X
বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক সৌজন্য

আমীন আল রশীদ
২২ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:২৯আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০১৭, ১৬:৩৭

আমীন আল রশীদ রাজনীতি ব্যর্থ হলে সেই শূন্যতা পূরণ করে ‘অরাজনীতি’। রাজনীতি কখন ব্যর্থ হয়? তবে রাজনীতি ব্যর্থ হয় যখন রাজনীতি থেকে সৌজন্য হারিয়ে যায়। যখন পারস্পরিক আস্থা আর শ্রদ্ধাবোধ বিলীন হয়ে যায়। যখন প্রতিহিংসাই হয়ে ওঠে রাজনীতির মূল শক্তি। যখন রাজনীতিতে পরস্পরকে শত্রুজ্ঞান করার প্রবণতা বেড়ে যায়।
আমাদের রাজনীতিতে ওই অর্থে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ বা সহনশীলতার চর্চা কখনোই ছিল না। রেষারেষি আর বিরোধী মত দমনকেই আমাদের রাজনীতিকরা টিকে থাকার প্রধান অস্ত্র বলে মনে করেন। অন্তত প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি দলের নেতাদের পরস্পর দেখা-সাক্ষাৎ হলেও যে ধরনের সৌজন্য দেখানোর কথা, অনেক সময় সেখানেও কৃপণতা লক্ষ্যণীয়।
এরকম একটা অদ্ভুত ‘রাজনৈতিক সংস্কৃতির’ মধ্যে যখন আমরা দেখি যে দেশের শীর্ষ দুটি দলের দ্বিতীয় শীর্ষ দুই নেতা বিমানবন্দরে দুই মিনিটের জন্য হলেও কুশল বিনিময় করেন, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেন, সেটি আমাদের আশাবাদী করে। নাগরিকদের মধ্যে এই বিশ্বাস আরও জোরালো করে যে, আর যাইহোক, দিন শেষে সাধারণ মানুষের ভরসা এই নেতারাই।

সাম্প্রতিক অনেক নেতিবাচক খবরের ভিড়ে সৈয়দপুর বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কুশল বিনিময়ের ছবি গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

গত ১৯ নভেম্বর তাদের দু’জনের এই দেখা-সাক্ষাৎ বা কুশল বিনিময়কে আমরা নিছক আনুষ্ঠানিকতা বা লোকদেখানো বলে মনে করি না। বরং আমরা বিশ্বাস করি যে, তারা দু’জন আন্তরিকভাবেই কাজটি করেছেন। যদিও জাতীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে বিশেষ করে যখন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি, পর্য‌টন ও পরিবেশ দারুণ চাপে পড়েছে, সেই সংকট উত্তরণের উপায় খুঁজতে দেশের প্রধান দুটি দলের দ্বিতীয় শীর্ষ এ দুই নেতার মাঝেমধ্যেই দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া উচিত ছিল। এমনকি প্রধান ‍দুটি দলের দুই প্রধান নেতা শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া যদি জাতীয় নির্বাচন না হোক, অন্তত রোহিঙ্গা ইস্যুতেও একটু কথাবার্তা বলতেন, যদি নিজেদের ভাবনা বিনিময় করতেন, যদি আন্তর্জাতিক বিশ্বে নিজেদের বন্ধুদের আরও বেশি করে কিভাবে কাজে লাগানো যায় সে বিষয়ে শলাপরামর্শ করতেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান আরও সহজ হতো বা সেই সুযোগ এখনও আছে।

কিন্তু আমাদের প্রধান দুই নেত্রী পরস্পরকে ব্যক্তিগতভাবে কতটা পছন্দ করেন, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। একসময় সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে তাদের দেখা-সাক্ষাৎ এবং সামান্য হলেও কথাবার্তা হতো। কিন্তু এখন তাও হয় না। সবশেষ গত ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে বেগম জিয়া যোগ দেননি। অসুস্থতার কারণে গত বছরও তিনি সেনাকুঞ্জের এই অনুষ্ঠানে যাননি।

তবে ২০০৮ সালে সেনাকুঞ্জে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার সৌজন্য সাক্ষাৎ হয়েছিল। অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের শেখ হাসিনা দ্রুত নির্বাচনের বিষয়ে বলেছিলেন। আর খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘আমাদের মধ্যে কুশল বিনিময় হয়েছে। জেলের মধ্যে কেমন ছিলাম, সে বিষয়ে কথা হয়েছে।’ কিন্তু এরপরে আর দুই নেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়নি। একই শহরে বসবাস করে দেশের প্রধান দুটি দলের শীর্ষ নেত্রীরা কী করে একে অপরকে না দেখে থাকতে পারেন, তা এক বিস্ময় বটে!

তাদের মধ্যে দেখা হওয়ার একটা সুযোগ হয়েছিল ২০১৫ সালের নভেম্বর মাসে। খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুর খবর শুনে শেখ হাসিনা গিয়েছিলেন খালেদা জিয়ার বাসায়। কিন্তু শেখ হাসিনা বাসায় ঢুকতে পারেননি। বিএনপির তরফে বলা হয়েছিল, বেগম জিয়া পুত্রশোকে এতই কাতর যে তাঁকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তিনি কারো সঙ্গে দেখা করতে পারবেন না।

এর আগে ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় এ দুই নেত্রীর টেলিফোন আলাপও গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। যেটি শুনলে যে কারোর মনে হতে পারে যে, দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দুজন ব্যক্তি, যাদের দিকে তাকিয়ে থাকে ১৬ কোটি মানুষ–তারা 'ঝগড়া' করছেন। ৩৭ মিনিটের ওই আলাপের অধিকাংশ সময়জুড়েই এই দুই নেতা পরস্পরকে দোষারোপ করেছেন। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ করেছেন। একপর্যায়ে হরতাল প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বান এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার অব্যাহত নাকচের মধ্য দিয়ে বেশ উত্তেজনাময় অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, আচ্ছা আপনি হরতাল প্রত্যাহার করবেন না ধন্যবাদ। এরপর লাইনটা কেটে যায়।

এতকিছুর পরও দেশের মানুষ এখনও তাদের আশা-ভরসার কেন্দ্রবিন্দু মনে করে এ দুটি দলকেই। বিভিন্ন সময়ে নানা বিকল্পের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয় শক্তি বা বিকল্প শক্তিগুলো যে হালে পানি পায়নি, তার কারণ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতি মানুষের আস্থা। তাছাড়া বিকল্প কিংবা তৃতীয় শক্তির কথা যারা বলেন, তারা নিজেদেরকে যতক্ষণ না আওয়ামী লীগ-বিএনপির চেয়ে উত্তম বলে প্রমাণ করতে পারছেন, ততক্ষণ মানুষ নৌকা আর ধানের শীষেই ভোট দেবে। সুতরাং ভোটের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যতই থাকুক, মানুষ আশা করে এ দুটি দলের মধ্যে অন্তত জাতীয় ইস্যুতে ঐক্য থাকবে।

নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার হবে কিনা, সেনা মোতায়েন হবে কিনা, ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহার হবে কিনা, ভোটের তিন মাস আগে সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে কিনা­­, সেই তর্কের বাইরে গিয়ে কেন গরিষ্ঠ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কেন্দ্রে থাকা দুটি দলের শীর্ষ নেতাদের মথ্যে ন্যূনতম যোগাযোগ ও সৌজন্য থাকবে কিনা–সে প্রশ্ন সব সময়ই বিভিন্ন ফোরামে উচ্চারিত হয়।

যদি তারা পরস্পরের বিষোদ্গারেই লিপ্ত থাকেন, যদি একে অপরের ছায়াও দেখতে না চান, তাহলে দেশের রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তনের কথা তারা বলেন, সেটি কথার কথাই থেকে যাবে। আর রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ছাড়া যে দেশের পরিবর্তন সম্ভব নয়, সে বিষয়ে আশা করি কেউ দ্বিমত করবেন না। যে কারণে ওবায়দুল কাদের এবং মির্জা ফখরুলের দুই মিনিটের কুশল বিনিময়ের খবরও অন্য অনেক খবর ছাপিয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, বিমানবন্দরে মির্জা ফখরুলকে দেখে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘আমরা যেহেতু রাজনীতি করি, তাই আলাপ-আলোচনার পথ খোলা রাখাই ভালো।’ এর আগে রংপুরে এক শান্তি সমাবেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘একই বিমানে মির্জা ফখরুলের সঙ্গে আসতে পারলে আমার ভালো লাগতো। আর কিছু না হোক, শুভেচ্ছা বিনিময় তো হতো। শুনেছি ওনার আসন আমার পেছনে ছিল। উনি এলে আমার পাশের সিটেই বসতে দিতাম।’

দেশের মানুষও আসলে চায় যে, তারা পাশাপাশিই বসুন। মত ও পথ ভিন্ন হলেও তারা মানুষের স্বার্থে, দেশ ও গণতন্ত্র তথা রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার স্বার্থে কথাবার্তা বলুন। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে নির্বাচন কিংবা অন্য যেকোনও ইস্যুই হোক––তারা পরস্পরকে শত্রুজ্ঞান না করে সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার পাত্রের মতো কথা বলবেন, সেটিই সবার প্রত্যাশা। স্বাধীনতার ৪৬ বছরে দেশের মানুষ রাজনীতি আর ক্ষমতার নামে রক্তারক্তি, হানাহানি কম দেখেনি। এবার একটা স্থিতিশীল বাংলাদেশের দিকে তারা যাত্রা করবেন এবং আগামী জাতীয় নির্বাচনেই তার উদ্বোধন হবে, এই প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি।  

লেখক: সাংবাদিক

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
গোপনে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন বিষয়ে আদেশ ২৯ এপ্রিল
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
ক্যাসিনো কাণ্ডের ৫ বছর পর আলো দেখছে ইয়ংমেন্স ও ওয়ান্ডারার্স
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ