! আর সনাতন স্কুল-শিক্ষকের মতো ‘অমানুষ’গুলোকে, 'গরু-গাধাগুলো'কে পিটিয়ে হাড়-মাংস আলাদা করে 'মানুষ' বানাবেন!

এজন্য কিন্তু অনেক ধকল সামলাতে হবে। এদেশে আওয়ামী লীগারের সংখ্যা একেবারে কম নয়। হ্যাঁ, এই দলেও ‘দুধের মাছি’র সংখ্যা বেশি। কিন্তু তারপরও ‘সাচ্চা’ যা আছে, তাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এই বিপুলসংখ্যক আওয়ামী লীগারকে ‘মানুষ’ বানানো চাট্টিখানি কথা নয় কিন্তু। এ বড় কঠিন দায়িত্ব! গাধা পিটিয়ে খচ্চর, বড়জোর ঘোড়া বানানো যায়, কিন্তু ‘মানুষ’ বানানো যায় কি? আর আওয়ামী লীগারদের ‘মানুষ’ বানানো, তাদের ‘শুদ্ধ’ করাটা খুবই দুরূহ ব্যাপার। এই বয়সে এসে এত চাপ তিনি নিতে পারবেন তো?

সোহরাওয়ার্দীর জনসভায় বেগম খালেদা জিয়া আরও বলেছেন, ‘আগামী নির্বাচন নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে না হলে সে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। শেখ হাসিনার অধীনে সেটা কখনও সম্ভব নয়। শেখ হাসিনার সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না বিএনপি।’

এই কথাটাও কেমন যেন খটকা জাগানিয়া! আওয়ামী লীগ যদি ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের’ দাবি না মানে? আর ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের’ রূপটাই বা কেমন? কাদের নিয়ে গঠিত হবে তেমন সরকার? ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের’ দাবিতে তে তিনি অনেকদিন ধরেই ‘অনড়’ রয়েছেন। এই দাবি না মেনে আওয়ামী লীগ ঠিকই নিজের মতো একটা নির্বাচন করে দাপটের সঙ্গে ক্ষমতার প্রয়োগ ও চর্চা চালিয়ে যাচ্ছে! সেই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়ে, লাগাতার তিন মাস জ্বালাও-পোড়াও-অবরোধ-পেট্রোল-বোমা-অগ্নিসংযোগ, গোটা দেশকে অচল করে দেওয়া, দিনের পর দিন অফিসে রাত কাটানো ইত্যাদি অনেক কিছুই করেছেন। কিন্তু তাতে কী লাভ হয়েছে? বরং বেগম জিয়াকেই অবনত মস্তকে একদিন আন্দোলনের পথ থেকে শূন্য হাতে ঘরে ফিরতে হয়েছে। এবারও যদি আওয়ামী লীগ ‘নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের’ দাবি না মেনে একটা নির্বাচন দেয়? তিনি কিভাবে ঠকাবেন? আবারও কি তিনি এই নির্বাচন বর্জন ও প্রতিরোধের ডাক দেবেন? আবারও অনির্দিষ্ট কালের জন্য জ্বালাও-পোড়াও-অবরোধ-পেট্রোল-বোমা-অগ্নিসংযোগ, গোটা দেশকে অচল করে দেওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করবেন? কিন্তু জনগণ যদি তাতে সাড়া না দেয়? গতবারের মতো যদি তিনি আবারও ‘ব্যর্থ’ হন, তাহলে?

এবার আসা যাক ‘ক্ষমা’র প্রসঙ্গে। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘প্রতিহিংসামূলক ও বৈরি আচরণ সত্ত্বেও তাকে ক্ষমা করে দিচ্ছি।’

‘প্রতিহিংসামূলক ও বৈরি আচরণ সত্ত্বেও’ তিনি কেন ক্ষমা করে দিচ্ছেন? আর শেখ হাসিনা কি তার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন? নাকি কোনও ভুলের কথা স্বীকার করেছেন? যদি কোনও কিছুই না হয়, তাহলে তিনি শেখ হাসিনাকে কেন ‘ক্ষমা’ করে দিচ্ছেন? ‘ক্ষমা’র প্রসঙ্গ আসছেই বা কেন?

‘ক্ষমা’র সঙ্গে সাধারণত ভুলের প্রশ্ন আসে। মানুষ মাত্রই ভুল করে। ভুলের জন্য ক্ষমাও পেতে পারে। ‘প্রতিহিংসামূলক ও বৈরি আচরণ’ তো কোনও মতেই ‘ভুল’ নয়, বরং এটা একটা গুরুতর ‘অপরাধ’। সব ভুলেরও অবশ্য ক্ষমা নেই। একজন মানুষ কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তার ভুলের জন্য সে যদি শুধু একাই দুর্ভোগ পোহায়, তাহলে সেটি তার নিজস্ব সমস্যা। কিন্তু তার ভুলের জন্য যদি অন্য কেউ দুর্ভোগ পোহায়, তাহলে সে ভুলের জন্যও জবাবদিহি করতে হয়।

সব কিছু ভুলে যেতে বললেই কি সহজে ভোলা যায়? সব কিছু ক্ষমা করা যায়? অবশ্য এক পক্ষের, অর্থাৎ যে অন্যায় করে সেই পক্ষের আহ্বান থাকে সব ভুলে যাওয়ার। কিন্তু যেই পক্ষের ওপর নির্যাতন হলো তার পক্ষে সব ভুলে স্বপ্রণোদিত হয়ে ক্ষমা করে দেওয়া কতটা কঠিন তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন।

তবে ক্ষমা পরম ধর্ম। এবং ক্ষমা এক রকম চর্চা। মহৎ মানবিকতার পক্ষে ক্ষমার চেয়ে বৃহৎ ও সুন্দর আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু জনগণমনলোকে ক্ষমাশীলতার চেতনা উৎসারিত না হলে তা কেবল কতিপয়ের আকাঙ্ক্ষা এবং অনেক ক্ষেত্রে ‘মতলব’ হয়ে দাঁড়ায়। এ পৃথিবীতে সব কিছুরই একটা শেষ সীমা রয়েছে। ক্ষমাশীলতারও। খুন, ধর্ষণ, যুদ্ধাপরাধের ক্ষমা হয় না। সেই শেষ সীমাটাও যখন লঙ্ঘিত হয়, তখন শুধু আইনের অবমাননা হয় না, মানবতারও চূড়ান্ত হানি হয়। প্রশাসন, আইন বা বিচারের দৃষ্টিভঙ্গি আর বৃহত্তর মানবতার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে কোনও সূক্ষ্ম ভেদরেখা হয়তো রয়েছে। সব অপরাধের ক্ষমা হয় না— এ কথা তখন মেনে নিতেই হয়। 

শরীরের কোনও অঙ্গে পচন ধরলে চিকিৎসক প্রথমে তা সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেন। অর্থাৎ সংশোধনের প্রয়াস। সেই প্রয়াস সফল না হলে, শরীরের স্বার্থেই, সেই অঙ্গ কর্তন করা হয়। এটা প্রতিহিংসা নয়, দুঃখের হলেও, আপাতনিষ্ঠুর হলেও এই পথ অবলম্বন করতে হয়। যে মৃত্যু বহু জীবন বিনাশের সম্ভাবনা হ্রাস করে, তার প্রতিপাদন তিক্ত হলেও মাঙ্গলিক! বেগম জিয়া কী এসব তত্ত্বকথা ভুলে গেলেন?

ক্ষমার চেয়ে বড় কিছু নেই। সুন্দর কিছু নেই। ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে তার অসীম ক্ষমতা। কিন্তু যখন সমষ্টির প্রশ্ন, সমাজের সংকট, সেখানে ক্ষমাও স্বার্থ চরিতার্থতার হাতিয়ার হতে পারে। দুর্বলতা হতে পারে। এমনকী, সমষ্টির স্বার্থে কোনও ব্যক্তি হত্যাকারী চিহ্নিত হবেন কিনা তা নির্ভর করে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতের ওপর। দেশরক্ষার্থে প্রাণহরণকারী সেনানী, স্বাধীনতাকামী বিপ্লবী ইতিহাস তাঁদের বীর বলে। সমাজ তাঁদের মাল্যবিভূষিত করে। কুরুক্ষেত্র থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ— সব যুদ্ধই এই নিয়মে চলছে।

যে দিন পৃথিবীতে হিংসা থাকবে না, ধর্ষণ থাকবে না, আগ্রাসন থাকবে না, এমনকী দেশরক্ষার্থেও অস্ত্রনির্মাণ প্রয়োজন হবে না, ‘গোলাপের তোড়া হাতে কুচকাওয়াজ’, সেই দিন আর ‘ক্ষমা’র প্রশ্ন আসবে না!

‘ক্ষমা’ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে শিবাজী চট্টোপাধ্যায়ের গাওয়া একটা ‘হালকা মেজাজের’ গান। গানটা আমার কাছে ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়। গানের প্রথম অংশটি হচ্ছে-‘ফুলেতে ধন্য ফাগুন/নাকি ফাগুনে ধন্য ফুল/ভুলের জন্য ক্ষমা/নাকি ক্ষমার জন্য ভুল/তোমার জন্য আমি/নাকি আমার জন্য তুমি।’

‘আমি-তুমি’র হিসাবটুকু বাদ দিয়ে এই গানটি সারাক্ষণই মনের মধ্যে বেজে চলে। প্রশ্নগুলো ঘুরেফিরে আসে-আমি বা আমরা আসলে কার জন্য? আমাদের জন্য, সুন্দরের জন্য জীবন, না জীবনের জন্য, সুন্দরের জন্য আমরা? টাকার জন্য আমরা, নাকি আমাদের জন্য টাকা? আমাদের জন্য অফিস-চাকরি, নাকি অফিস-চাকরির জন্য আমরা? আপোষের জন্য এগিয়ে চলা, না এগিয়ে চলার জন্য আপোষ?

প্রতিহিংসার জন্য ক্ষমা, নাকি ক্ষমার কারণে প্রতিহিংসা? আমাদের জন্য রাজনীতি, না রাজনীতির জন্য আমরা? এভাবে ওই গানের স্বরলিপির মতো এপিঠ-ওপিঠ ঘুরে অবিরাম-অফুরন্ত প্রশ্ন আসে, আসতেই থাকে, কিন্তু উত্তরগুলো আসে না, মেলাতে পারি না।

তবে কী এই প্রশ্ন আসা আর প্রশ্নের উত্তর না-পাওয়াটাই জীবন? এখানেও জিজ্ঞাসা, প্রশ্নের জন্য উত্তর, নাকি উত্তরের জন্য প্রশ্ন?

লেখক: কলামিস্ট

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো ইউপি সদস্যের
বিদ্যুৎস্পৃষ্টে প্রাণ গেলো ইউপি সদস্যের
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন গরম পড়বে
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
আট বছর পর জাবিতে ডিন নির্বাচন
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
তামাকে বিষ, তবুও ঝুঁকছেন কৃষক 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ