X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করে কী অর্জন করতে চাইছেন?

লীনা পারভীন
২৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:২৩আপডেট : ২৮ নভেম্বর ২০১৭, ১৫:২৯

 

লীনা পারভীন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতি নিয়ে জাবির এক শিক্ষক একটি অনলাইনে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে একটি মতামত লিখেছেন। আমি প্রতিটি লাইন পড়েছি। বর্ণনা ও কাহিনী পড়তে গিয়ে বারবারই আমি বুঝতে পারছিলাম আমার কপাল কুঁচকে যাচ্ছে,আমি চিন্তিত হয়ে পড়ছি। ভাবছেন কেন? কী সেই ঘটনা যা আমাকে এতটা চিন্তিত করে দিলো?
ঘটনার বর্ণনায় জানা যায়, শিক্ষক মহোদয় ভর্তি পরীক্ষায় বেশ কয়েকজন পরীক্ষার্থীকে ভুয়া পরীক্ষার্থী হিসেবে চিহ্নিত করে পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন। যাদেরকে পরবর্তীতে পুলিশে হস্তান্তর করা হয়। ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে একজন ছাত্র কেন পুলিশের হাতে চলে যাবে? অপরাধের মাত্র কতটা ভয়াবহ? জানলাম তাদের কেউই নিজে পরীক্ষা দেয়নি। অন্য কেউ তাদের হয়ে পরীক্ষা দিয়েছিল এবং তাদের নাম প্রথম ৩০ জনের মধ্যে উঠে এসেছে। তাদের হয়ে অন্য ‘মেধাবী’ কোনও শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছে আর এসব ভুয়া ছাত্ররা ভর্তি হতে এসে ধরা খেয়েছে। ঘটনার বিবরণ অনেকটাই শিহরণ জাগানোর মতো।
লেখাটি পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সর্বনাশের কোন প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে? এর শেষ কোথায়? এর থেকে পরিত্রাণই বা কী? শিক্ষার্থীদের মাঝে কতটা অনৈতিক চর্চা শুরু হলে তারা নিজে ভর্তি পরীক্ষা না দিয়ে অন্যদেরকে দিয়ে পরীক্ষা দেয়াচ্ছে। যারা এদের হয়ে পরীক্ষা দিচ্ছে তারা নিশ্চয়ই মেধাবী, হয়তো তারাও কোনও না কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই অনৈতিকতার উৎস কী? এর ফলাফল আমাদেরকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? এই ছাত্ররাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম। কী শিখছে আর কী শেখাবে তারা? আইনের চোখে এরা অপরাধী। অপরাধী হিসাবে হয়তো যারা ধরা পড়ছে, তারা আইনের হাতে সোপর্দ হচ্ছে। তবে সঠিক বিচার হচ্ছে কী এই অপরাধ ঠেকাতে? পুলিশই বা কী করেছে পরবর্তীতে?
এই ঘটনায় আমাদের ভর্তি পরীক্ষা পদ্ধতির দুর্বলতা অত্যন্ত ন্যাক্কারজনকভাবে সামনে এসেছে। যারা ভুয়া পরীক্ষার্থী হওয়ার মতো বিশ্বাস লালন করে তারা নিশ্চয়ই এটা প্রথমবার করেনি বা তারা নিশ্চিত যে এসবের কোনও শাস্তি হয় না এবং এসব করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়া যায়। একদিকে যেমন ছাত্রদের নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ, ঠিক তেমনি আমাদের প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতিও প্রশ্নবিদ্ধ মারাত্মকভাবে।

শিক্ষা ব্যবস্থার এই চিত্র আজকে প্রতিটি স্তরে। নৈতিকতার দাঁড়িপাল্লায় আছে কেবল অনৈতিকতার ওজন। প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে উচ্চতর পর্যায়ের সব জায়গাতেই চলছে অরাজকতার জয়জয়কার। পাসের হার বৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় জাতি পাচ্ছে মেধাশূন্য একটি গ্রুপ। এসব মেধাশূন্যরাই পরবর্তীতে গিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির মত ঘটনায় হয় ধরা খায়, না হয় পার পেয়ে গিয়ে পরবর্তীতে আরও বড় কোন অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়ে পড়ে।

একটি দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা সরকারের এজেন্ডা নির্ভর হতে পারে না। সরকার তার নীতি সেভাবেই নির্ধারণ করবে যেটা সমাজের বেশিরভাগ মানুষ চায়, যেটা বিজ্ঞানসম্মত এবং আধুনিক জাতি গঠনের নিমিত্তে কার্যকর। কিন্তু বর্তমানে আমরা দেখছি এর উল্টো। সরকার তার ক্ষমতাকালে যেসব দলীয় এজেন্ডা নির্ধারণ করেছে তার মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতা থেকে মুক্ত করা একটি অন্যতম টার্গেট। কিন্তু দেশকে নিরক্ষরতা মুক্ত করতে গিয়ে যে উপায় অবলম্বন করছে তাতে জন্ম নিচ্ছে একটি ‘কুশিক্ষার প্রজন্ম’। শিক্ষার নামে জ্ঞানভিত্তিক জাতির পরিবর্তে তৈরি করা হচ্ছে একটি মেধাশূন্য পরীক্ষা নির্ভর জাতি।

এই ‘পরীক্ষা’ এবং ‘ফলাফল’ নির্ভর শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার সময় যতটুকু পড়া দরকার ঠিক ততটুকুই মুখস্থ করে পরীক্ষা দেয়। এতে অনেকেরই পাস মার্ক বা ভালো ফল এলেও পরবর্তীতে কিছুই আর তাদের মাথায় থাকে না। শিক্ষার্থীদের যখন টার্গেট থাকে কেবল পাস করা বা একটি ভালো রেজাল্ট বাগানো তখন বই পড়ার অভ্যাসটা গড়ে ওঠে না। নোট বা গাইড নির্ভর হয়ে মুখস্থ করে ওগলানোর সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত এসব শিক্ষার্থী বেড়ে উঠে একটি মেধাশূন্য প্রজন্ম হিসাবে।

সন্তানের এই দৌড়ে বাদ থাকে না অভিভাবকরাও। গোটা সিস্টেম যখন রেজাল্ট দিয়ে একজন ছাত্রের মেধাকে যাচাই করছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই অভিভাবকরাও চান তার সন্তানকে মেধাবীদের তালিকায় যুক্ত করতে। আর পড়াশোনা না করে, গোটা বই না পড়ে শর্টকাট পন্থায় যদি ‘মেধাবী’ ট্যাগ পাওয়া যায় তাহলে আর পিছিয়ে থাকা কেন? পরে কী হবে সেটা পরে দেখা যাবে। এই শর্টকাট পন্থার নাম প্রশ্নপত্র ফাঁস। এই প্রশ্নপত্র ফাঁস নামক রোগে এখন গোটা শিক্ষাব্যবস্থা আক্রান্ত। এতদিন এই রোগ ছিল শিক্ষাব্যবস্থার নির্দিষ্ট কোনও অংশে, আর এখন ছড়িয়ে পড়ছে মাথার চুল থেকে পা পর্যন্ত। অপরাধীরা বুক ফুলিয়ে প্রতি পরীক্ষার আগে ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে পরীক্ষার্থীদের হাতে। কিছু কিছু গ্রুপ আবার সেগুলো বিনা পয়সায় বিতরণ করছে। বিনা পয়সায় বিতরণের খবরটি দেখে সত্যিকার অর্থেই আমি আঁতকে উঠেছি। এতদিন জেনেছি এই প্রশ্নপত্র ফাঁস বাণিজ্যে বিরাট অংকের বিনিময় ঘটে। তাহলে এই বাণিজ্যের হাতছানিকে পাশ কাটিয়ে কারা এই ‘সমাজসেবা’ করে যাচ্ছেন? কী তাদের উদ্দেশ্য?

অথচ আমাদের সরকারের কর্তাব্যক্তিরা করুণভাবে উদাস হয়ে আছেন এই বিষয়টাতে। মনে হচ্ছে যেন ভুল স্বীকার করলেই সরকারের পতন ঘটে যাবে। শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্বপালনে ব্যর্থতা নিয়েও নানামহলে কথা উঠছে অনেক আগে থেকেই। আমি মনে করি, তিনি নিজেও জানেন না কখন কী ঘটে যাচ্ছে, কেন ঘটে যাচ্ছে বা এখানে তার করণীয় কী হতে পারে? জানার কোন বেদনাও দেখি না উনার মাঝে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এ বিষয়ে কোনও দায় নেয় না। এই যে অস্বীকারের প্রবণতা―এর দায় কার ওপর বর্তায়? কতটা অসহায়ভাবে আমরা দিনে দিনে জাতির এই মেরুদণ্ডের মাঝে পেরেক ঠুকে দিতে দেখে যাচ্ছি। লেখালেখি আর বকাবকি ছাড়া কিছুই যেন করার নেই আমাদের।

প্রাথমিক সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষা নিয়ে যথেষ্ট কথা হয়েছে। পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িক চিন্তাকে প্রশ্রয় দেওয়ার উদাহরণও আমরা দেখতে পাচ্ছি। প্রশ্নপত্রে ভুল, বিতর্কিত প্রশ্নে পরীক্ষা নেওয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিটি কর্নার থেকেই বিপক্ষে কথা বলা হচ্ছে। দেশের বড় বড় শিক্ষাবিদরা তাঁদের মতামত দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের সরকার ‘এক কথার মানুষ’ হয়ে বসে আছেন। সরকারের মতামত ছাড়া মন্ত্রণালয় বা অধিদফতর কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই পরিবর্তন করা হয়েছিল এর কী কোনও প্রকার মূল্যায়ন হয়েছে এখন পর্যন্ত? শিক্ষার্থী,অভিভাবক বা শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সমাজের অন্যান্যরা কী ভাবছেন সেটা কী একবারও জানা দরকার নেই?

সবার আগে দেশকে কোথায় নিতে চাই সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। নিরক্ষরতা দূর করতে গিয়ে যদি কেবল সংখ্যাগত উন্নয়নের দিকেই আলোকপাত করি তাহলে গুণগত মানের দিকটি উপেক্ষিত হবেই। গুণগত মানকে উপেক্ষা করে কেবল সংখ্যার উন্নয়ন দিয়ে অন্তত আলোকিত জাতি গঠন করা যায় না। জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেওয়ার দায় কে নেবে?

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

/এমএমআর/টিএন/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‘সেফ জোনে’ ২৩ নাবিক, নিরাপত্তায় ইতালির যুদ্ধ জাহাজ
‘সেফ জোনে’ ২৩ নাবিক, নিরাপত্তায় ইতালির যুদ্ধ জাহাজ
‘আজ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’
‘আজ থেকে শুরু হচ্ছে প্রাণিসম্পদ সেবা সপ্তাহ ও প্রদর্শনী-২০২৪’
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (১৮ এপ্রিল, ২০২৪)
আর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
চ্যাম্পিয়নস লিগআর্সেনালকে হতাশায় ভাসিয়ে সেমিফাইনালে বায়ার্ন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ